ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

 মেয়ের কাছে থাকতে পারেননি। তাই শামস ঠিক করেছিলেন একটু লম্বা ছুটি পেলে পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাবেন। কৃষ্ণা সব সময় দূরের যাত্রা বেশ ভালোবাসে। লাইলিরও ভালো লাগে বেড়াতে।
এবার শামস একা নন, সঙ্গে তানিশা আর হামিদকেও নিয়েছেন। শেফালি প্রথমে একটু আপত্তি করলেও পরে রাজি হয়েছেন সঙ্গে যেতে। আর টফি তো আছেই।
ভোরে ওঠা কৃষ্ণার জন্য কোনো ব্যাপার নয়। আর বেড়াতে যাবে শুনে সে ফজরের পরেই তৈরি হয়ে নিয়েছিল। পরিবারের বাকিরাও তৈরি ছিলেন।
তবে বাদ সাধল হামিদ। ছেলে মানুষ তৈরি হতে যে এত সময় নিতে পারে, হামিদকে না দেখলে বোঝা কঠিন। সে এত কিছু নিয়েছে সঙ্গে, তার কাঁধের ব্যাগ ফুলে ফেঁপে প্রায় ফেটে যাওয়ার জোগাড়।
‘গোটা সংসার নিয়ে কোথায় চললে বাবা?’
শেফালির কণ্ঠে ঠাট্টা বুঝতে পারল হামিদ।

‘না চাচি, তেমন কিছু না। কয়েকটা কাপড়েই ভারী হয়ে গেছে ব্যাগ।’ মাথায় কান ঢাকা টুপি চাপাতে চাপাতে উত্তর দিয়েছিল হামিদ।

‘আরে খালামণি বুঝলে না, শীতের ভয়ে হামিদ সাহেব লেপকাঁথা–কম্বল যা সামনে পেয়েছেন, ব্যাগে ভরেছেন!’

হাসতে হাসতে আপেলের টুকরোয় কামড় বসাল কৃষ্ণা। শেফালি বাইরে গেলে ফল আর পানি ছাড়া তেমন কিছু খান না। খালামণির দেখাদেখি কৃষ্ণাও তাই করে।

তানিশার ভাইঝি তোড়া বাংলাদেশ থেকে এসেছে ফুফুর কাছে। এখন থেকে ফুফুর বাড়িতে থেকেই পড়বে তোড়া। তানিশা আমেরিকা আসার আগ পর্যন্ত তোড়া ফুফুর কাছেই থাকতে ভালোবাসত বেশি। আর যেহেতু এটা তোড়ার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ, সে যা দেখছে তাতেই উচ্ছ্বসিত। এমনকি ঘাসের ভেতর ফুটে থাকা হলুদ বুনো ফুলও তোড়ার ভাষায় বিস্ময়কর।

কৃষ্ণা আর তোড়া প্রায় সমবয়সী হওয়ায় সবাই ভেবেছিল হামিদের মতো তোড়াকেও আপন করে নেবে কৃষ্ণা। তবে বাস্তবে তা ঘটেনি। কৃষ্ণা যেন তোড়াকে একটু এড়িয়ে চলতেই চাইছে। লাইলি মেয়ের এই পরিবর্তন ঠিক ধরতে পারছেন না। তবে মেয়ে যতক্ষণ কিছু না বলছে নিজে, লাইলি জোর করতেও চাইছেন না মেয়েকে।

পাহাড়ের ধার বেয়ে অনেকটা উড়ে চলেছে গাড়ি। শামস ও লাইলি ভাগাভাগি করে চালাচ্ছেন। যেন লম্বা যাত্রায় ক্লান্তি ভর না করে কারও ওপর। রাস্তার পাশে সার বেঁধে লাগানো কাঠবাদাম আর কমলার গাছ। ফলের ভারে প্রায় নুয়ে পড়া। বোঝাই যাচ্ছে এগুলো একজন নয়, কয়েকজনের খেত।

জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে হিমেল হাওয়া। কাঁপন ধরছে গায়ে। সবুজ পাহাড়ের ওপর চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে বরফকুচি। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। দুরে ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলেছে ছোট ছোট কালো পাখি। বিদ্যুতের তারে বসে বাকবাকুম ডাকছে পায়রা।

পেছনের সিটে কোনার দিকে কৃষ্ণা। মাঝে হামিদ আর তোড়া। শেফালিও বসেছেন একটু দূরে। কৃষ্ণার পায়ের কাছে বসে আদর খাচ্ছে টফি। টকটকে ফরসা, টানা টানা ঘন পাপড়িভরা চোখ। আর কোঁকড়া চুলের তোড়া ডাকসাইটে সুন্দরী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। কিন্তু সে চালচলনে ধীরস্থির। কৃষ্ণার ঠিক উল্টো। পরনের আঁটসাঁট জিনস আর খাটো আঁকড়ে ধরা গেঞ্জির ওপর এমনভাবে উলের কোট পরা, যাতে ফরসা পেটের বেশ খানিকটা বোঝা যায়। চড়া প্রসাধনীর প্রলেপ দিয়ে নিজের স্বাভাবিক সৌন্দর্য মুছেই দিয়েছে তোড়া।

কৃষ্ণা সবার সঙ্গে হাসি–ঠাট্টায় সময় কাটাচ্ছে। আর এদিকে তোড়া কানে ঠুলি গুঁজে গান শুনছে তো শুনছেই। এত লোকের ভিড়েও তোড়া মাঝেমধ্যে ঘুমের ছলে প্রায় ঢলে পড়তে চাইছে হামিদের গায়ে। বছর একুশের হামিদ তাতে বিব্রত হচ্ছে বারবার।

সদ্য জ্বর থেকে ওঠা কৃষ্ণা এখনো বেশ দুর্বল। তবু মুক্ত বাতাস পেয়ে চনমনে হয়ে উঠছে সে। কৃষ্ণা বুঝতে পারছিল বন্ধু তার ফুপাতো বোনকে নিয়ে কিছুটা বিপদে পড়েছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আগেই সবার মনোযোগ ঘোরানোর জন্যই বলে কৃষ্ণা, ‘হামিদ এত দূর রাস্তা, একটা বাজনা শোনাবে না?’

হামিদ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ‘অর্গান তো সঙ্গেই আছে, কিন্তু তুই যে আজ আমার সঙ্গে গাইতে পারবি নারে কৃষ্ণা। গলা ভেঙে বসে আছিস। কি–বোর্ডও নেই যে বাজাবি।’

‘ও তোমার বাজনা মানে তো প্যাঁ পোঁ...কী মজা পাও ওতে? আমেরিকায় থাক আর বাংলা গানের সুর শেখ, তুমি একটা আস্ত খ্যাত হামিদ ভাই! রক, হিন্দি, ইংরেজি কী দোষ করল?’ তোড়ার ত্বরিত প্রশ্ন।

এবার ভাইঝির আচরণে লজ্জিত, ক্ষুব্ধ তানিশা। ‘থাম তো তুই তোড়া!’ ধমকে ওঠেন তিনি।

‘কেন গো ফুফু, ছেলে জন্মেছে এ দেশে, আর ওকে এদেশি বানাতে পারনি? কেমন গেঁয়ো বাঙালি একটা!’

লাইলি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ‘হামিদ এ দেশে জন্মেছে ঠিক আছে, তবে ওর বাপ–দাদা চৌদ্দ পুরুষ বাঙালি, তাই না মা জননী? তবে তো তারা সবাই খ্যাত, তাই না?’

লাইলির ক্ষুব্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ খলবল করতে থাকা তোড়া চুপ করে গেল। তার মুখে যেন স্কচটেপ সেঁটে দিল কেউ। দেখে মনে মনে একচোট হেসে নিলেন শামস। স্ত্রীকে আদর করে এ জন্যই প্রীতিলতা বলে ডাকেন তিনি। ঘোর ব্রিটিশবিরোধী প্রীতিলতা ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে বিষপান করেছিলেন, তবু ধরা দেননি। কারণ, ব্রিটিশদের অন্যায়কে পছন্দ করতেন না প্রীতি। লাইলিও তাই, অন্যায় দেখলে লাইলি একাই পাঁচ শ!

‘একটু বিরতি নেব এবার...পেটে ইঁদুরের দৌড় শুরু হয়েছে কার কার? হাত তোলো!’ গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন শামস।

কৃষ্ণা আর শেফালি ছাড়া বাকি সবার হাত উঠে গেল।

যেখানে দাঁড়ানো হলো, মার্কিন সেই খাবারের দোকানটি বিশ্বব্যাপী অনেকেরই চেনা-Mc Donalds. আমেরিকানরা অনেকেই এখানকার বিগ ম্যাক আর চিকেন নাগেটসের জন্য পাগল। তবে শামস জানেন এখান থেকে শুধু আলু ভাজা (French Fries), মাছের বার্গার, আর হট চকলেট ছাড়া কিচ্ছু খাওয়া যাবে না। হালাল নয় যে! তবু দূরের যাত্রায় এসব জায়গায় একটু বিশ্রাম নিতেই দাঁড়াতে হয়। আর সেই বিশ্রামের জায়গাটিও অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার থাকে না। তাই খাবারের বেলায় কোনো মুসলমান মালিকের হালাল রেস্তোরাঁই ভরসা।

এখানেও তোড়া শুরু করল তার খলবল। ‘আমি বিগ ম্যাক খাব, নাম শুনেছি অনেক!’

‘তুই চুপ থাক...সারাক্ষণ খাই খাই...মুখটা বন্ধ রাখতে পারিস না কেন?’

তানিশা জানেন, হাজার ধমকেও তোড়ার শব্দ বর্ষণ থামাতে পারবেন না, তবু চেষ্টা।

‘তুমিও নামবে হামিদ? এখন অন্তত একটা বাজনা শোনাও না।’

একা শেফালি ছাড়া গাড়ি থেকে তোড়াসহ বড়রা সবাই নেমে গেলে আবার বন্ধুকে অনুরোধ করে কৃষ্ণা।

কৃষ্ণার টলটলে বড় বড় হালকা বাদামি চোখ দুটির দিকে তাকালে গোটা পৃথিবী কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় হামিদের। কিচ্ছু মনে থাকে না শুধু ওই চোখ দুটি ছাড়া। কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ নয়, ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা হামিদ কিছুদিন আগেই বুঝেছে, কৃষ্ণার বাদামি চোখে হারাতে চায় সে। কেবল সাহস করে বলা হয়ে ওঠেনি, ভালোবাসি। পাছে বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায়। কয়েক বছরের জমানো না–বলা কথা বলতে তাই সুরকেই বেছে নিল হামিদ। হামিদের বাবাও মাউথ অর্গান বাজাতেন। বাবার করা কিছু সুর রেকর্ড করেছিলেন মা তানিশা। সেই রেকর্ড থেকেই একটা সুর অর্গানে তুলে নিল হামিদ।

‘কী নামে ডেকে/বলব তোমাকে/অন্ধ করেছে আমাকে/ওই দুটি চোখে...।’

কোন গানের সুর বুঝতে পেরে শিহরণ জাগল কৃষ্ণার মনে। কিন্তু গলায় স্বর নেই যে! তিন দিনের জ্বরের রেশ রয়ে গেছে এখনো। বন্ধুর ডান হাতে আলতো ঠোঁট ছোঁয়াল কৃষ্ণা।

কী, হলো কী দুটোর? মনে রং লাগল নাকিরে? শেফালি হাসতে হাসতেই বললেন।

লাফিয়ে উঠল কৃষ্ণা। ‘এই মরেছি! খালামণি!’

শেফালি হাসেন। ‘মরবি কেন? বল বেঁচেছিস! পছন্দ করিস বলতে পারিস না? পঞ্চাশের দশকে পড়ে আছিস নাকি? বেশ জমবে দুটোতে!’

ঘেউ! উউউউউউ! হামিদের কান টুপি কামড়ে তুলে নিয়েছে টফি।

‘না মানে...টফি বাবা...এখন থেকে আপনার মায়ের আদর অর্ধেক আমার। আর আমার আদর অর্ধেক আপনার, বলেন রাজি?’

হাতে টফির জন্য রান্না করা মুরগির টুকরা ধরে বলে হামিদ।

ঘেউ...হামিদের হাত চেটে মুরগি খেয়ে নিল টফি। (চলবে)
---

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন