গাছের জীবনসংগ্রাম

অস্ট্রেলিয়ার দাবানল। ছবি: এএফপি
অস্ট্রেলিয়ার দাবানল। ছবি: এএফপি

স্যার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু অসম্ভব এক আবিষ্কার করেছিলেন। সেটা হচ্ছে গাছেরও জীবন আছে। সেই অর্থে গাছের জীবনবোধের সব ধরনের অনুভূতিও থাকার ও সময়ে–সময়ে সেগুলো প্রকাশও করার কথা। আমি জানি না, ঠিক কীভাবে তারা সেগুলো প্রকাশ করে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে অস্ট্রেলিয়ায় চলা দাবানলে (বুশ ফায়ার) দেশটির অনেক বনের গাছগাছালি থেকে শুরু করে বহু বন্য প্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এবারের আগুনের ভয়াবহতা এতই বেশি ছিল যে সেটা বন ছাড়িয়ে মানুষের বাড়িতে হানা দিয়েছে। বহু বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। মানুষের হতাহতের পরিমাণও একেবারে কম নয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছেরা।

গত বছরও দাবানলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সেবারই প্রথম গাছেদের পুনর্জীবনের ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলাম। ট্রেনে করে অফিসে যাওয়া-আসার পথে দাবানলে পুড়ে যাওয়া গাছগুলোকে দেখতাম আর মনে মনে হাপিত্যেশ করতাম। পরে হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম গাছগুলোর মধ্যে একধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

গত বছর এপ্রিলে গ্লেনফিল্ড আর হলসওয়ার্দির মাঝের বনে আগুন লেগেছিল। এরপর ট্রেনে যেতে–আসতে যে গাছগুলোকে সবুজ দেখতাম, রাতারাতি সেগুলোকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। একটাও পাতা অবশিষ্ট নেই। সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা ভুখা নাঙ্গার ভঙ্গিমায়। দেখে মনে হয় এ যেন দুর্ভিক্ষকবলিত আফ্রিকা বা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের অপুষ্টির শিকার শিশুগুলো। কারণ, গাছেরও জীবন আছে।

এরপর সময় বয়ে যায়। ধীরে ধীরে গাছগুলোতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি গাছগুলোর সারা শরীর থেকে পাতা গজাচ্ছে। সাধারণত কাণ্ডের যেসব স্থান থেকে শাখা বা পাতা বের হয়, সে রকম কোনো নিয়ম মেনে বের হচ্ছে না। দেখে খুবই অবাক হলাম। ধীরে ধীরে গাছগুলোর সারা শরীর সবুজ পাতায় ঢেকে গেল। ট্রেনে যাওয়া-আসার পথে ছবি তোলা সম্ভব নয়। তাই শুধু দেখে গেলাম।

গাছের পুনর্জীবন। ছবি: সংগৃহীত
গাছের পুনর্জীবন। ছবি: সংগৃহীত

এরপর ধীরে ধীরে গাছগুলো প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ছোট ছোট ডালপালা বেরিয়েছে। আগে যাঁরা গাছগুলোকে দেখেননি, তাঁরা ধরেই নেবেন এই গাছগুলো শুরু থেকেই এমন ছিল। তবে কিছু গাছ আর প্রাণ ফিরে পায়নি। বিশেষ করে শিশুগাছগুলো। কারণ, হয়তো বা তাদের শরীরের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে গিয়েছিল।

এই গাছগুলোকে দেখলে রূপকথার গল্পে পড়া ফিনিক্স পাখির কথা মনে হয়। যেটা আমি মোটেও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন মনে হয় সেই গল্পগুলো আসলেই সত্যি। ভাবছি একদিন আমার মেয়ে তাহিয়াকে গাছগুলো দেখাব আর ফিনিক্স পাখির গল্পটা বলব। বর্তমানের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর দিকে তাকালে প্রচণ্ড রকমের হতাশ হতে হয়।

এ ছাড়া মানুষ এগিয়ে এসেছে প্রাণীকুলকে রক্ষা করার জন্য। ফায়ার সার্ভিসের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা তাঁদের জীবন বাজি রেখে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেটা করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ তাঁদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও বন্য প্রাণীদের পাশে দাঁড়াতে।

আগুন নিভে যাওয়ার পর দুর্গত এলাকার প্রাণীদের জন্য হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি ও ফলমূল ছিটানো হচ্ছে, যাতে তারা টিকে থাকতে পারে। এ ছাড়া সবাই তাদের বাসাবাড়ির বাইরে বাটিতে করে খাদ্য ও পানীয় রেখে দিচ্ছে। যাতে পাখিরা এসে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

হেলিকপ্টার থেকে ফেলা খাবার খাচ্ছে ক্যাঙারু। ছবি: সংগৃহীত
হেলিকপ্টার থেকে ফেলা খাবার খাচ্ছে ক্যাঙারু। ছবি: সংগৃহীত

আমরাও আমাদের বাসার পেছনে একটা বাটিতে পানি আর একটা বাটিতে চাল রেখে দিয়েছি। দু-এক দিন পরপর আবার সেগুলো বদলে দিই। এ ছাড়া বাসার সামনের গাছতলায় চাল ও পানি রাখা আছে। প্রায়ই অনেক রকমের পাখি আসে। তার মধ্যে শালিকই বেশি। অবশ্য একটা লাল ঠোঁটের ময়না পাখিও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আরও আছে কয়েকটা কোকিল আর মাঝেমধ্যে আসে কাকের দল।

শালিক পাখিগুলোর মধ্যে দুটি পাখির জীবনসংগ্রাম দেখে যে কেউ জীবনে লড়ে যাওয়ার শক্তি পেতে পারেন। একটা পাখির বাঁ পা–টা হাঁটুর নিচে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। তাই সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। আর অন্যটার গলা থেকে শুরু করে সারা মাথায় কোনো পালক নেই। অনেকটা প্রবাসী মানুষের সিম্বলিক উপস্থাপন। তাহিয়া এই পাখিটাকে দেখে বলেছে, এরা বোধ হয় বুশ ফায়ার অঞ্চল থেকে এসেছে।

বর্তমান পৃথিবীতে শুধু অস্ত্রের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য দু-তিনটি দেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। কারণ, তাদের রাজস্বের অনেক বড় অংশের জোগান আসে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে জানি না পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।

অবশ্য এই গাছগুলোকে দেখে আশান্বিত হই যে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেলেও সেখান থেকেও শুরু করা যায়। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো আছে সেগুলো তাদের নিজস্ব সরকারই সমাধান করুক। সমাধান তাদের করতেই হবে। কত দিন আর অবজ্ঞা করে থাকবে। কারণ, নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

লেখকের বাড়ির আঙিনার পাখিদের জন্য রাখা চাল ও পানির পাত্র। ছবি: লেখক
লেখকের বাড়ির আঙিনার পাখিদের জন্য রাখা চাল ও পানির পাত্র। ছবি: লেখক

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, সবাই যদি তাদের নিজ নিজ সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই সবুজকে লালন করতে ও ভালোবাসতে শিখে যায়, তাহলে কিন্তু বিশ্বের চেহারা বদলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার। তখন বিশ্বের সব নামকরা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তাঁদের কারখানায় অস্ত্র না তৈরি করে গাছের চারার বীজতলা তৈরি করবেন। রাষ্ট্রগুলো সেখান থেকে অনেক রাজস্ব পাবে। তাই তারা সেগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে দমানোর জন্য আর অস্ত্রের ব্যবহার করবে না।

কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা এর উল্টোটা। সাময়িক মুনাফার লোভে মানুষ আমাজনের মতো বনকেও উজাড় করে দিচ্ছে। বন রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের মাথায় গুলি করে মারছে। শুভ বুদ্ধির উদয় হবে রাষ্ট্রনায়কদের। শুভ বুদ্ধির উদয় হবে অস্ত্রের কারখানার মালিকদের।

গাছের পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আবার সেখান থেকে বেঁচে ওঠার প্রক্রিয়াটা আমাকে মানব জীবন সম্বন্ধে খুবই আশাবাদী করে। আমরাও প্রতিনিয়ত অনেক বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিই। অনেকেই সেই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মহননের মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়। গাছেরা কিন্তু সেটা করে না। তারা তাদের শেষ জীবনীশক্তিটুকু দিয়ে পুনর্জীবন নেওয়ার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাতে সফলও হয়।

যদিও আগের কলেবর ফিরে পেতে বহু বছর লেগে যায়। তবুও তারা চেষ্টা করাটা থামায় না মোটেও। এর মধ্যেই হয়তোবা আবার আগুন লেগে তাদের সেই সম্বলটুকু হারিয়ে যেতে পারে। তখন আবার একেবারে নতুন করে শুরু করতে হয়। কিন্তু তারা ক্লান্ত হয় না কখনোই। আমি তাই গাছেদের কাছ থেকে জীবনসংগ্রামের শিক্ষা নিই প্রতিনিয়ত। আপনারাও একটু অবসর পেলে বনে গিয়ে গাছেদের এই জীবনসংগ্রাম চাক্ষুষ দেখতে পারেন আর হতে পারেন উদ্যমী।