মায়ের শাড়ির আঁচল

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিদেশে আসার জন্য সবকিছু যখন চূড়ান্ত হলো, তখন শুরু করলাম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা।

কেনাকাটার প্রতি আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। আমি ভাবলাম কয়টা মাত্র জামাকাপড়, লুঙ্গি-গামছা আর শুকনা খাবার কিনলেই যথেষ্ট। বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। যদিও তেমন বেশি কেনা হয়নি।

এরপরও মা আমাকে না বলে নিজ থেকে গোপনে জামাকাপড়, শেভিং ক্রিম কিনে এবং শুকনা খাবার, পছন্দের পিঠা ও নারকেলের নাড়ু বানিয়ে কৌটায় ভরে গুছিয়ে রাখলেন।

মা আমার পছন্দের খাবার সবই জানতেন। তারপরও আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, তুই কী খাবি?

আমি বলতাম, তোমরা যা খাও আমিও তা–ই খাব!

কিন্তু তবুও মা জিজ্ঞেস করেন। কী আর করা। আমি যেকোনো একটা খাবারের নাম বলে দিতাম। যে খাবার আমাদের পরিবারের সবাই খেয়ে থাকে। মা সেই অনুযায়ী খাবার রান্না করতেন।

একদিন খেতে বসার আগে বোনের সঙ্গে একপশলা ঝগড়া লেগে গেল। মা গলদা চিংড়ি ভুনা করে টেবিলের ওপর বড় বাটিতে রেখে দিয়েছেন। আমি ঘরে যাওয়ার সময় দেখি বড় গলদা চিংড়ির টুকরা মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কারও দিকে না তাকিয়ে খেয়ে নিলাম দুই টুকরা।

এদিকে ঘর থেকে বোন আমার খাওয়া দেখে মা মা করতে করতে চিৎকার করে উঠল! বোন বলল, তুই হাত না ধুয়ে চিংড়ি খেয়েছিস কেন? আমি এই তরকারি খাব না!

আমি বললাম, তোর যদি খেতে ইচ্ছা না হয়, তাহলে আমি খাব। সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিলাম আরেক টুকরা। বোনের মন খারাপ দেখে মা বললেন, তোকে আলাদাভাবে রান্না করে দেব। আজ অন্য তরকারি দিয়ে খা। বোন রাগটাগ করে কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হয়ে গেল।

আমাদের বাসায় রান্নার পর সবাই মিলে একসঙ্গে তেমন খাওয়া হতো না। সিঙ্গাপুরে আসার আগে তখন কেন জানি মনে হতো সবাই মিলে অন্তত যাওয়ার আগে প্রতিদিন একসঙ্গে খাবার খাই। ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছা হোক অন্তত যাওয়ার আগে কয়টা দিন আমার শান্ত থাকতে হবে।

কারণ, আমার খাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। আমি কারোর জন্য অপেক্ষা করতাম না। ক্ষুধা লাগলেই খেয়ে নিতাম। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার খাওয়ার সেই যে ইচ্ছা আর টান হয়েছিল, সেই টানের গভীরের উত্তর জানার দুঃসাধ্য আজও হলো না!

সিঙ্গাপুরে আসার আগে খেতে বসার পর থালার ওপর ভাতই খুঁজে পেতাম না! শুধু তরকারিতে ভরপুর।

মাকে বলতাম, এত তরকারি দিচ্ছ কেন। আমি ভাত খাব, না তরকারি খাব?

মা বলতেন, খা তো, আর কদিন আছিস!

আমি তরকারি উঠিয়ে ছোট বোনের থালায় দিতাম। বোন বলত, ভাইয়া, তুই আমাকে দিচ্ছিস কেন! তুই খা। আমি খাব না। মা বলতেন, ভাইয়া দিয়েছে খা, রাগ করিস না। তোর ভাই তো আর কদিন পর চলে যাবে। তখন তো আর কেউ তোর থালার ওপর তরকারি দেবে না। তখন কার সঙ্গে ঝগড়া করবি? মার কথা শুনে বোন আর কিছুই বলত না।

বিনা কারণে বোনের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। নিজের খাবার খেয়ে বোনের খাবার থেকে খেয়ে ফেলতাম। মাঝেমধ্যে দু-একটা কিল-ঘুষিও চলত। বোনের কান্না শুনে মা আমাকে বকাঝকা করতেন। মা বলতেন, এত বড় হয়েছিস এখনো তোর খুনসুটি ভাব গেল না! মার কথা কে আর শুনত। কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর আবার যা তাই।

আসার আগে বোনের সঙ্গে আমার যত খুনসুটির মায়াজাল বিছিয়ে ছিল, সবই আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। জানি সব মায়া গুছিয়ে নেওয়া যায় না। তারপরও গোপনে হৃদয় না ভাঙার মিথ্যা চেষ্টা করতাম। বোনের সঙ্গে আর খুনসুটি করতে পারব না ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

আমার একটা বদ অভ্যাস সব সময় ছিল। খাওয়ার পর মায়ের কাপড়ের আঁচলে মুখ মোছা। আসার কদিন আগে থেকে খাওয়ার পর মায়ের কাপড়ের আঁচলে মুখ মোছা বন্ধ করে দিলাম। খাওয়ার পর তাড়াহুড়া করে বাইরে চলে যেতাম। মা বলতেন, এত তাড়াহুড়া করিস কেন? আমি বলতাম, বন্ধুদের সঙ্গে একটু দেখা করতে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা বলতেন, আর কদিন পর চলে যাবি, আমাদের সঙ্গে বসে ধীরেসুস্থে কয়ডা খা।

আমি মায়ের কথা শুনতাম না। যদি মায়ের কথা শুনি তাহলে খাওয়ার পর কাপড়ের আঁচলে মুখ মুছতে হবে। এই অভ্যাস যে আমার ছাড়তেই হবে। মার কথা শুনলে হঠাৎ করে আমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে কষ্ট হবে। সে জন্য তাড়াহুড়ার ভাব দেখিয়ে মিথ্যা বলে বাইরে চলে যেতাম। মা বলতেন, আর কদিন পর বিদেশে চলে যাবি, সব সময় তো আর বাধা দিতে পারব না। যে কয়টা দিন আছিস, যেভাবে চলতে চাস চল। তখন আমি খুশি হতাম। সেটা ছিল মানুষ দেখানো খুশি।

প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার মায়ায় আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেত। সেই গোপন আগুনে পোড়া ছিল খুবই কষ্টের। আমি সবই বুঝতাম। কিন্তু মায়া-মমতা ত্যাগের অভ্যাস না করলে কীভাবে একা একা প্রবাসে দিন কাটাব। তাই তখন আমার মুখের গঠনে হাসির ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম।

এই যে এতটা দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর খাওয়ার পর মায়ের আঁচলে মুখ মুছি না। তাতে কী, আমার দিন বুঝি কাটছে না? তবুও দিন কাটছে। আমার মতো আরও অনেক প্রবাসীর সময়ের ওপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। সময় পৃথিবীর সব অস্তিত্ব ভেঙে টুকরা টুকরা করে দেয়। সেই টুকরা অস্তিত্ব হৃদয়ে ধারণ করে সবকিছু মেনে নিয়েই আগামীকালের স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখাই। কখনো কখনো এই প্রবাসে, তুমুল স্বপ্নবিলাসী হয়ে উঠি।