কুসন্তান

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মোমেনার হতদরিদ্র রিকশাচালক বাবা যখন হঠাৎ করেই এক দিনের জ্বরে ভুগে মারা যান, তখন মোমেনার বয়স ছিল পনেরো কী ষোলো।

মোমেনার মা আগে টুকটাক ছুটা কাজ করতেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর মোমেনাসহ ছয় সন্তানের এত বড় সংসার চালানো তাঁর জন্য অসম্ভব হয় পড়ে। মোমেনার মা তাই স্থানীয় কবিরাজি ওষুধ কারখানায় বোতল ধোয়ার কাজ নেন।

মোমেনার ছোট ভাইটি যার বয়স তখন ১২ বছর, সে–ও স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে মায়ের সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে। এতেও যখন সংসার চলে না, অনেকটা বাধ্য হয়েই মোমেনাকে গৃহকর্মীর কাজ নিতে হয়।

মোমেনা যে বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন, সেই বাসার ২৪ বছরের ছটফটে বউটির বাচ্চা হবে। সার্বক্ষণিক একজন সঙ্গী দরকার। মোমেনার সঙ্গে প্রথম দিনেই বউটির ভাব হয়ে যায়। মোমেনা তাঁকে বুবু বলেই ডাকতেন।

বুবু যখন কোরআন শরিফ পড়তেন, মোমেনা মন দিয়ে পাশে বসে শুনতেন। বুবু জানলেন, মোমেনা আরবি-বাংলা কিছুই পড়তে জানেন না। প্রবল উৎসাহে মোমেনার বুবু তাঁকে আরবিসহ বাংলা বর্ণমালা, নামতা এসব শেখানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। চটপটে বুদ্ধিমতী মোমেনা বাসার কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও খুব দ্রুতই শিখে নিলেন।

এরও বছর তিনেক পর, মোমেনার মা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। গরিবের মেয়ে বয়স বেড়ে গেলে নাকি বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। পরে পাত্র পেতে ঝামেলা হবে।

কিন্তু মোমেনার বুবু সুপাত্র ছাড়া কিছুতেই মোমেনার বিয়ে দেবেন না। মোমেনা পড়তে-লিখতে জানেন, স্বাস্থ্য ভালো, দেখতেও মন্দ নয়, তা ছাড়া বিয়েতে খরচপাতিও করা হবে ভালো। তাই একটু খোঁজখবর করলে, সুপাত্র পাওয়া যাবেই যাবে, এটাই বুবুর বিশ্বাস।

মোমেনার বুবুর স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। সেখানেই নুরুল নামে অনাথ একটি ছেলে পিয়নের কাজ করেন। ছোটখাটো, রুগ্‌ণ কিন্তু অত্যন্ত কর্মঠ ও সৎ। ঈদসহ বাসার যেকোনো অনুষ্ঠানে ছেলেটিকে দাওয়াত দেওয়া হতো। সেখানেই মোমেনার সঙ্গে নুরুলের পরিচয়। একদিন সাহস করে নুরুল তাঁর এক চাচাকে দিয়ে মোমেনার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেন। অতঃপর ধুমধামে মোমেনার সঙ্গে নুরুলের বিয়ে হয়ে যায়।

মোমেনা বিয়ের কিছুদিন পরেই চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের বরাদ্দের সরকারি কোয়ার্টারে তাঁর সংসার শুরু করেন। বিয়ের চার বছরের মধ্যে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের মধ্য দিয়ে মোমেনার সুখের সংসার যেন পরিপূর্ণতা পায়।

নিজের দুই ছেলেকে ভালোভাবে মানুষ করার পাশাপাশি মোমেনা তাঁর নিজের ছোট ভাইবোন ও বিধবা মায়ের দায়িত্ব পালন করতেন। আর্থিক সচ্ছলতার জন্য মোমেনা আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে ও মহিলাদের আরবি শেখানোর টিউশন শুরু করেন। দুই ছেলেকেই রংপুরের খুব নামকরা বেসরকারি একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।

বড় ছেলে পড়াশোনায় তুখোড়। ছোটটির পড়াশোনায় তেমন মনোযোগ না থাকলেও খেলাধুলায় অত্যন্ত ভালো। মোমেনা ছেলেদের ভালোভাবে মানুষ করার জন্য গৃহশিক্ষক, কোচিং কোনো কিছুই বাদ দিতেন না। ছেলেরা যাতে কোনো কিছুর অভাববোধ না করে তাই নুরুলও সন্ধ্যার পর বাজারের একটি দোকানে হিসাব রাখার কাজ নিলেন।

মোমেনা-নুরুলের পরিশ্রম সার্থক হয় তখনই যখন তার বড় ছেলেটি এসএসসি ও এইচএসসিতে খুব ভালো রেজাল্ট করে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিসার আর ঠিক তার দুই বছর পর ছোটটি একই প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেয়।

বড় ছেলের প্রমোশন হওয়ার পর থেকেই বিয়ের বহু প্রস্তাব আসতে শুরু করে। এত অল্প বয়সে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে মোমেনার ছিল না। সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে রংপুর শহরের কোনো এক প্রান্তে এক টুকরো জমি কিনে নিজের মতো করে একটা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। নুরুলের অফিসের হেড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব যখন তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে অফিসার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, তখন নুরুল আর সে প্রস্তাবকে না বলতে পারেননি।

মোমেনার ছেলেরও এই বিয়েতে অতি আগ্রহ। জানা গেল, ঢাকায় থাকা অবস্থায় সেখানে একটি কলেজে পড়ুয়া এই মেয়ের সঙ্গে তার ইতিমধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্কও হয়ে গিয়েছে। বড়লোক বাবার আদুরে-আহ্লাদী এই মেয়েটাকে তার ছেলেটি বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। কাজেই ছেলে-মেয়ে যেখানে রাজি, সেখানে মোমেনার আপত্তি করার কিছু ছিল না।

অতি দ্রুত বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বিয়ের আগেই কনেপক্ষ জানিয়ে দেয়, নুরুলের আত্মীয়স্বজন যারা বরপক্ষ আসবে, তারা যেন স্যুট-টাই পরে আসে। তা না হলে নাকি তাদের আত্মীয়দের মাঝে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা থাকবে না। শুধু তাই নয়, ছেলের হবুশ্বশুর নুরুলকে এক লাখ টাকা দিয়ে বলেন, এই টাকা দিয়ে শুধু কনেপক্ষের যাতে খাতিরদারি করা হয়।

বিয়ের আয়োজনের মধ্য দিয়েই মোমেনা বুঝতে পারেন, তাঁর অফিসার ছেলে শ্বশুরের হোমরাচোমরা আত্মীয়দের নিয়েই ব্যস্ত। পরিচয় দেওয়ার মতো নয়, এ জন্য নিজের গরিব-মূর্খ মামা-খালাদের তেমন গ্রাহ্য করছে না।

নিজের ছেলের আমূল পরিবর্তন দেখে বিয়ের দাওয়াতে আসা বুবুর কাছে মোমেনা হু হু করে কেঁদে ফেললেন। মোমেনার কেবলই মনে হতে লাগল ছেলেটাকে তিনি চিরদিনের মতোই যেন হারিয়ে ফেললেন।

মোমেনার ধারণা সত্যি প্রমাণ হতে বেশি দিন লাগেনি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ামাত্রই ছেলে তার বউ নিয়ে ঢাকায় সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে উঠেছে। কয়েক মাসের মধ্যে ছেলের শ্বশুরও ঢাকায় বদলি হয়েছেন। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ছেলে-বউ কেউ আর রংপুরে আসে না।

এরই মধ্যে মোমেনা খবর পান, ছেলের বউয়ের বাচ্চা হবে। এত বড় সুখবরে মোমেনা-নুরুল দুজনই আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন। ঢাকায় ছেলের বউকে দেখতে যাবেন শুনেই ছেলে জানাল, বউ তার শ্বশুরের বাসায় আছে। কাজেই ওনাদের ওখানে না যাওয়াই ভালো।

ছেলে নিষেধ করায় মোমেনা-নুরুলের সেবার আর ঢাকা যাওয়া হয়নি। কয়েক মাস পরে যখন তাঁদের নাতি হয়, নুরুল সেদিনই ঢাকায় রওনা দেন। হাসপাতালে যখন নাতিকে দেখতে যান, তখন কেবিনে তাঁর ছেলে, ছেলের শ্বশুরসহ আরও কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন। নুরুলকে দেখেই ছেলের শ্বশুর তাঁর হাতে ১ হাজার টাকা দিয়ে বললেন যাও তো, বাইরে গিয়ে কিছু নাশতা নিয়ে এসো। আর ওই যে চেয়ারটা আছে যাওয়ার সময় ওটা এখানে দিয়ে যেও। ভাব দেখে মনে হয় যেন নুরুল এখনো তাঁর পিয়ন। হতভম্ব নুরুল যখন তাঁর ছেলের দিকে তাকান, তখন ছেলে না শোনার ভান করে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ব্যস্ত।

টাকাটা নাতির মাথার কাছে রেখে কোনো কথা না বলে সেদিনই রংপুরে রওনা দেন নুরুল। বাসায় এসে মোমেনাকে এ কথা বলতেই মোমেনার ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়। মা হাসপাতালে আছে জেনেও ছেলে একবারও দেখতে আসেনি। মোবাইলে ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করে না। মোমেনার ছোট ছেলে যেহেতু সরকারি কর্মচারী, তাই অফিসার ভাইয়ের বাসায় তারও আসা-যাওয়া বন্ধ ছিল।

এর কয়েক মাস পর জাতিসংঘের একটা মিশনে নুরুলের ছেলে দুই বছরের জন্য আফ্রিকা চলে যায়। ছেলের সঙ্গে নুরুল-মোমেনার আর দেখা হয় না।

নুরুলের ছেলে দেশে ফিরে আসার পর প্রমোশন পেয়ে আরও বড় কর্মকর্তা হয়। পোস্টিং রংপুরে। ছেলে বিরাট বাসায় থাকে। চাকর-বাকর, ড্রাইভার সব আছে। অতীতের সব ভুলে নুরুল-মোমেনা ছেলে আর নাতিকে একনজর দেখার জন্য ছেলের সরকারি কোয়ার্টারে যায়। ছেলের বউ নুরুলের সামনেই নুরুলের বাবাকে তাঁর বাবার পিয়ন মনে করে সোফার পাশের কাঠের চেয়ারে বসতে বলে। এত অপমানে মোমেনার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। নাতির গলায় সোনার চেইন আর হাতে ৫ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে শেষবারের মতো ছেলের বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন মোমেনা।

মোমেনা-নুরুলের মনের সুখ যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। দিন-রাত শুধু কাঁদেন। কত কষ্ট করে ছেলে মানুষ করছেন, সেই ছেলে এখন তাঁদের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়!

পাড়াপ্রতিবেশী অনেকেই মোমেনাকে পরামর্শ দিলেন মা–বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে। সাধের চাকরি চলে গেলে ছেলে আর দাম্ভিক বউয়ের উচিত শাস্তি হবে।

মা তো মা-ই। ছেলের এত অপমানের পরও শয্যাশায়ী মোমেনা বলতেন, ছেলে যত অপমানই করুক মা হয়ে আমি তার ক্ষতি করব না। আমার ছেলে তার পিতৃ-মাতৃ পরিচয় মুছে ফেলে বড়লোক শ্বশুরের পরিচয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। আমরা বাধা হয়ে দাঁড়াব না।

শুধু দোয়া করি আমার ছেলের সন্তান যেন তার পিতামাতাকে প্রাপ্য সম্মান করে। সে যেন হয় সুসন্তান। কখনোই যেন না হয় আমার সন্তানের মতো কুসন্তান।

বি. দ্র. মোমেনা খালার বিয়ে হওয়ার সাত বছর পর তাঁর বুবুর গর্ভে আমার জন্ম হয়।