আমাজনের করুণ পরিণতি

গত এক দশকে এমন ভয়াবহ আগুন দেখেনি আমাজন। ছবি: রয়টার্স
গত এক দশকে এমন ভয়াবহ আগুন দেখেনি আমাজন। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক লেখক ডন ইভন। ‍তিনি ২০০৯ সাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে কাজ করছেন। গত বছরের আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহেই টুইট করে জানিয়েছিলেন: ‘One of the most important ecosystems on Earth, Amazon Rainforest has been burning for three weeks.’

ডন ইভন আরও লিখেছিলেন, ‘তিন সপ্তাহ ধরে আমাজন জ্বলছে। অথচ এই নিয়ে মিডিয়ায় কোনো কভারেজ দেখতে পাচ্ছি না। সেই কারণেই সংবাদটা আমাকে টুইট করতে হচ্ছে।’

এরপরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিসহ সংবাদটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আমাজন অরণ্যের অগ্নিকাণ্ড সেই থেকে গোটা বিশ্বে আলোচনার বিষয়বস্তু।

২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এনবিসি চ্যানেলে গুরুত্বপূর্ণ খবরের তালিকায় শোনা গেল: ‘The Amazon is still on fire.’

নাসা থেকে বলা হলো: ‘The rainforest is burning at an alarming rate.’

২০১৯ সালের আগস্টের অগ্নিকাণ্ড অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার জন্যই এই সংবাদ দুশ্চিন্তার ছায়া ঘনিয়ে তুলেছে সচেতন মহলে। বিশ্বনেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এর পরিণতি সম্পর্কে।

ফ্রান্সের ৪১ বছর বয়সী তরুণ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, এই আগুন নেভানোর পদক্ষেপ সরকারকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। নইলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার যেসব বাণিজ্যিক চুক্তি রয়েছে, তার লেনদেনের সব প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।

দক্ষিণ আমেরিকার ছোট–বড় নয়টি দেশকে ঘিরে রয়েছে আমাজন অরণ্যের বিস্তার। এই দেশগুলো হলো ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম আর ফ্রান্স (ফ্রান্স গায়ানা)।

বিশ্বের ১২টি রেইনফরেস্টের মধ্যে আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট বৃহত্তম। প্রকৃতপক্ষে এর আয়তন ছিল ২ দশমিক ১২৪ মিলিয়ন বর্গমাইল। দক্ষিণ আমেরিকার আয়তন ৬ দশমিক ৮৯০ মিলিয়ন বর্গমাইল।

পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।

ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।

জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।

একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।

অবশ্য শুধু যে আমাজন রেইনফরেস্টই আজ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা নয়; বিশ্বের সব কটি ট্রপিক্যাল ও টেম্পারেট রেইনফরেস্টই বর্তমানে বিপর্যস্ত। এ সম্বন্ধে নিচে সংক্ষিপ্তভাবে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।

আমাজন রেইনফরেস্ট আয়তনে বিশ্বের এক নম্বর বৃহত্তম গ্রীষ্মপ্রধান অরণ্য। রেইনফরেস্টের দক্ষিণে রয়েছে ব্রাজিল (আমাজনের ৪০ ভাগ অরণ্যই ব্রাজিলের সীমান্তজুড়ে)। উত্তরে গায়ানা হাইল্যান্ড। পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালা। পূর্ব দিকে রয়েছে অনন্তপ্রসারিত আটলান্টিক মহাসাগর।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রয়েছে আমাজনের জঙ্গলে। সত্তর দশকের কিছু আগেও এর আয়তন ছিল ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২ বর্গমাইল)। সত্তর দশকে আয়তন পরিমাপ করা হয় ৪১ লাখ বর্গকিলোমিটার। নব্বইয়ের মধ্যভাগে মহা অরণ্যের বিরাট শরীর আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়ে।

অরণ্য সুরক্ষায় তখনকার ব্রাজিলিয়ান সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মিলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এই অসাধারণ ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের করুণ পরিণতি তাতে ঠেকানো যায়নি। অবৈধ ও বৈধ—দুভাবেই ক্রমাগত বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।

২০১৬ সালের নতুন পরিমাপে ধরা পড়ে ক্ষীণাঙ্গ হতে হতে আমাজনের আয়তন দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেইর বলসোনারো। তিনি এ দেশের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন তথ্যসূত্রের প্রকাশ, তাঁর উৎসাহে তীব্রভাবে চলতে থাকে নতুন শিল্পকারখানা আর নতুন কৃষিজমি আবিষ্কারের পরিকল্পনা। আমাজনে ঘটতে থাকে একের পরে এক অগ্নিকাণ্ডের সব ভয়াবহ ঘটনা।

অবশ্য আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট ২০১৯ সালেই যে প্রথম লেলিহান শিখায় জ্বলছে তা নয়; এখানকার প্রাচীন ইতিহাস বলছে, বাসস্থান গড়তে, কৃষিজমির প্রস্তুতিতে এই অঞ্চলের মানুষ বহুবার পুড়িয়েছে এই অরণ্যকে। এ ছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে দাবানলের ঘটনাও রেইনফরেস্টগুলোর এক স্বাভাবিক ঘটনা।

গত এক দশকে এমন ভয়াবহ আগুন দেখেনি আমাজন। ছবি: রয়টার্স
গত এক দশকে এমন ভয়াবহ আগুন দেখেনি আমাজন। ছবি: রয়টার্স

কিন্তু বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।

জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।

তবে ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর সময় যতটা দ্রুতগতিতে ও নির্বিচারে অরণ্য উজাড় করা হচ্ছে, এমন নাকি অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। এ বছর হাজার হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আমাজনে। পুড়ে ছাই হয়েছে ৭ হাজার ২০০ বর্গমাইল। এই আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের সমান।

২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের স্পেস এজেন্সি একটি গবেষণা ডেটা প্রকাশ করে জানিয়েছে, ‘The number of the forest fires in the Brazilian Amazon between January and August surged by 84%, from the same period in 2018.’

অথচ কিছুদিন আগেই জাতিসংঘে বসে আমাজন সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো বলে এসেছেন, আমাজন রেইনফরেস্ট যাকে বলে একেবারে অক্ষত আর আনটাচড অবস্থাতেই রয়েছে।

আমাজনের করুণ পরিণতির দায়ভার কেউই কাঁধে নিতে রাজি নয়। অতএব ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিএনবিসি চ্যানেল থেকেও ব্রাজিলের বন প্রতিরক্ষা গ্রুপের বরাত দিয়ে জানানো হলো, ‘Conservation Groups have blamed illegal logging and Criminal networks for the rainforest fires.’

তবে পরিবেশ সংস্থা ও গবেষকেরা বললেন, সত্যি বটে, গবাদিপশুর খামার মালিকেরা আর কাঠ ব্যবসায়ীরাই আগুনগুলো লাগাচ্ছে। তবে সেটা অবৈধভাবে নয়। ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর উদ্দীপনায় আর উৎসাহে।