ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-৫

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আবার বলছি, সরে যাও তোড়া, এসব আমার মোটেও পছন্দ নয়, যতই বিদেশ হোক।’ হামিদ এক হাতে তোড়াকে ধাক্কা মেরে সরাতে যায়।

টলতে টলতে হামিদের গলা জড়িয়ে ধরতে যায় তোড়া। ‘ভালোবাসি বলেছি না? কেন ধরতে পারব না?’

গা গুলিয়ে ওঠে হামিদের। তোড়ার মুখ থেকে তীব্র, কটু গন্ধ বের হচ্ছে। এ দেশে থাকতে থাকতে এসব গন্ধ এখন হামিদের চেনা। সিগারেট নয়, মদ গিলেছে তোড়া।

শুধু মদ নয়, তোড়া গাঁজা পেলেও পাগল হয়। বেসামাল তোড়াকে সামলাতে তখন নাভিশ্বাস ওঠে হামিদের মায়ের। হামিদের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরতে চায় তোড়া। কোনোমতে এক হাতে তোড়াকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে মায়ের ঘরের দিকে দৌড়ে যায় হামিদ। নেশাগ্রস্ত বোনকে সামলানো ওর কম্ম নয়। এ কাজ তানিশাই পারবেন।

হ–আ–আক! শব্দেই হামিদ বুঝে নিল, অতিরিক্ত মদ সহ্য হয়নি তোড়ার পেটে। এ মেয়েকে যতই পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হোক না কেন, বেরিয়েই আবার জড়াবে নেশার জালে। কারাগার অবধি গেছে তোড়া, তবু শিক্ষা হয়নি।

‘আম্মা...।’ মায়ের গায়ে হাত রাখে হামিদ। ‘আম্মা ওঠো!’

আধঘুমে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলেন তানিশা। ‘কী হলো রে, বাবা?’

‘কী আবার হবে? তোমার আদরের ভাইঝিকে সামলাও, যাও!’ রাগে কাঁপছে হামিদ। ‘চুলের ঝুঁটি ধরে দেশে কেন ফেরত পাঠাচ্ছ না একে? কোনো দিন ওর জন্য তোমাকে পুলিশে ধরবে।’

‘সত্যি কোন কুক্ষণে যে আসতে বলেছিলাম ওকে। এতগুলো বদভ্যাস জানলে বাংলাদেশেই থাকতে বলতাম!’ বিরক্তমুখে খাট থেকে নামতে নামতে বললেন তানিশা।

মাদক তোড়ার চেহারা থেকে কেড়ে নিয়েছে তার লাবণ্য। এক মাথা কোঁকড়া চুলের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। চোয়াল বসে গেছে, চোখেও সব সময় ঘুম ঘুম ভাব। তবে তাতে তোড়ার কোনো ভাবান্তর নেই। পড়াশোনাতেও অনেক পিছিয়ে পড়েছে তোড়া। দেশেও তানিশার ভাইয়ের দিন কাটে দুশ্চিন্তায়। আমেরিকায় পড়তে এসে রাতারাতি মার্কিন হতে চেয়েছিল তোড়া। কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে প্রথমটা কিছু বোঝেনি। বয়সই–বা কত ওর আর? সবে তো কুড়ি। পৃথিবীর অনেকটাই এখনো দেখার বাকি।

তানিশার এখন লক্ষ্য একটাই, কোনোভাবে ভাইঝির পড়াটুকু শেষ করিয়ে ওকে দেশে ফেরত পাঠানো। তানিশা ভীষণ ভালোবাসেন তোড়াকে। তবে ওর বদভ্যাসের কোনো আঁচ হামিদের ওপর পড়ুক, সেটা মা হয়ে কখনো চান না তিনি।

অন্যদিকে হামিদ আর কৃষ্ণা দুজনই পড়ে একই কলেজে। শামস-লাইলি দুজনেরই ইচ্ছা ছিল হাইস্কুল থেকে সরাসরি ইউনিভার্সিটি যাবে মেয়ে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ নাগালের বাইরে হওয়ায় ইচ্ছাটাকে ধামাচাপা দিতে হয়েছে। প্রথমে দুই বছর কমিউনিটি কলেজে পড়ে পরের দুই বছরের জন্য ইউনিভার্সিটি ট্রান্সফার নিলে চার বছরের ডিগ্রিই হয়। তবে অপেক্ষাকৃত কম খরচে।

মেয়ের মনের কথা জানার পর লাইলি আর কোনো আপত্তি করেননি। হামিদ তার কাছে নিজের ছেলের থেকে কম কিছু নয়। হামিদের চালচলনও মেয়ের সঙ্গে মানানসই। ফলে এখন কৃষ্ণার প্রেমের গাড়ি বেশ গড়গড়িয়ে চলছে। পরিবার থেকে লুকানোর কিছু নেই যে। শামস নিজের মেয়েকে তো বিশ্বাস করেনই, এটাও বেশ জানেন, হামিদ এমন মায়ের ছেলে, যার মধ্যে মূল্যবোধ বেশ প্রবল। সময়ের আগে ওরা কেউ সীমারেখা অতিক্রম করবে না। সে শিক্ষা পরিবার থেকেই পাওয়া ওদের।

তানিশা ছোট থেকে দেখেছেন, কৃষ্ণা কীভাবে হামিদের খেয়াল রাখে। ছেলের মনের খবর জানতেন মা। কৃষ্ণাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ ছিল না তানিশার। এ দেশে আসার পর থেকে শামস তানিশাকে বোনের মতো দেখেন। সময়ের সঙ্গে লাইলির বেশ কাছের বান্ধবী হয়ে উঠেছিলেন তানিশা।

তাই এখন ক্লাসের ফাঁকে অবসরে হামিদ-কৃষ্ণাকে দেখা যায় একসঙ্গে আইসক্রিম পারলারে ঢুকতে। দুজনে একই আইসক্রিম বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে। বা হয়তো পড়ছে দুজন। একজন আর একজনের কাঁধে মাথা রেখে।

কলেজ মানে সাধারণত কৈশোর আর যৌবনের মাঝের এমন একটা বয়স। যখন মন কোনো বাধা মানতে চায় না। তাই কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল, এগুলো কলেজেও এমনভাবে শেখানো হয়, যাতে ছাত্রছাত্রীরা কোনো ভুল না করে। কথা বলার আদবকায়দা, মানে কোনটি বলা উচিত আর কোনটি উচিত নয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্স থাকেন, পুষ্টিবিদও থাকেন। কার শরীর আর উচ্চতা অনুযায়ী কতটা খাবার কীভাবে খাওয়া উচিত, পুষ্টিবিদ সেই ধারণা দিতে পারেন। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ কী, কেন করতে হয়, এ ব্যাপারগুলোও বোঝানো হয়। যাতে ছাত্রছাত্রীরা কোনো অসতর্ক মুহূর্তের মাশুল না গোনে।

সিগারেটের কুফল, ছাড়ার কৌশল, মদ শরীরের কী ক্ষতি করতে পারে—এসব ব্যাপার যখন কৃষ্ণা মন দিয়ে শুনত, তোড়া তখন মুখ টিপে হাসত। আর মনে মনে বলত, ‘হায়রে কৃষ্ণা, তুই এখনো এমন শিশু কেন? সবকিছুতে তোকে মা–পাপার অনুমতি নিতেই হবে? বয়স কত তোর? পাঁচ?’

পাল্টা হাসত কৃষ্ণাও। মনে মনে বলত, ‘নারে, পাঁচ বছর না, আমার বয়স পাঁচ মাস! আমি এখনো অ্যা অ্যা করা বাচ্চা!’

আর ডাক্তার সিরাজের সঙ্গে গল্পেও কৃষ্ণা শিখত অনেক কিছু। আঠারো হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত রক্ত দেয় কৃষ্ণা। কারাতে শেখে পথে–ঘাটে বিপদ তাড়াতে। নিজের সঙ্গে এক বোতল গোলমরিচ গুঁড়া (pepper spray) রাখে। মাথা উঁচু করে চলে কৃষ্ণা। কারও ওপর নির্ভর করে নয়।

অন্যদিকে জিম করা পেটানো শরীর হামিদের। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। রুপালি ফ্রেমের চশমার আড়ালে গভীর কালো এক জোড়া চোখ। গালজুড়ে চাপদাড়িও মন্দ লাগে না। ফুটবলের মাঠে হামিদ যেমন তুখোড়, ক্লাসে তেমনি চৌকস। স্বর্ণকেশী বিদেশিনীরা অনেকেই হামিদকে প্রেম নিবেদন করেছে। কফি খেতে ডেকেছে কেউ কেউ। হামিদ কৌশলে এড়িয়ে গেছে সব।

বিদেশিনীরা আড়ালে বলাবলি করে, ‘ওই কালো ছিপছিপে লম্বা তালগাছ কৃষ্ণার ভেতর কী পায় এই ছেলে? আমরা তো ওর চেয়ে কত সুন্দরী।’

ওরা দুজন কাজ করে কলেজেই। শিক্ষকের সহায়ক হিসেবে। অঙ্কের ছাত্র হামিদের কাজের বিষয় উচ্চতর গণিত। আর কৃষ্ণা পড়ায় ইংরেজি। দুটি বিষয়েই ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে ওদের কাছে। ঘণ্টাপ্রতি ১৩ ডলার করে পায় ওরা। দিনে তিন ঘণ্টা করে, সপ্তাহে পাঁচ দিন, হাতখরচটা বেশ ভালোই হয়ে যায়। আমেরিকার হিসেবে ১৩ ডলার হয়তো অনেক কম।

তবে শামস মেয়েকে গল্পের ছলে বলেন বাংলাদেশের দিনমজুর ও রিকশাচালকদের কথা। খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো সারা দিন পরিশ্রম করে হয়তো ১০ ডলারও রোজগার করতে পারে না। কৃষ্ণা তাই জানে, ১৩ ডলারও অনেক।

তবে বাড়ি ফিরলে তোড়ার বাড়াবাড়ি বিরক্তিকর লাগে হামিদের। কথায় কথায় গায়ে ঢলে পড়া, হামিদ না চাইলেও তার জন্য রান্না করা...আর তোড়ার রান্না মানে যত দুনিয়ার মাংসের পদ। হামিদ যে মাংস খায় না তা নয়। তবে অতটা পছন্দ করে না। এদিকে না খেলে আবার আরেক জ্বালা কান্না জুড়বে তোড়া, ‘ও ফুফু দেখ না, এত কষ্ট করলাম যার জন্য, সে–ই খায় না।’

তোড়া প্রায়ই বলে সে ভালোবাসে হামিদকে। হামিদ যতই বোঝাতে চেষ্টা করে, সে তোড়াকে বোন ছাড়া কিছু ভাবতে পারবে না, তবু এই মেয়ে জোঁকের মতো আটকে থাকতে চায় সঙ্গে। কৃষ্ণার সঙ্গে হামিদের ভালো বোঝাপড়া। তাই এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি কৃষ্ণা। তবু হামিদের ভয় হয়, কৃষ্ণা যদি ভুল বোঝে? (চলবে)