রত্না নদীর চোখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাড়ি পৌঁছেছি গতকাল সকাল ১০টায়। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে নিজভূমে। এ অন্য রকম এক ভালো লাগা। লম্বা এক ঘুমে একেবারে পরদিন বিকেল। হেমন্তের ধান কাটা মাঠের বুক চিরে নদী। নদীর বুকে মৃদু ঢেউয়ে কার যেন মুখ দেখা যায়। অপুষ্ট মুখখানা। তাকে আর মনে পড়ে না।

আমার সঙ্গে আছে মেয়ে তানিশা। বয়স ১৯ বছর। আমি মাঝেমধ্যে ঘুমন্ত তানিশার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। মুছে যাওয়া ওই মুখখানা স্মৃতিতে আনতে চেষ্টা করি। পারি না।

পূর্ব লন্ডনে হোয়াইট চ্যাপেল রোডে বাংলা টাউন থেকে হাঁটা দূরত্বে আমরা থাকি। বাংলা টাউনে কাপড়ের একটা দোকান মা-মেয়েতে মিলে চালাই। কাজের ফাঁকে হঠাৎ করেই আলতাব আলী পার্কে এসে বসি। শহীদ মিনারের দিকে চেয়ে থাকি।

অনেক আপন কিছু মুছে যাওয়া দিন আর অস্পষ্ট মুখ আমাকে ডাক দেয়। নদীর স্নিগ্ধ স্রোতে মিশে যায় আমার হৃদয়। মা-বাবা কেউ নেই। তবুও তিন-চার বছর পরপর একবার দেশে আসি। নদীর বুক ছুঁয়ে আসা বাতাস আমাকে ব্যাকুল করে। ব্যস্ততার ফাঁকে কখনো আনমনা হয়ে যাই। নদীর জলের মতো কিছু মায়া।

অনেক কষ্টের মাঝেও কী এক ভালো লাগা আছে যেন। অনেক কান্নার মাঝে কোথাও একটু শান্তি আছে যেন। দাদা-দাদু, মা-বাবা, আমার জন্ম, আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতিঘেরা ওই বাড়িখানা। টিনের দুটি ঘর। ঘর দুটোকে সংস্কার করে পুরোনোর ভেতর খুঁজে ফিরি আমার অস্তিত্বের ঘ্রাণ।

বাবার হাতে লাগানো জাম আর সুপারিগাছে ঘেরা আমাদের বাড়িখানা। সামনে ছোট্ট আঙিনাটা ছেয়ে আছে কুমড়ার লতায়। সবুজ পাতার ফাঁকে হলুদ ফুল বাতাসে দোল খায়। তানিশা ঘুমিয়ে আছে। আমি ধান কাটা মাঠের মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাই।

আমি বলব না সে অনেক দিন আগের কথা। না, এই তো সেদিনের কথা। স্মৃতি সুখের হোক আর কষ্টেরই হোক, স্মৃতিই যে বড় আপন।

তখন আমার বয়স ছয় বছর। আর তিন বছর বয়স ছিল আমার একমাত্র ছোট বোন প্রীতির। সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই চারদিকে আতঙ্কিত লোকজন গলা নিচু করে কেউ বলছে, ‘মিলিটারি’, ‘মিলিটারি’। কেউ মাকে ডাকছে, কেউ বাবাকে তাড়া দিচ্ছে। চারদিকে চিৎকার। ‘পালাও, তাড়াতাড়ি পালাও!’

ঝাপসা মনে পড়ে, কে যেন বাইরে থেকে বাবাকে ডেকে বলছে, ‘মিলিটারি আমাদের প্রতাপপুরের কাছাকাছি চলে এসেছে। দাদা, তাড়াতাড়ি পালিয়ে যান।’

বাবার কাঁধে আমি আর মায়ের কোলে প্রীতি। আবছা অন্ধকারে দৌড়। দূরে কোথায় যেন গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মা সন্তানসম্ভবা। আশা করছি, আমাদের একটা ভাই হবে। মা তা–ই বলেন। কী যেন টের পাচ্ছিলেন।

আর ছয় কি সাত মাস পরই দেখতে পাব আমার ভাইটির কুঁড়ির মতো মুখ। প্রায়ই মাকে জড়িয়ে ধরি। মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখি, আমার ছোট্ট ভাইটি তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার চোখেমুখে আদর করছে। ভাইটিকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরে রাখি। কী যে শান্তি!

বাবার কাঁধে বসে তাঁর মাথাটা জাপটে ধরে বারবার মায়ের দিকে তাকাই। মা কেমন যেন হাঁটতে পারছেন না। একপর্যায়ে মা বসে পড়েন। বাবা তাড়া দিয়ে বলেন, ‘চলো। এখন বসার সময় নেই।’

প্রীতি কান্না শুরু করে। বাবা ওকে কোলে নেন। আমি বাবার হাত ধরে দৌড়াচ্ছি। আমাদের সাড়া পেয়ে সড়সড় করে কী যেন ঢুকে পড়ে ধানখেতের ভেতর। ভয়ে আমার শরীর বারবার কাঁটা দিয়ে উঠছে। টের পাই, মা যেন কাঁদছেন। মাঝেমধ্যে ডুকরে উঠছেন।

নদীর পাড়ে এসে আমরা দাঁড়াই। বাবা আমাকে কাঁধে নিয়ে পানিতে নেমে পড়েছেন। অনেক দূরে গ্রামের ভেতর থেকে দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আগুন। গোলাগুলির শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। মাকে তাড়া দিয়ে বাবা বলছেন, ‘আরে, তুমি দেখছ কী? প্রীতিকে কাঁধে দিয়ে সাঁতার দাও। আসো, আমার হাত ধরো।’

আমি সাঁতার জানি না। আমার শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছে। আমরা নদীতে সাঁতরাচ্ছি। ওপারে যেতেই হবে। নইলে মিলিটারিরা আমাদের মেরে ফেলবে। আমি বাবার কাঁধে। হিমশীতল জল। ডুবে যাচ্ছি। আবার ভাসছি। আমার নাকেমুখে ঢুকছে জল।

তারপর আর জানি না। আমার মনে পড়ে না। মনে পড়ে শুধু, নানু আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। বাবা স্তব্ধ হয়ে চৌকিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন পাথুরে মূর্তির মতো। মা একটু পরপর মূর্ছা যাচ্ছেন।

না, তার পরের কাহিনি আমার আর মনে পড়ে না। মনে করতে চাইও না। বড় হয়ে এটুকুই বুঝেছি, রত্নার জল মায়ের শরীর থেকে ধুয়ে নিয়ে গেছে আমার ভাইয়ের অনাগত মুখ। চিরদিনের তরে রত্নার কাদাজলের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে আমার বোন প্রীতি।

আজ এই জলের নীরব বুকের ভেতর দেখি আমার ভাইকে। হিম ছবি। কুঁড়ির মতো মুখ তার। দেখি অমার ঘুমন্ত বোন প্রীতি। আমরা তিন ভাই-বোন। এ নদীর বুকে আমাদের কৈশোরের খেলাঘর। সন্ধ্যায় রত্নার নিথর ঝাপসা রুপালি বুক। দু-একটা নিশাচরের ডাক। এরই মাঝে শুনি বহুদূর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট ডাক, ‘আপু, এসো আপু!’

আমার অস্থির চোখ। কে ডাকে আমারে? রত্নার ঝাপসা রুপালি বুকে হিম ছায়ার মতো দুটি শিশু। আমি তাদের মন ভরে দেখি।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>