আমাদের জেগে ওঠার এখনই সময়

ক্যানসাসে মাঠে তুলা। ছবি: লেখক
ক্যানসাসে মাঠে তুলা। ছবি: লেখক

কয়েক মাস আগেও দেখে মনে হয়েছিল, গাঢ় সবুজের মাঠে আলুগাছ। হয়তো মাটির ভেতরে আলু হবে। মাসখানেক পর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেখি, গাছটি মাটি থেকে ঠিক দাঁড়িয়ে গেছে।

প্রকৃতির রং বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছুদিন যেতে দেখি ইউ টার্ন। সবুজ থেকে বাদামি হয়ে পাতাঝরা গাছ যেন ধবধবে সাদা মাঠ ছেয়ে গেছে। দূর থেকে মনে হয়, লজ্জায় জড়ানো নরম তুলতুলে সফেদ বিছানা। চলতি পথে এ লজ্জাবতীর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা মেলে আমার।

প্রথমে বুঝতে পারিনি। একদিন কাছে গিয়ে দেখলাম। দেখে মুগ্ধ হলাম। হাতের আলতো ছোঁয়ায় যেন লজ্জা পেল ধবধবে সাদা নরম তুলাগাছগুলো। যত দূর চোখ যায় সাদা মাঠ যেন পথিককে কাছে টানে। বিরাট এলাকাজুড়ে এই তুলার খেত ক্যানসাস রাজ্যের পনি এলাকায়।

ক্যানসাসে মাঠে তুলা। ছবি: লেখক
ক্যানসাসে মাঠে তুলা। ছবি: লেখক

একদিন গাড়ি থেকে নেমে কৌতূহলী মন নিয়ে তুলাচাষির সঙ্গে কথা বললাম। তার নাম স্টিভ। তিনি বলেন, ‘এবার আরাকানসাস এলাকা বরফে ঢেকে যেতে পারে। তাই প্রতিকূল এলাকা ছেড়ে প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশে তুলা চাষে নেমে পড়লাম। এই প্রথম এ জায়গায় তুলা চাষ করলাম। বেশ ভালো ফলন হয়েছে। প্রায় ১ হাজার ২০০ টন তুলা পাওয়া যেতে পারে।’

স্টিভ জানান, অন্য শহরে তাঁদের আরও কয়েকটি কটন ফিল্ড রয়েছে।

নতুন নতুন নানা প্রজাতির তুলা থেকে আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের কাপড় তৈরি হচ্ছে। চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ তুলা উৎপাদনকারী দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রায় ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলা রপ্তানি করে থাকে। গুণমানে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো।

তুলা উৎপাদনে চীন এক নম্বর। দ্বিতীয় ভারত। তৃতীয় আমেরিকা। এ তিন পরাশক্তিকে তাক লাগিয়ে বিশ্বে অন্যতম তূলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। আগে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল চীন।

মাঠ থেকে নেওয়া হচ্ছে তুলা। ছবি: লেখক
মাঠ থেকে নেওয়া হচ্ছে তুলা। ছবি: লেখক

এ তথ্য জানার পর আগ্রহ বাড়ল তুলা নিয়ে কিছু একটা লেখার। তুলার সঙ্গে গার্মেন্টসশিল্পের রয়েছে ভাইবোনের মিল। এই দুই মিলের সমন্বয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি জেগে ওঠা কেউ পছন্দ করেনি।

এক দশক আগেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন দেশের কারখানায় তৈরি কাপড়ই নিজেদের চাহিদা পূরণ করছে।

আর এই কাপড় তৈরি করতে যে পরিমাণ তুলা দরকার, তার ৯৭ শতাংশ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। মূলত ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসে এই তুলা।

তুলাচাষির সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
তুলাচাষির সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের রপ্তানি আয় এখন বছরে ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সেটি করতে সামনে বাংলাদেশ আরও বেশি তুলা আমদানি করতে হবে।

জানা যায়, বাংলাদেশের মোট কৃষিজমি সাড়ে ৮০ লাখ হেক্টর। তা দিয়ে বাংলাদেশ মূলত খাদ্য চাষ করে। এ দেশের মানুষ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে বস্ত্রশিল্প। দেশে প্রায় ৬০ ভাগ গার্মেন্টসকর্মী নারী।

জাতির এই বৃহৎ অংশের কথা মাথায় রেখে এই শিল্পের স্থায়ী উন্নতির কথা ভাবতে হবে। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) অনুসারে বর্তমান বস্ত্র খাতের ৩৮৩টি সুতাকলের জন্য বিদেশ থেকে সুতা আমদানি করতে হয়। এতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে, সুতার বর্তমান উৎপাদন দেশীয় চাহিদার প্রায় ৩ দশমিক ৬ ভাগ।

স্বাধীনতার পর শুধু তুলা উৎপাদনে অপ্রতুলতার কারণে দেশীয় বস্ত্রশিল্পে সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য এবং ভবিষ্যতে বস্ত্রশিল্পে পৃথিবীর বুকে অবস্থান সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত ইচ্ছায় ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড স্থাপিত হয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও তুলার উৎপাদন সেই অর্থে কাঙ্ক্ষিত অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি।

তুলার ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাংলাদেশের জেগে ওঠার এখনই সময়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য এলাকায় প্রান্তিক চাষিদের সহযোগিতা দিয়ে তুলা চাষ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আমার পরনির্ভরতা অনেকটা কমবে।