বিশ্বমানের এক বিদ্যাপীঠ

ন‍্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। ছবি: সংগৃহীত
ন‍্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবছর যখন সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং হয়, আমাদের দেশে তখন দুই-চার দিনের জন্য একটা সাড়া পড়ে যায়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কেন বিশ্বমানের বিদ্যাপীঠের তালিকায় থাকে না, সেটা নিয়ে কানাঘুষা চলে। ক্ষোভে ও খেদে অনেকে এসব তালিকাকে ফালতু মনে করে।

অনেক তরুণ মনে করেন, সারা জীবন যে প্রতিষ্ঠানের হাজারো সুনাম শুনে এলাম, আজ সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানে নেই—কী করে সম্ভব! যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালান, তাঁরা নানানভাবে ব‍্যর্থতা ঢাকার জন্য সস্তা কথা বলতে থাকেন।

যেমন, তালিকায় থাকতে হলে টাকা দিতে হয়। আমাদের সেই টাকা নেই। তালিকায় থাকতে হলে তথ্য পাঠাতে হয়। আমরা তথ্য পাঠাতে পারিনি। কেউ কেউ বলেন, তালিকায় থাকতে হলে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিত হয়। এমন সব আজগুবি বানোয়াট যাচ্ছেতাই কথা বলে সপ্তাহখানেক চলবে। তারপর যেই লাউ, সেই কদু!

বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং বিষয়টাকে আমরা মায়ের হাতের মোয়া মনে করি। আমাদের তরুণদের যেহেতু বিষয়গুলো সম্বন্ধে তেমন ধারণা দেওয়া হয় না, তাই তাঁরা ২২-২৪ বছর বয়সে বুঝতেও পারেন না যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের হতে হলে কত কত ক্রাইটেরিয়া (বৈশিষ্ট্য) থাকতে হয়।

দুনিয়ার যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই তালিকায় থাকে, তারা এমনি এমনি দিন কাটায় না। তাদের ক‍্যাম্পাসে দৌড়াদৌড়ি, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে না। তাদের ক‍্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্র ওলট পালট হয় না। তাদের ক‍্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ঝোলে না। তাদের ক‍্যাম্পাসে নেতার স্লোগান থাকে না।

একটা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের হওয়াটা নানার কাছে আবদার নয় যে, চাইলেই পাওয়া যাবে। বাঙালির একটা ধারণা আছে, টাকা থাকলে বাঘের চোখ পাওয়া যায়। সুতরাং টাকা দিলে অখ্যাত কোনো একটি বিশ্ববিদ‍্যালয়কেও বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে স্থান দেওয়া যেত।

একটা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের কিনা, সেটার জন্য বেশ কিছু বিষয় আমলে নেওয়া হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষকদের যোগ্যতা, তাঁদের গবেষণার মান, বছরে পাবলিকেশনের সংখ্যা ও মান (কোয়ান্টিটি অ্যান্ড কোয়ালিটি), আন্তর্জাতিকভাবে সেই পাবলিকেশনগুলো কতটা পরিচিত (কী পরিমাণ সাইট করা হয়), অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণার কোলাবোরেশন ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ইত‍্যাদি।

বিশ্বের প্রথম চার-পাঁচ শ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় থাকা যে কত কঠিন বিষয়, সেই ধারণা আমাদের তরুণদের নেই। কারণ, তাঁদের সেই ধারণটা দেওয়া হয় না।

চীনের বেইজিং ও সিনহুয়া ইউনিভার্সিটি হলো সে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় কী মানের গবেষণা করে, সেটা গবেষণার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরাই ভালো জানেন। টাইমস হায়ার এডুকেশনের জরিপে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবার বিশ্বের ২৩তম প্রতিষ্ঠান হয়েছে। গবেষণায় তাদের স্কোর ১০০–তে ৯৪! সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কেউ শিক্ষকতায় ঢুকতে চান, তাহলে তাঁকে হতে হয় ১৫০ কোটি মানুষের দেশের অন্যতম মেধাবী!

লেখক
লেখক

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাজার মেধাবী প্রকল্পের মাধ‍্যমে চীনের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলোকে সেখানে শিক্ষক হিসেবে ঢোকায়। কেউ যদি এমআইটি, অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড থেকেও পিএইচডি-পোস্টডক করে যান, তাহলেও যে সেখানে শিক্ষক হিসেবে ঢুকতে পারবেন, সে গ‍্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। কারণ, শুধু বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিই যথেষ্ট নয়, থাকতে হবে বিশ্বসেরা জার্নালে পাবলিকেশন। থাকতে হবে যুগ পাল্টানো গবেষণার ধারণা ও প্রস্তাবনা (Concept and Proposal)।

ইউনিভার্সিটি অব ক‍্যালগেরি কানাডার খুব নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ সে প্রতিষ্ঠানটির তালিকা হলো ২০১-২৫০–এর মধ্যে। অর্থাৎ এত এত ভালো ও নামকরা প্রতিষ্ঠান আছে যে, দুই শর পর তালিকাটা একটা রেঞ্জে দেওয়া হয়। একটা ক্লাসে যদি পাঁচ শ স্টুডেন্ট থাকে, তাহলে রোল নম্বর ১-১০–এর পর, বাকিদের মেধা যাচাইয়ে বলা হয়, প্রথম কুড়িতে কারা আছ। তারপরের কুড়িতে কারা আছ। বিষয়টা এমন!

যে প্রতিষ্ঠানটি তালিকায় দশম, তার সঙ্গে তালিকার কুড়িতম প্রতিষ্ঠানের হয়তো তেমন পার্থক্য নেই। কিন্তু যেটা ১০০তম সেটার সঙ্গে পার্থক্য আছে। এই র‍্যাঙ্কিংটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওভার অল একটা তালিকা। এটা ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক বা ফ‍্যাকাল্টিভিত্তিক একটা র‍্যাঙ্ক থাকে। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো ওভার অল তালিকায় ১০০তম, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের বায়োকেমিস্ট্রির রিসার্চ দুনিয়াতে খুব নামকরা। কেউ যেমন ক্লাসে দশম স্থান অর্জন করেও, ভূগোলে সর্বোচ্চ নম্বর পেতে পারে, বিষয়টা তেমনই।

আমার হাতে যদি আলাদিনের চেরাগ থাকত, তাহলে আমি দেশের ছেলেমেয়েদের পৃথিবীর ৫০০তম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতাম। ৫০০তম প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, শিক্ষার মান, গভীরতা, জ্ঞানমুখর পরিবেশ দেখে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিস্মিত হতো। তাহলে তারা ধারণা করতে পারত, দুনিয়ায় কত কত সেরা সেরা বিদ‍্যাপীঠ খুলে রাখা হয়েছে।

বিশ্বমানের একটা বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা ও মান বজায় রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্বমানের অস্ত্র বানাতে পারলে কিংবা পারমাণবিক বোমা বানাতে পারলেই বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা যায় না। পাকিস্তান সম্ভবত তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ দুনিয়ার বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ সেটা পেরেছে। সিঙ্গাপুর পেরেছে। আমাদের দেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম জেলার সমান সে দেশ। অথচ সে দেশের ইউনিভার্সিটি, বিশ্ব তালিকায় ২৫তম স্থান করে নিয়েছে। কী লক্ষ‍্য তাদের!

বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠের জন‍্য বিশ্বমানের পরিকল্পনা লাগে। দায়সারা কথা বলে, নিজেদের ভুলগুলোকে না শুধরে যদি মান পরিবর্তনের জন‍্য উঠেপড়ে চেষ্টা না করা হয়, তাহলে পৃথিবীর কিছু আসে যায় না। যারা এগিয়ে যাওয়ার তারা যাচ্ছেই। কূপমণ্ডূকের মতো আবোল-তাবোল বলা যাবে, তাতে বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা যাবে না।
–––

ড. রউফুল আলম: রসায়ন গবেষক, যুক্তরাষ্ট্র। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/rauful 15>