এসো সখী ভালোবাসি

প্রতীকী ছবি। ছবি: আবদুস সালাম
প্রতীকী ছবি। ছবি: আবদুস সালাম

জীবনদর্শন-রহস্য আমাকে জাদুকরের মতো টানে। রহস্য খুঁজি...। নিজ রহস্যের আগাগোড়া শেষ করতে না পারার আগেই দেখি, সখীও রহস্যের গোলাঘর। রহস্যের কারণেই সখীকে আসতে বলেছি। আসতেই হবে, কোনো কথা নেই।

‘এসো সখী ভালোবাসি’ বাক্য সুন্দর। বলতে ভালো লাগে। অনুভূতি মজার। শুনতেও দারুণ। সখী এসে গেলে তো আরও দারুণ। সখীও যদি বলে, ‘এসো সখা ভালোবাসি।’ মন্দ যেমন হবে না, তেমনি জাতও যাবে না। আমাকেও যেতেই হবে, তা-ও না। আমি ভালোবাসি। সখীর আসা না-আসায় ভালোবাসা থেমে থাকে না। ভালোবাসা থেমে থাকার বস্তু নয়।

সুখের জন্য ভালোবাসলেও এর দুঃখকে এড়ানো যায় না। জীবন উপাত্তের দুঃখগুলোই জীবনের মৌলিক উপকরণ হিসেবে স্থান করে নেয়, যার অন্তস্থের জ্বালা পোহাতে গিয়ে দাবি করেই বলি, লীলাময় জীবনের এমন কোনো যন্ত্রণা নেই যা এ জীবনে পোহায়নি।

দুঃখের দরিয়া বেছে নিয়ে হাবুডুবু যা-ই খাই, প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে গেলে দেখি, আসলে লীলাখেলার কিছুই দেখিনি, দেখা অত সহজ নয়।

ভালোবাসা অনেক শেখালে বা দিলেও কম নেয় না। এটি জীবনের সহজ-সরল ও বিশেষ অংশ বলেই বেশি কাঁদায়। কেঁদে হলেও জয় নেয় বা নিতে চায়। কেঁদে না থাকলেতো ভালোবাসার ছোঁয়া লাগেনি, হতে পারে ছলনা। নির্বাসিত মনের ভালোবাসা ছলনা বোঝে না। অজুহাত খোঁজে না। হারানো কিংবা বেদনার তোয়াক্কাও করে না।

আমি ডেকেছি, সখী ডাকার আগেই শুনেছে। আমি কিছুই বলিনি, সখী সবই শুনেছে। আমি কাঁদিনি, সখী কান্নার অপেক্ষায় ছিল। কেঁদে ফেলেছি, বারণ আছে। বারণীয় দুঃখগুলোই জনম জনম চেনা প্রেমের দায়ে সখীর গলার মালা হতে চায়। এ মালা সহজে কেউ নেয় না, নেওয়ার কথাও না। সখীও তা পারেনি। সে মাত্রা অতিরিক্ত টাইট দিতে গিয়ে রহস্যে গাঁথা মালা ছিঁড়ে ফেলেছে। মালা ফিরে পেতে গিয়ে হয়েছে আহত, দেখেছে জল, কান্নাজল। এই অনাগত জল মুছে দেওয়ার দায়ভার বড় কঠিন।

জীবন স্বাধীনতার রুচিবোধগুলোও কোনো কাঠিন্যকে সহজে মানে না। মানতে চায় না। অবাধ্য দোষকে বাধ্যতার দায় দেখিয়ে লাভ নেই। জীবন-রহস্যের আনন্দে অত দোষ খুঁজলে চলে না। মনমতো সব প্রেমিক-প্রেমিকাই চায়, একে অপরের মায়াজালে একটু হলেও কাঁদুক। কান্না প্রেমকে ছাড়েনি। প্রেমও কান্না ছাড়েনি। এ ব্যাধি কাউকেই ছাড়ে না। সখীকেও না, আমাকেও না। সখী এ ব্যাধিতে বারবার মরেছে। মরেও প্রমাণ করতে চেয়েছে, ব্যাধির কোনো লক্ষণই তার মাঝে নেই।

ভালোবাসার আছে বিধান। বিধানে না পড়লে লোকে একে কলঙ্ক বলে ঘোষণা দেন। মানুষের ভালোবাসায় কলঙ্কের নিবিড় বসবাস আছে, থাকে। সমাজ কলঙ্কের বাড়িঘর। প্রকৃতির ভালোবাসা নিষ্কলঙ্ক, চির অম্লান। টিকে আছে, থাকবে চিরদিন।

জগৎ টিকে না থাকলে কেউ টিকবে না। সখীও না আমিও না। টিকে থাকলেই সখীকে ডাকি। সখীরও তো আমাকে দরকার আছে। এড়াতে চাইলেই তো সবকিছু এড়ানো যায় না। প্রকৃতিসিদ্ধ ভালোবাসার মুগ্ধ আনন্দ একে অপরকে আকর্ষণ করে। পরস্পর জীবনে এ আনন্দ প্রত্যেক মানুষের। সৃষ্টিজগতের। এতে কেউ আবার খুঁজে নেয় পরমানন্দ।

সুখ-দুঃখ প্রাকৃতিক। সখা মায়ের কোলে থাকতেই বেদনার্তের বহু মরণ দেখেছে। সখীও জানে, হাসিতে হাসিতে মরণ দেখার শিশুসুলভ আচরণ সখার মাঝে এখনো আছে। থাকতেই পারে। এ অদ্ভুত আচরণ তৎপর হলে আজও সে হাসিতেই মরণ দেখবে। সখী এ মরণ দেখে থাকলেও ভুলে গেছে। আরও ভুলে গেছে, সফল হতে পারা না পারা জীবনকে যে রংই দিক, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই।

অসাধ্য না থাকলেও জীবনের জ্বালা পরিপূর্ণ নেভে না। নেভানো যায় না। সম্ভব নয়। নেভানেওয়ালা যত সহজে জ্বালায়, তত সহজে নেভায় না। তিনি জ্বালা দিয়ে অগোচরে দেখেন। কারও জ্বালায় সিরিয়াস হন না। কারও সুখেও মাথা ঘামান না। কোনো কিছুতে সিরিয়াস হওয়া তাঁর পছন্দ নয়। যদি হন, খবর আছে। অপরাধী সেদিন নিজ অপকর্মের সব পরিণতির কথা মুখ খুলে বলতে না পারলেও প্রায়শ্চিত্ত অন্তর থেকেই মেনে নেয়। নিতে হয়।

সখীর ব্যথাকে নিজের মনে করে প্রায়ই মরি। মরি বলেই তার অনবরত প্রশংসা চালাই। বারংবার প্রশংসা চালিয়ে তাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছি। সখীর পা এখন মাটি ছোঁয় না। অবশ্য মিথ্যে প্রশংসাও করিনি। করতে পারিনি। আমার প্রশংসা করা না-করায় সখীর কিছু যায়-আসে না। সত্যের প্রশংসা না করলেও তার একটু সৌন্দর্য কমবে না। কমাতে পারব না। ভাটা ধরে বসলে সৌন্দর্য রবেও না। প্রশংসাকারী নিজেই সখীর স্লোগান দেয়, সঙ্গে আমাকে রাখে সখার খাতায়। আমি তাল মেলাতে গিয়ে অনুরাগের অনলে সাধি, সাধিয়া মরি, মরিয়া ঘুরি। অতিরঞ্জিত হয়ে গেলে হই বেশরম ও বেমানান। যা-ই হই, সব কটুবাক্য গায়ে মেখেও বলি, সখীর প্রশংসা না করার চেয়ে করাই উত্তম, অতি উত্তম।

ভালোবাসার সংসর্গে লিখতে যত আগ্রহী, ভালোবাসতে তত আগ্রহী নই। প্রকৃতিহীন অবুঝ মনের অশান্ত ও অন্ধ ভালোবাসার অভিজ্ঞতা জীবনকে যা দিয়েছে, লোভ-লালসা এসে তার চেয়েও বেশি নিয়েছে। লিপ্সাহীন জীবন উপলব্ধির প্রকৃত সত্য ও শেষ সম্বল এই সামান্য ভালোবাসাটুকুর হিসাব কষলে খুঁজে পাই, প্রকৃতিকৃত বিরহ-বেদনাগুলো আমার প্রতি বেশ আগ্রহী। যেকোনো মূল্যেই হোক, বিরহ আমাকে ক্ষণিকের জন্যও ছেড়ে যেতে চায় না। সে আমাকে সখীর চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাই তো সে সখীকে আমার কাছে আসতে দেওয়ার চেয়ে দূরেই বেশি ঠেলে দেয়। শত দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও বিরহ এসে নিজের গৌরবান্বিত ভূমিকা রক্ষার্থে মৃদুস্বরে আমার কানে কানে বলে, ওই নষ্টের দল যদি পৃথিবীকে লুটপাট করে খেয়ে গেল, আমি বিরহের এমন কী নেই যে ভালোবাসার বড় সম্বল হতে পারব না?

আমি বিরহের মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে বাকরুদ্ধ হলেও তাকে আমার প্রতি স্বাগত জানিয়েছি। চিত্তানন্দে বলেছি, তোমার জন্য আমার হৃদয়ের সব কপাট চিরতরে খোলা। সর্বদাই আসতে থাক। কোনো দিনই আমাকে ছেড়ে যেও না। শুধু রহস্যভেদ ভালোবাসার মরণে বিরহের অবাধ্য পথে হাঁটার চেষ্টায় মাঝেমধ্যেই বলি, ‘এসো সখী ভালোবাসি’।

কত বসন্ত পার হয়ে গেল শান্তির বার্তা কেউ নিয়ে আসেনি। শান্তির ডাক শুনিনি। শান্তির জবাবও মেলেনি। তাতে কী হয়েছে। শান্তি তো আর মরে যায়নি। একে নিতে জানলে ঠেকায় কে। ওই অন্ধবাদী আর অবাধ্যের দল যতই সত্য ও শান্তির গলা টিপে ধরুক, তাকে বুঝতে পারা জরুরি। সত্য ও শান্তির জন্ম-মৃত্যুর জন্য হয়নি। অবশ্য মিথ্যে ও অশান্তিও জগৎ ছেড়ে পালায়নি। সরল পথেই আলোর গমন খুঁজে বের করা যেত না অন্ধকার না থাকলে।

ভালোবাসা ভালো। লিখতে লাগে আরও ভালো। ভালো বলেই যে সবাই সাধুবাদ দেবে, তা কিন্তু নয়। বিপক্ষেও বলবে। সমাজের লোক ভালোবাসার পক্ষ-বিপক্ষ শেষ করতে পারেনি। শেষ করার মতোও না।

আমি ভাবাবেগে বলেছি, এসো সখী ভালোবাসি। সখী এর ধার-ধারি না-ও হতে পারে। হবেই বা কেন? সখী তো ভালোবাসা নিয়ে বসে নেই। ভালোবাসা নিয়ে কেউ বসে থাকে না। অযথা বসে থাকা বোকামি ও অপ্রীতিকর। অবশ্যই দিয়ে দিতে হয়। আমিও তো সখীর জন্য বসে নেই। দিয়ে দিয়েছি। দিতেই হয়।

সখীর উচিত সব ভালোবাসা তার প্রকৃতিকে দেওয়া। যথা-তথা দিলে অমর্যাদা হয়। হতেই পারে। হতভাগা ও বিচ্ছেদ প্রেমিক; শিল্পী ও গীতিকার ফকির সাহাবুদ্দিন লিখেছেন, ‘...সখীগো, পিরিত করা তারই সাজে, যে পিরিতের মর্ম বোঝে, নইলে পিরিত ভীষণ যন্ত্রণা...।’

যন্ত্রণার পরেও শুনি, কারও কলিজায় দাগ লেগেছে। কেউ ভিখারি সেজেছে। কেউ আবার জীবনকে প্রেমের ফাগুন দিতে গিয়ে বুকভরা আগুনে পুড়েও বলেছে, ‘এসো সখী ভালোবাসি।’

সবাই সবকিছুর মর্ম বোঝে না। কেউ আবার বুঝেও যত্ন করে না বা নেয় না। আমার দশাও তাই। না বুঝেই ভালোবাসি। যিনি ভালোবাসা দেন, তিনি জ্বালাও দেন। দেনেওয়ালাকে পেতেই বড় বেশি জ্বালা। এত জ্বালা অন্য কোথাও নেই, থাকে না।

প্রকৃতিকে ভালোবাসা সহজ হলেও এতে জ্বলেপুড়ে মরার আনন্দ নিতে পারা কঠিন। আসলেই কঠিন। সবাই পারে না। যে পেরেছে সে দুঃখেই আনন্দে কাটিয়েছে। সীতার ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না। তবুও পতি বারবার বনবাস গিয়েছিল। প্রেমের বৈরাগী আরও পেলেও বনবাসে যায়। যেতেই পারে। প্রেম পবিত্র। পবিত্রতা রক্ষা করা আরও পবিত্র ও নৈতিক দায়িত্ব।