যে সুর ভাসিয়ে নেয় সেই সব দিনে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শৈশবের কীর্তন এখনো বাজে অন্তরে।

‘গুপ্ত আনন্দ ধর্মের মেলা। সে যে নিত্যং দেব দুর্লভং তোরা দেখবি তো আয় এই বেলা।।’

আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় একটা কীর্তন।

ভাঙা কীর্তন রাগে ও দাদরা তালে গাওষুণ মল্লিকার গান—‘যমুনে এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিনী। ওদের বিমল বাটে রূপের হাটে বিকাতো নীলকান্তমনি।’

এখনো যে রোজ গাই, সময়ে-অসময়ে। মনের আনন্দ ও বিষাদে।

তখন আমার এইচএসসির সময়। আমি ছিলাম পড়াচোর। যাকে অমনোযোগী বলে। আব্বা আমাকে ঠায় এক আসনে বসে থাকার জন্য এমন ব্যবস্থা করলেন যে সেটাই হলো আমার কাছে আনন্দধাম।

এই আসরে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল আমার বাল্যবন্ধু সুরাইয়া।

তো যে কথা সেটাই বলছি। এইচএসসি দুবছর। কেউ কেউ রাকিবুল স্যার, শাহাদত স্যার, জলিল স্যারের প্রাইভেট টিউশন নিতে যায় আলাদা আলাদা সাবজেক্টে। কিন্তু আমি আর সুরাইয়া লুনা খালাম্মা (বান্ধবী আমার, সারা জীবন খালাম্মা ডেকেই আসছি, জানি না কেন, হতে পারে ওর শুনতে ভালো লাগত আর আমার ডাকতে) এক স্যারের কাছেই আছে এমন পুষ্টিগুণ সব সাবজেক্টের।

তাঁর কাছেই যাওয়া শুরু হলো। তিনি ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানের স্যার। কিন্তু বিশ্বাস করুন সব সাবজেক্ট এমন নিপুণভাবে পড়ানোর দক্ষতা ছিল, কী আর বলছি! গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর শক্তি ছিল তাঁর মাঝে অপার।

স্যারের কথা বলা স্পষ্ট নয়। জিবের কী যেন সমস্যা। তাই স্যার কথা বলতেন খুব কম। স্যারের রোজকার কাজ ছিল হাজার ধরনের চিরকুট প্রশ্ন বানানো। তিনি অনেক শিক্ষার্থীকে পড়াতেন। হাইস্কুলের স্টুডেন্ট থেকে কলেজ।

মজার ঘটনা, স্যারের পুরো বাড়িতেই শিক্ষার্থী বসার ব্যবস্থা ছিল। শুধু তাঁর শোয়ার ঘরের বিছানাটা ছাড়া। সব্বাই বলত এত টাকা করবে কী লোকটা! আসলে তিনি টাকালোভী ছিলেন না। তিনি পড়াতে ভালো বাসতেন। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল, এত এত শিক্ষার্থীর এত এত প্রশ্ন চিরকুট তিনি কী করে মেনটেইন করতেন, আল্লাহ মালুম।

কোন ছাত্রের কোন বিষয় কম জানা, সেটা তিনি তেমন করেই তৈরি করতেন, তার জন্য।

সারা সময় বাইরের বারান্দা, ভেতরের ঘর, ঠাকুরঘর, ভেতর বারান্দা, বউদির মেশিন বারান্দা, চরকির মতো ঘুরতেন।

স্যার আমাকে আদর করতেন খুব। সকালে পড়তে গেলে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বাসায় আসতে দিতেন না। বলতেন এটা করো, যাও ভেতরবাড়ি গান শোনো, বউদির সঙ্গে গল্প করে আবার পড়তে বসো। এত খাতিরের জন্য এক্সট্রা টাকাও নিতেন না, ২০০ টাকা সাবজেক্ট হিসেবে তিন সাবজেক্ট ৬০০। ওটাই সই। কিন্তু আমাকে বাংলা, জীববিজ্ঞান, সবই তো পড়াতেন।

আসলে আমাদের কলেজে রাজনীতি করার একটা আলাদা মজা ছিল। আমার পাড়াতো ভাই ইগলু ভাই, তিনি বিএনপি করতেন। সকাল-বিকেল রাস্তায় দেখা হলেই আমাদের বলতেন, ওই তোমরা কলেজে যাও না কেন, মিছিলে যেন পাই।

অন্যদিকে, ওনার বন্ধু আমাদের গ্রামের ভাই খালিদ, তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। ইগলু ভাইয়ের জোর দাবি, তোমরা আমার পাড়ার মানুষ আমার দলেই থাকবে।

লে হালুয়া, আমরা হলাম ছিপের টোপ।

আমি তখন রাজনীতি বুঝি না। আমার কাছের লুনা খালাম্মা সুরাইয়া আরও অন্য বন্ধুরা যায়। বিএনপির মিছিলে আমাকে টান মেরে নিয়ে যায়।

আর আওয়ামী লীগে আমাদের কিছু বন্ধু ছিল। মুক্তা, নাদিম, মাখন, ভীষণ দুষ্ট, তবে বন্ধুদের সঙ্গে কখনো বাজে আচরণ করত না, শুনেছি অন্যদের সঙ্গে করত, মারামারিতে পটু। তবে সাহসী বলে বাহবা পেত সব সময়। তাই ওই দলটা নয়, ওদের অ্যাভয়েট করতেই যেতাম না।

কিন্তু আমার আব্বার পইপই করা সতর্কবাণী, ‘মা, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ, তুমি যেন বিএনপির মিছিলে না যাও।’

পড়ে গেলাম মহা মুশকিলে, কলেজে যাওয়াই বাদ।

ভোটের সময় এক অন্য রকম আমেজ...পুরো কলেজ গমগম করে প্রথম ক্লাসের পরেই, স্লোগানে স্লোগানে।

থ্রিলই আলাদা!

ভোটারদের কদর যেন সিকি থেকে টাকায় উঠে যায়।

সাতমিশালির দোকান ফ্রি, বাদাম ফ্রি, কোকাকোলা, আমড়া, আচার, সব ফ্রি।

তারপর আরও একটা মজার ব্যাপার ছিল ব্যান্ড পার্টির গান। ডিফারেন্টটাচ, মাইলস, অবসকিউর, পাল্লা দিয়ে এদের নিয়ে আসা, আহা এখনো যেন কলেজ মাঠের সেই সুর কানে ঝুলে আছে। ‘সূচনা কেমন আছ, কোথায় আছ জানি না...’। কিংবা ‘ফাগুনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে...’ এমন অনেক জনপ্রিয় গান।

যে মানুষ কথা বলে না,সেও যেচে কথা বলতে আসে...কেমন আছি, এই সেই বলে মহা খাতির।

তবে এই সময়টাতে অন্য কলেজ থেকে আসত ভলান্টিয়ার ওয়ার্কার, ভোটের প্রচারণা করতে।

শহরের পাংকু পোলাপাইনের মাঝে দু-একটা সুবোধও থাকত। একটুকু ছোঁয়া লাগা ব্যাপারটা তখন মনে মনে গান গাইত প্রজাপতির মতো।

গল্প হতো বান্ধবীদের সঙ্গে, ‘বলত, ওই পাখিটা কোন কলেজ থেকে আসছে, এমন খবরগুলো বন্ধুরা দিত, কোনো কোনো বন্ধু তেতিয়ে উঠত, এত খবরের দরকার কী।’

ভোটের জন্য গ্রামের পথে, শহরের পথে হেঁটে হেঁটে প্রচারণা করতে গিয়ে, গ্রামের ফল-ফুলের বাগান সাফ করার মজাই আলাদা।

এত সব মজার বায়োস্কোপ ছেড়ে কার ভালো লাগে বলুন ২৪ ঘণ্টার নন্দী স্যার প্রজেক্ট। চিরকুটের পর চিরকুটের প্রশ্ন সলভ করা!

উপায় নেই গোলাম হোসেন! এমনিতে গ্রামের কলেজ। সামনে ইউনি, মেডিকেল কিংবা বুয়েটের অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। এখনই সময় রেজাল্ট করার। ভালো না হলে জীবনের রেললাইনের সঙ্গে স্বপ্নের সমান্তরাল আর হবে না।

যাক ফাঁকি ঝাঁকির মাঝে ভোটের মজা নেওয়া, মুফতের বাদাম চিবিয়ে আবার নন্দী স্যারের পাঠশালায় বসা।

এমন করতে করতে একসময় এমন হলো, অভ্যাস হয়ে গেল, সক্কালে সেই কাকডাকা ভোরে, ব্যাগে খাবার ভরে নিয়ে চারটা বাইন্ডিং খাতা নিয়ে ব্যস চলে আসা। ফিরতাম সেই পাঁচটায়।

প্রথমে সকালে যখন পড়ার রুমে ঢুকতাম ইশ্‌! কাঁচা গোবর দিয়ে ঘর লেপে বউদি জাস্ট স্নান করে তুলসীতলায় পুজো দিতে গেছেন। কখনো দেওয়া শেষ করেছেন।

পুরো বাড়ি লেপতেন উনি। পুরো বাড়িতেই গোবরের গন্ধ। প্রথম প্রথম এত গা গুলিয়ে যেত...দু-একবার বমি পর্যন্ত করেছি। পরে আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে গিয়েছিল। গোবরের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন গানে পুরো বাড়ির পরিবেশ যেন মন্দির হয়ে যেত।

অনেক কণ্ঠে যখন শুনতাম একসঙ্গে...‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।’ আমরা মনের অজান্তে গাইতে থাকতাম আর মাথা ঝাঁকাতাম। সেই থেকে আমার ভেতরে কীর্তনের সুরটা বসে গেল। মনে পড়ে ন্যাশনাল ব্রান্ডের ছোট একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বারান্দার জলচৌকিতে রেখে লাউড বাজত কীর্তনগুলো। প্রায় এক ঘণ্টা। ততক্ষণে ছাত্রছাত্রী দিয়ে ভরে যেত।

১০টা থেকে কমতে শুরু করত কলেজ সময়ে। তারপর আবার তিনটার পর থেকে আসা শুরু হতো। মাঝের সময়ে স্যারের প্রিয় গাধা ছাত্রছাত্রীরা স্যারের এক্সট্রা কেয়ার পেত। কার কী সমস্যা, স্যার সেটা মন দিয়ে শুনতেন, পাশে বসে বুঝিয়ে দিতেন।

স্যারের একটা মাত্র সন্তান। সে থাকত কলকাতায় তার মামার বাসায়। রিপন নাম ছিল। সুযোগ পেলেই স্যার বউদি ছেলের গুণকীর্তন করতেন।

বউদি জানতেন নিপুণ হাতের কাজ...এটা-সেটা নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত। আশপাশের দু-একজন নারী আসতেন গল্প করতে মাঝেমধ্যে।

তা ছাড়া তিনি ব্যস্ত থাকতেন সেলাই-ফোঁড়াই আর সবজিবাগান নিয়েই।

ধীরে ধীরে বউদির সঙ্গে খুব ভাব হলো। তিনি সেলাই, হাতের কাজ, শীতলপাটি বোনা, চটের ওপরে কাজ করতে শেখাতেন। যাদের আগ্রহ আছে, তারাই দুপুরে যে সময়টা স্যার একটু শট ন্যাপ নিতেন, সেই সময় বউদির স্কুল খুলে যেত। অনেক কিছু শিখেছি আমি ওনার কাছে।

বউদি আমার ড্রেস বানিয়ে দিতেন। রোজ রোজ নতুন ডিজাইন দেখাতেন পত্রিকা থেকে। লোভ দেখাতেন। বলতেন, এমন বানালে বড্ড সুন্দর লাগবে দেখতে। আমি ও সুরাইয়া বাসায় গিয়েই...বাক্সের দরজা খুলে পুরোনো ওল্ড মডেলের শাড়ি দেখা শুরু করতাম। কখনো আমার মায়ের তো কখনো ওর মায়ের।

একই রকম ড্রেস বানিয়ে দিতেন বউদি। আমরা ফ্যাশন করতাম। বউদির স্কুলজীবন কেটেছে কলকাতায়। বেথুনের ছাত্রী ছিলেন। কত যে গল্প। ওনার ক্রাশ খাওয়া মেলা গল্প। বেশ মজা দিয়ে বলতেন। বউদির গল্পেই আমি কলকাতা কতবার ঘুরে এসেছি! শেওড়াফুলি, দমদম, বেহালা, খেয়েছি কচুরি আলুর দম, লম্বা লম্বা ল্যাংচা!

বর্ণনাগুলো ছিল অনন্য। এখনো দৃশ্যপটে জ্বল জ্বল করে ওঠে। আমার সঙ্গে বউদির একটা অন্তরের সম্পর্ক গড়ে উঠল। বউদি বছরে একবার কলকাতায় যান। এক মাসের জন্য স্যার দিয়ে আসেন। বউদির চলে যাওয়ার পর স্যারের রান্না স্যার একাই করতেন! তিনি ফুল ভেজিটেরিয়ান ছিলেন।

বউদি চলে যাওয়ার প্রায় মাসের কাছাকাছি।

একদিন সকালে একটু আগেই চলে গিয়েছি আমরা। দরজায় নক করছি। স্যার দরজাই খুলছেন না।

পরে প্রাচীর টপকে ভেতরে গেলাম। এই কাজটা আমি খুব ভালো পারি। ভেতরে গিয়ে দেখি সুনসান কোনো রকম সাড়াশব্দ নেই। স্যারের বেডরুমে গিয়ে ডাকলাম আমরা, স্যার...স্যার...স্যার।

অনেকক্ষণ পর ওহ! একটা শব্দ পেলাম।

দরজা খুলতেই দেখি স্যারের চোখমুখ ফুলে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না টলছেন। স্যারকে ধরে আমরা বিছানায় শুইয়ে কেউ মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি, তো কেউ স্যারের অগোছালো রুম ক্লিন করছি। স্যার ভীষণ অপ্রস্তুত। বারবার বলছেন, আমি ঠিক হয়ে যাব।

স্যার শুধু দুধ খেয়ে আছেন নাকি, দুদিন ধরে।

ঘরের ছিরি বলতে নেই। কলার কাঁদিতে কলা শুকিয়ে গেছে। দুটো তেলাপোকা নাক ডুবিয়ে আছে, দুধের পাতিলের ঢাকনা ফাঁকা করে একটা তেলাপোকা দেখতে গিয়ে দুধের সাগরে পড়ে মরেছে।

কী যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বলে বোঝাবার নয়, না দেখা অবধি। এমন পরিবেশে যেকোনো সুস্থ মানুষ অসুস্থ হতে বাধ্য।

আমরা তিন সৈনিক লেগে গেলাম স্যারের সেবা করতে। কেউ বলছি গোসল করালে ভালো, কেউ বলছি শরীর মোছালে। স্যার বেচারা বালিশের সঙ্গে লেপ্টে আছেন।

এরই মধ্যে অন্য শিক্ষার্থীরা আসছে। কেউ শুনেই ফিরে যাচ্ছে, কেউবা স্যারের মাথায় জ্বরের প্রকোপ নিজ হাতে দেখছে। থার্মোমিটার ফিট করে আন্দাজে বলছে, মনে তো হচ্ছে ১০২-৩ জ্বর, বাপ রে!

স্যারের বাড়িঘর পরিষ্কার, স্যারের খাবার রান্না থেকে সবকিছু আমরা করে দিলাম। আমাদের সঙ্গে অনেকেই যোগ দিল পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে।

স্যারের মাথায় টাইগার বাম লাগিয়ে দিতে যাব, এমন সময় ক্যাসেটে চোখ পড়তেই মনে হলো, একটু বাজিয়ে দিই, গান শুনতে শুনতে নাহয় মাথায় লাগিয়ে দেওয়া যাবে। সুরাইয়া সাগুদানা রাঁধছে।

মিউজিক সিস্টেমটাতে সুইচ দিতেই...এক মাস গত হয়ে যাওয়া সেই ফিতার অর্ধেক কীর্তন বাজার পর বাকিটুকু বাজতে শুরু হলো...ভয় পাচ্ছিলাম স্যার বকা দেয় যদি। এমনিতেই স্যারের মাথায় যন্ত্রণা তারপর, এই ঘেংসীটানা কীর্তন! কিন্তু না, স্যার বেশ এনজয় করছেন, পায়ের বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছেন, বুঝলাম প্রাতক্রিয়ার মতো এই কীর্তন শোনা ও গোবর দিয়ে পুরো বাড়ি লেপার পর সোঁদা গন্ধ নিশ্চয় স্যার মিস করছেন।

আমরা সব্বাই মুখ টিপে হাসি। সত্যি যেই চিন্তা ওই কাজ...স্যার কিছুক্ষণের মধ্যে বিছানা থেকে উঠে বসলেন, লাল চা পান করলেন, একটু পর বলতে শুরু করলেন, চলো পড়তে বসি।

আমার ভালো লাগছে এখন। স্যার সত্যি সুস্থ হয়ে উঠলেন। আমরা বুঝলাম পরিবেশ...অভ্যাস থেকে সরে গেলে মানুষ এমন করে এলোমেলো হয়ে যায়।

তারপর বউদির ফিরে আসা অবধি আমরা সকালে গিয়ে আগে কীর্তন ছেড়ে...কেউ ঘর ঝাড়ু দিয়ে দিই, কেউ পড়ার টেবিলের ধুলো ঝেড়ে দিই, কেউ স্যারের জন্য চা বানিয়ে দিই।

আর গাইতে থাকি—‘যমুনে এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিনী। ওদের বিমল বাটে রূপের হাটে বিকাতো নীলকান্তমণি।’

মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে স্যার গুনগুন করে গাইতে গাইতে আমাদের যার যা চিরকুট তার আসনে দিয়ে চলে যেতেন।

এমনি করে আমার এইচএসসি পরীক্ষার আর বাকি মাত্র তিন মাস। স্যার বলে দিলেন, বাবা, এখন বাসায় পড়বে, সব সাজেশন দেওয়া শেষ। এখন শুধু পড়া। বন্ধ হলো রোজকার আসা-যাওয়া।

কিন্তু সমস্যায় পড়লাম বিরাট। সকালে উঠেই মনে হয় গোবরের গন্ধ মিস করছি, কীর্তন, কেমন যেন মন বসে না পড়ায়।

সুরাইয়াকে জিজ্ঞেস করছি, তোর কি কিছু হয়েছে?

সে বলে না! পরীক্ষার টেনশনে বাঁচি না আর তুই আছিস গোবর আর কীর্তন। যা পড়। বুঝতে পারছি না কী হলো আমার, কেন মন বসে না পড়ায়।

তিন–চার দিন পর আব্বাকে বললাম, আব্বা, স্যারের বাড়ি গিয়ে বউদিকে বলো তো আমি একটা ক্যাসেট চেয়েছি।

আব্বা সেদিন বিকেলে ক্যাসেট নিয়ে ফিরলেন।

পরদিন আম্মাকে বললাম, আম্মা, আমাদের উঠানটা গোবর দিয়ে লেপা যায় না?

আম্মা বললেন, যায় তো। কে এগুলো ঝামেলা করবে শুনি। আমাদের বাসার সাহায্যকারী মেয়েটাকে বললাম...রাশেদা, তুই কাল গোবর–পানি দিয়ে সক্কালে উঠেই লেপে দিবি। ও বলে, আপনার কি মাথা খারাপ হইছে আপা। শীতের সময় সকালে ঘর লেপলে আমি ঠান্ডায় মরে যাব।

কিন্তু আমি ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় এসে দেখি ও লেপতে শুরু করেছে। সেই চেনা গন্ধ ফিরে পেলাম।

দৌড়ে গিয়ে ক্যাসেট অন করলাম...বেজে উঠল সেই চেনা সুর...।

লেখিকা
লেখিকা

‘যমুনে এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিনী। ও যার, বিমল তটে রূপের হাটে বিকাতে নীলকান্তমণি॥ কোথা সে ব্রজের শোভা, গোলক হ’তেও মনোলোভা, কোথা শ্রীদাম বলরাম বল সুদাম কোথা সে মুনীল তমুর ধেনু বেণু, মা যশোদা রোহিণী কোথা নন্দ উপনদ, মা যশোদার প্রাণগোবিন্দ, সারে রোগ শোক জয়॥’

আহা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। রোজ শুনি আমি আর পড়তে বসি। শুনতে শুনতে আব্বাও গেয়ে ওঠেন। আহা, আহা বলে চটক দেন।

সেই থেকে আমি কীর্তনের ভক্ত হয়ে গেলাম।

সেই অভ্যাস এখন ততটা প্রকট নয় যদিও, কিন্তু আমি কীর্তনের সুর শুনলেই থমকে যাই, লীন হয়ে যাই।

কত কত কীর্তনের তরজমা সংগ্রহ করে পড়তাম, বুঝতে চাইতাম সারাংশ। যেমন এই কীর্তনটা...।

দুর্গ নামে রয় না জীবের ভয় ভাবন। ভয় ভাবন স্বম যাতন রঘুনা ও নাম গাও রসন।
নদী বলে—আমার শস্তু যেন রজতগিরি।
জয় বলে—আমার মুবর্ণবল্লরী, রূপে জগৎ আলো॥
সঙ্গী বলে—আমার প্রভুর শিরে কালফণী,
জয় বলে—মা’র নূপুরে ফণীর মাথার মণি,
নন্দী বলে—আমারশিবের ভস্ম গায়ে মাখা।
জয় বলে—পাবে বলে আমার মায়ের দেখা, ভোলা তাই উদাসী॥
নদী বলে—শোভা পঞ্চবদনমণ্ডলে।
জয় বলে—দুর্গা নামের গুণ গাইবে বলে, পাগল পঞ্চানন॥
নদী বলে—আমার প্রভু জগতের পতি।
জয় বলে—জগৎপতির মা, আমার প্রস্থতি, অদ্যা শক্তি যে মা॥
নদী বলে—রুদ্র আমার মহাত্রিশূলধারী।
জয় বলে—ধরবে বলে মায়ের কাশী পুরী, নৈলে থাকবে কোথা॥
লক্ষ্মী বলে—আমার প্রভু সংসার-সংহারে।
নদী বলে—শ্রীমার শিবের কুবের ভাঙারি।
জয়া বলে—স্বারেতে সেই শিব ভিখারী, অন্নপূর্ণ যে মা॥
নদী বলে—আমার শস্তু গরল খেয়েছিল।
জয় বলে—দুর্গ—নামের গুণে বেঁচে গেল, নীলকণ্ঠ তোদের॥
নদী বলে—কাল প্রভু যে আমার বুকের উপর তার, শিব শবের আকার॥ শিব আমার শব কেন হইল।
নদী বলে—মাধে শিবের শক্তি হ’রে নিল, জয়া জয়, খগুনে মঙ্গী স্তব্ধ হয়ে রয়।

আহা গুণকীর্তনের কী অপরূপ বর্ণনা।

ঠিক তেমনি আমার আরও একটি প্রিয় কীর্তন—

‘কীর্তন ভাঙা মুর-খয়রা।
গুপ্ত আনন্দ ধর্মের মেলা।
সে যে নিত্যং দেব দুর্লভং তোরা দেখবি তো আয় এই বেলা॥
তথা নাই শশী রবি, তথা নাই ভূত ভাবি, শত্রুমিত্র নাইকো তথা
একাকার সবই—তথা পর আপনার নাইকো বিচার, নাই গুরু নাই চেলা॥
তথা স্ত্রী পুরুষ নাই, নাহি মাতা পিতা ভাই, বারুদে আগুনে তথা রয়েছে এক ঠাঁই তথা নাই ভেদাভেদ, আনন্দ খেদ, তৃষ্ণ কি ক্ষুধার জ্বালা॥
যত রসের পশারি, তাদের দোকান দোধারি, রসিক যার কিনছে তারা রসের মাধুর—
হয়ে বধির বোবা রসে ডোবা, করছে সব রসের খেলা। মেলার করব কি বাখান, সদা রসের হুর তান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ত্রিশূল পাণি খুলেছে দোকান—
তারা বিনা মূলে কাঙাল জনে, বেচতেছে মুক্তিমালা॥ দিলদরিয়ার পারে, রত্নবেদীর ওপরে, সে যে বলতেনারি বুঝবি সেকি দেখিলে পরে—
পরিব্রাজক বলে দেখবি যদি ধুয়ে নে মনের মল বাউলের—সুশ্য।
মানুষের আসলে শৈশব ভাঙিয়েই জীবন চলে দিন যাপনের পথে পথে।’