শঙ্কা উপেক্ষা করে প্রথম আলো এগিয়ে যাক

সংবাদমাধ্যমকে একটি রাষ্ট্রের ফোর্থ এস্টেট বলা হয়। সমাজ প্রভাবিত করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সংবাদমাধ্যমের অসীম ক্ষমতার জন্য সর্বপ্রথম ইউরোপে এই ফোর্থ এস্টেট শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

সংগত কারণেই শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমকে প্রতিটি দেশের সরকার প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। সরকার যত বেশি অন্যায়ভাবে ক্ষমতার চর্চা করতে চায়, তত বেশি সংবাদমাধ্যম চক্ষুশূল হয়।

আমেরিকার মতো দেশেও এখন সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হয়। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই প্রবণতা আমরা নিয়মিত দেখি।

স্বাধীন সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, তা বাংলাদেশে ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারায় যে উত্থান-পতন, তার সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বরাবর ওঠানামা করে।

তারপরও যে কয়েকটি পত্রিকা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে, তার মধ্যে প্রথম আলো সবার ওপরে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের কাছে প্রথম আলো তাই হয়ে যায় প্রতিপক্ষ।

বাংলাদেশের সমাজ বিনির্মাণ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সঠিক নির্দেশনা দিতে প্রথম আলো বরাবর দায়িত্ব পালন করছে। সবার কাছে তাই এই পত্রিকা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

আমি আমার কথা বলতে পারি। যত ব্যস্ততা থাকুক, সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর আমার প্রথম কাজ প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে চোখ রাখা।

যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করেছে, তার মূল্যায়ন আমার ধারণা আমার মতো সব পাঠকের কাছ থেকে প্রথম আলো পেয়ে থাকে। প্রতিদিন তাই প্রথম আলোকে বলা যায় প্রথম সকালের উপহার।

নাইমুল আবরারের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রথম আলোর সম্পাদক ও তাঁর কর্মীদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আদালতের নির্দেশনা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। তাই বলছিও না। তবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু অবজারভেশন বলতে চাই।

ক. নাইমুল আবরারের মৃত্যুতে তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানাই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু একটা পরিবারের জন্য কতটা দুর্বিষহ, তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই জানে।

খ. এ কথা সত্যি যে নাইমুল আবরারের মৃত্যু দুর্ঘটনাবশত। এ মৃত্যুর পেছনে যদি কারও অবহেলা থাকে, অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত।

গ. প্রথম আলো পত্রিকার সহযোগী কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই প্রথম আলো অবশ্যই এর দায়ভার এড়াতে পারে না।

ঘ. আমি ঠিক জানি না প্রথম আলো এই দুর্ঘটনার দায়ভার এড়ানোর চেষ্টা করেছে কি না। আদালত নির্দেশনা দেওয়ার পরও প্রথম আলো অমান্য করেছে—এ রকম কিছু আমরা জানি না। তাহলে কেন এই দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো, তা আমার বোধগম্য নয়; যদিও নাগরিক হিসেবে আদালতের সিদ্ধান্ত মানতে আমরা বাধ্য।

ঙ. প্রথম আলোর সম্পাদক সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন সুশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁকে সবাই চেনে। তিনি পালিয়ে যাবেন না—এটা ধরে নেওয়া যায় অবলীলায়। তারপরও সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আমাদের অবাক করেছে, কোনো সন্দেহ নেই।

চ. আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচারব্যবস্থা নিয়ে যখন অস্বস্তি রয়েছে, তখন একটি জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সঙ্গে প্রথম আলোর কণ্ঠ রোধ করার যোগসূত্র মানুষ খুঁজে পেলে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ওপর সব সময় চাপ থাকে। কখনো সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়, কখনো আবার নিজেরা সেন্সরড হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন দ্বিতীয় ধারাটি চলছে। তারা নিজেরাই অতি উত্সাহী হয়ে অনেক কিছু চেপে যায়। এতে শুধু নিজেদের ক্ষতি করছে তা নয়, সরকারকে তারা মিসগাইড করছে। আর তাদের কারণে সংবাদমাধ্যমের শক্তিশালী দিক বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং তার পোস্ট–ইফেক্ট থেকে সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে সংহতির অভাব আমাদের কাছে ফুটে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সংবাদমাধ্যম অচিরেই পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে।

আমরা চাই না নাইমুলের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম আলোর সম্পাদক ও তাঁর কর্মীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হোন। আমরা চাই না এই ঘটনার জন্য প্রথম আলোকে শাস্তি দেওয়া হোক। আমরা চাই প্রথম আলোও তাদের সহযোগিতার হাত বাড়াবে। আশা করছি, প্রথম আলো নিজেরাও নাইমুলের মৃত্যুর জন্য নিজেদের গাফিলতি থাকলে তা শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সতর্কতার সঙ্গে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।

নাইমুল আবরারের মৃত্যু যেমন মেনে নিতে কষ্ট হয়, তেমনি মতিউর রহমান ও আনিসুল হকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিতেও আমরা খুব আশ্চর্য হই। আমাদের সাদাচোখে দেখা অনেক কিছু থেকে আমরা শঙ্কিত হই প্রথম আলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও। রাষ্ট্র যখন নানা গোঁজামিলে ভরা, তখন এই শঙ্কা খুব কি অমূলক? তারপরও প্রত্যাশা, আমাদের শঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে প্রথম আলো এগিয়ে যাবে সত্যের সঙ্গে।

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।