বেদবতী

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

আকাশে চাঁদ নেই। রাস্তাটা আজ অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই অন্ধকার। সড়কবাতি একটিও জ্বলছে না। এখানে প্রায়ই লাইট চুরি হয়। লোকে নিজের বাড়ির অন্ধকার দূর করতে রাস্তাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়।

এর ফায়দা তোলে নেশাখোর, পতিতা ও ছিনতাইকারীর দল।

আবার এ–ও হতে পারে, ওরাই নিজেদের স্বার্থে সড়কবাতি জ্বলতে দেয় না।

পাপের বসতভিটে অন্ধকারে। আলোতে নয়।

হালকা বাতাসে রাস্তার কিছু আবর্জনার ঠিকানা বদল হলো। দেশি হারবাল কোম্পানির বিজ্ঞাপন, যা ষাট বছরের বৃদ্ধকে সাতাশ বছরের যুবকের শক্তি প্রদানের সুসংবাদ ঘোষণা করে, যা পড়ে সাধারণ পথচারী ও বাসযাত্রী রোগীরা আশার আলো দেখেন এবং কিশোর যুবকেরা যা পড়ে বন্ধুমহলে হাসি–ঠাট্টা করে, তার একটি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে রাস্তার এপার থেকে ওপারে চলে গেল।

নক্ষত্রের আবছা আলোয় হাঁটতে হাঁটতে সুমি পথের সামনে পাঁচটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো দূর থেকে কেউ হা-হা করে হেসে উঠেছে। অট্টহাসি। অপার্থিব হাসি। মনে হলো দূর থেকে অশরীরী কেউ পৈশাচিক আনন্দে হাসছে। স্বাভাবিকভাবেই হৃৎপিণ্ডটা বুকের খাঁচার হাড়ে একটা ধাক্কা দিল।

এ রাস্তাটা এমনিতেই ভুতুড়ে। পুরোনো মহল্লা ও অন্ধকারের জন্যই নয়। সাত নম্বর বাড়িটার নামে অনেক ভৌতিক গল্পের প্রচলন আছে। আঠারো বছর আগে কোনো এক অজানা কারণে এই বাড়ির কর্তা পরিবারের সবাইকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন। লোকে বলে ভদ্রলোক নাকি প্রেত সাধনা করতেন।

সেই থেকে এই পথের পথচারীরা ওই বাড়িতে রাতের অন্ধকারে নানান আধিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার দেখতে পায়।

বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষে একটি আমগাছ আছে। বদনাম আছে সেই গাছটিরও। মানুষজন নাকি প্রায়ই সেই গাছে এক নারীমূর্তিকে বসে থাকতে দেখে। কাউকে কিছু করে না। শুধু বসে বসে কাঁদে। অনেকেই কসম খেয়ে বলেছেন, তাঁরা সেই কান্নার শব্দ শুনেছেন।

মাঝে মাঝেই অমাবস্যার রাতে নাকি গাছটির গা থেকে বিশেষ একধরনের কষ গড়াতে দেখা যায়। ছুঁয়ে দেখলে বোঝা যায় সেটি মানুষের রক্ত!

এ ছাড়া প্রায়ই লোকজন এই রাস্তায় কিছু বেঁটে মানুষকে আড্ডা দিতে দেখে। বামন আকৃতির ওসব মানুষ(?) লোকজনের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই দৌড়ে আমগাছে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়।

সুমির আজকের ভয়টা অবশ্য ভূতের কারণে নয়। এক স্মৃতি ফিরে আসায় হৃদয়টা অমন মুচড়ে উঠেছে।

উত্তরার দিকে এক বাড়িতে টিউশনি করত নীলু। সুমির প্রিয় বান্ধবী। ছোটবেলা থেকেই এক পাড়ায় বেড়ে ওঠা। একই স্কুল ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। মাঝে কেবল কলেজজীবনটাই বিচ্ছেদে কেটেছে এই যা।

সপ্তাহে চার দিন ছিল টিউশনি। দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ক্লাস শেষে সন্ধ্যার পর পড়াতে যেত ইংলিশ মিডিয়ামের ক্লাস ফাইভের বাচ্চাটিকে। ফিরতে তাই রাত হতো অনেক। সাড়ে নয়টা থেকে দশটা বেজে যেত প্রতিদিন। যদিও ঢাকা শহরের জন্য এই রাত আসলে তেমন কোনো রাতই না। তবু নীলু মেয়ে বলেই সেটি ছিল রাত নিশুতি।

সুমি অবাক হয়ে বলত, ‘তুই নিজের পড়া ম্যানেজ করিস কীভাবে?’

নীলু হেসে বলত, ‘হয়ে যায়।’

সুমি জানত নীলুদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তার বাবার আয়ে সংসার খোঁড়ায়। পরিবারের সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে পাঠানো বড় ভাইটা বোধ হয় সেখানেই হারিয়ে গেছে। ওরা সেই প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে চলে। ছোট বোনটি এখনো স্কুলপড়ুয়া। ক্লাস নাইন। কমার্স বিভাগ। তার ছোট ভাইটি মাত্র ক্লাস থ্রির ছাত্র। স্কুলে পড়াশোনা ছাড়াও এলাকায় ছোটদের মধ্যে মাস্তানি করে বেড়ায়। সে কারণে বাড়িতে মায়ের হাতে নিয়মিত চড়ও খায়।

একদিক দিয়ে সুমি নীলুকে হিংসাও করত খানিকটা। ওর মা–বাবাকে সে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে সংসারের হাল বইতে একটি শক্ত কাঁধ হলেই চলে। ছেলের নাকি মেয়ের,, সেটা ব্যাপার না।

সুমিদের সংসারে নীলুদের মতো অর্থকষ্ট নেই। অভিভাবক হিসেবে তাঁর মা–বাবাও আর আট–দশজনের মতোই। কিন্তু তাঁদের একটি ব্যাপার সুমির মনটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। সে একজন মেয়ে। মা–বাবা কখনোই প্রকাশ্যে বলেন না। কিন্তু সুমি জানে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস তাদের কোনো পুত্রসন্তান নেই। তিন সন্তানের তিনজনই মেয়ে।

আত্মীয়স্বজনেরা প্রকাশ্যে তাদের করুণা জানিয়ে যায়। কেউ কেউ পীর-ফকির-কবিরাজেরও সন্ধান দেন। অতি আধুনিকমনা ছোট চাচা বুদ্ধি দেন টেস্টটিউবের সাহায্য নিতে। আধুনিক বিজ্ঞান নাকি ইচ্ছামতো পুত্র–কন্যা জন্ম দেওয়ার সুযোগ দেয়।

সুমির মা–বাবা কাউকেই কিছু বলেন না। তাঁদের মৌনতা তাই একঅর্থে ওদের সমর্থনই করে।

সুমির আজীবনের লক্ষ্যও তাই প্রমাণ করা, মেয়েরাও বংশ প্রদীপ জ্বালাতে পারে।

এ ক্ষেত্রে ছোটবেলায় স্কুলের বাংলা টিচার কৃষ্ণা ম্যাডামের বলা একটি গল্প সুমির খুব মনে পড়ে যায়। রামায়ণ থেকে নেওয়া বেদবতীর গল্প।

কৃষ্ণা ম্যাডাম খুব চমৎকার গল্প বলতেন। পৃথিবীর বড় বড় লেখকদের বিখ্যাত বিখ্যাত সব উপন্যাস থেকে শুরু করে পৌরাণিক গল্পাংশ-সব! বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে শুনত সেসব।

তেমনি একদিন কৃষ্ণা ম্যাডাম বলতে শুরু করলেন, কুশধ্বজ ও মালাবতী চেয়েছিল তাঁদের কন্যা হিসেবে স্বয়ং লক্ষ্মী তাঁদের ঘরে জন্ম নিক। কিন্তু তাঁদের মেয়ে জন্মের পরেই বেদবাক্য আওড়াতে শুরু করে। মেয়ে ধার্মিক, কিন্তু মা লক্ষ্মী তো নয়! কাজেই ভাগ্যকে মেনে নিয়ে তাঁরা কন্যার নাম রাখলেন বেদবতী।

মা-বাবার সংসারে বেদবতী ভালোই ছিল। বেদ মুখস্থ ছিল তার। কিন্তু যখন জানতে পারল তার মা-বাবার স্বপ্ন ছিল লক্ষ্মীকে কন্যা হিসেবে পাওয়া, তাকে নয়, তখন সে পাহাড়ে গিয়ে লক্ষ্মী হওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করল।

সুমি যেন উপলব্ধি করল কৃষ্ণা ম্যাডাম ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে তার ঘটনাই বলছেন। তার মা-বাবারও তো আরাধনা ছিল লক্ষ্মীরূপী এক পুত্রসন্তানের!

সে–ও ‘বংশ প্রদীপ’ হওয়ার লক্ষ্যে তপস্যা শুরু করল। স্কুলে বাড়তি পরিশ্রম করে ভালো রেজাল্ট করা, খেলাধুলা, গার্লস স্কাউট, ডিবেটিং সোসাইটি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ এবং বর্তমানে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা। তারপরও তার তপস্যার কোনো ফল চোখে পড়ছে না। মা-বাবার মনের গহিন কোণে এখনো যেন পুত্রসন্তান না হওয়ার আফসোস ঘাপটি মেরে থাকে।

অন্যদিকে টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফিরতে নীলুর প্রায়ই রাত হয়ে যেত। পাড়াপড়শী গুঞ্জনও তুলত বেশ। নীলুর মায়ের গলায় জোর কোনো দিনই ছিল না। তিনি এসে মিনমিনে স্বরে বলতেন, দ্যাখ না যদি দিনের বেলায় টিউশনি শেষ করা যায়।

নীলু ঝাঁজালো স্বরে মাকে বলত, তুমি বললে টিউশনি ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারি। তা তোমার প্রতিবেশীরা কি মাস শেষে বাড়িতে পাঁচ হাজার টাকা পৌঁছে দেবে? যদি না দেয়, তাহলে ওদের চুপ থাকতে বলো।

নীলুর মা কাউকে চুপ করাতে পারেন না, উল্টো নিজে নীরব হয়ে যান।

এদিকে সরব হতে শুরু করে সুমির আত্মীয়স্বজনেরাও।

মেয়েকে এত পড়িয়ে কী হবে? বেশি পড়াশোনা করলে ভালো জামাই পাওয়া যাবে না।

মেয়ে মানুষ কুড়িতেই বুড়ি হয়। বিয়ের বাজারে বুড়ি মেয়ের কী কোনো কদর আছে? বুড়ি বিদ্যানকে কে বিয়ে করে?

মেয়ের নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে লাইন আছে, না হলে বিয়ে করতে এত টালবাহানা করছে কেন? এখুনি খোঁজ নিন। পরে দেখবেন বাসি হওয়ার পরে আমার কথা ফলবে।

সুমির মা–বাবাও নীলুর মায়ের মতো কাউকে চুপ করাতে পারেন না।

বেদবতীর মা–বাবাকে কী এমন গুঞ্জন শুনতে হয়েছিল? হয়েছিল বোধ হয়। মানুষের স্বভাবের বিবর্তন হাজার বছরেও ঘটে না।

একদিন বাড়ি ফিরতে নীলুর একটু বেশিই দেরি হচ্ছিল। রাত এগারোটা বেজে গেল। তবু মেয়ে বাড়িতে ফেরে না। মোবাইলও অফ। কেউ ধরছে না। সুমি খবর পেয়ে বাবাকে সঙ্গে করে রাত বারোটার দিকে নীলুদের বাড়িতে গিয়ে দেখে বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন এসে বসে আছেন। নীলুর বাবা শুকনা মুখে ঘরে-বাইরে পায়চারি করছেন। মায়ের বুক কান্নায় বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায়।

সুমির বাবা বলেন, ‘টিউশনিতে খোঁজ নিয়েছিলেন?’

নীলুর বাবা বলেন, ‘ওরা বলল, ঠিক সময়েই সে বেরিয়ে গেছে।’

পুলিশে খবর দেওয়া দরকার।

নীলুর এক আত্মীয় বলেন, ‘পুলিশে খবর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মেয়ে যদি কারও সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বদনাম হবে সবচেয়ে বেশি।

মধ্যবিত্তের আবার মেয়ের বিপদের চেয়ে বদনাম হওয়ার ভয় থাকে বেশি। নীলুর বাবাকে দেখেও সেটাই মনে হলো। নীলুর মা–ও এ ব্যাপারে নীরব।

সুমি জানে নীলুর সঙ্গে কার প্রেম চলছে। পাশের পাড়ার মুহিব। সেই স্কুলজীবন থেকেই দুজনের প্রেম। খবর পেয়ে সুমি প্রথমেই মুহিবের নম্বরে ফোন করেছিল। মুহিবও জানাল, অনেকক্ষণ ধরেই নীলুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হচ্ছে না। বেচারা নিজেও ফ্যাকাশে মুখে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে ঢুকে খোঁজ নেবে, সেই সাহস তাঁর নেই।

সুমি তীব্র স্বরে বলল, নীলুর কারও সঙ্গে প্রেম নেই। ওর নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে।

ওর কথাকে কেউ পাত্তাই দিল না। বন্ধুর পক্ষে মিথ্যা সাক্ষী দিতে সবার আগে বন্ধুরাই এগিয়ে আসে কিনা।

ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকে রেসের ঘোড়ার গতিতে। সেকেন্ডের কাঁটার প্রতিটা পদধ্বনি বুকের কাঁপনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রাত ঘন হতে থাকে। কিন্তু নীলুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। কী শঙ্কাময়, কী উৎকণ্ঠাময় রাত যে ছিল সেটা!

তিন দিন পর নীলুকে দেখে সুমি চিনতেই পারেনি।

হাসপাতালের মর্গে শোয়া ক্ষতবিক্ষত দেহটি তো তাঁর বান্ধবী নীলু নয়। তাঁর বান্ধবীর লাবণ্যতায় মুগ্ধ হতো আশপাশের সবাই। তাঁর হাসির ভক্ত ছিল না এমন কেউ মর্ত্যলোকে নেই। তাঁর পায়ের কাছে বসে প্রেম ভিক্ষা করেছে কত সুদর্শন যুবক!

অথচ এই নীলুর শরীরের এখানে–ওখানে খাবলা মেরে তুলে ফেলা হয়েছে মাংস। শরীরময় ছড়িয়ে আছে গভীর সব ক্ষত। টেনে ছেঁড়া হয়েছে চুল। কাপড় ছিন্নবিচ্ছিন্ন। ধর্ষণের আলামত স্পষ্ট। কেউ কী কোনো আক্রোশ মেটাতে তাঁর সঙ্গে অমন আচরণ করেছে? কী সেই আক্রোশ?

সুমির মাথায় কিছু আসে না। এ যেন শুধু ধর্ষণ বা খুন নয়। সে জন্য কাউকে এতটা নৃশংস হতে হয় না। এ যেন কোনো বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা। বোঝাতে চাওয়া, তোমার সঙ্গেও এমনটা ঘটবে।

কী অপরাধ ছিল নীলুর? সে তো তাঁর তপস্যা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তবে কেন তাঁর তপস্যাতেও রাবণকে এসে উপস্থিত হতে হলো?

হ্যাঁ, নীলুর ধর্ষকদের মতোই রামায়ণের কুখ্যাত লঙ্কাপতি রাবণ-রাক্ষস সম্রাট রাবণ-দশানন রাবণের বেদবতীর মতো অমন সুন্দরী যুবতী তপস্বিনীকে একা জঙ্গলে পেয়ে কামুক হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। ঘোর পাপী, দুরাত্মা অতিথি বেশে বেদবতীর সামনে উপস্থিত হয়।

বেদবতী অতিথি সেবা না করলে ধর্ম যাবে। কাজেই সে ফলমূল নিয়ে রাবণের আপ্যায়ন করে।

রাবণ এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। বেদবতী কাছে আসতেই তার হাত জাপটে ধরল।

বেদবতী সঙ্গে সঙ্গে বলল তিষ্ঠ!

তপস্বিনী, তেজস্বিনী বেদবতীর এক বাক্যেই রাবণ পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে যায়। আর এগোতে পারে না।

কিন্তু নীলু তো বেদবতীর মতো সত্য যুগের নারী ছিল না। তাঁর সেই তেজও ছিল না। সে ছিল কলিকালের এক সাধারণ রমণী। বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে যখন একদল জানোয়ার ঘিরে ধরেছিল, তাঁর কোনো ক্ষমতাই ছিল না ওদের স্তব্ধ করে দেওয়ার। হায়েনাবেষ্টিত অসহায় হরিণীর মতো শ্বাপদের শিকার হতে বাধ্য হয়।

উফ! কী বীভৎস! থরথর করে কেঁপে ওঠে সুমির শরীর। মৃত্যুর আগে হাজারবার মরতে চাওয়ার যন্ত্রণা কয়জন বুঝতে পারবে?

ছায়ামূর্তিগুলো নড়ে উঠল। এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা। সুমির নাকে অচেনা একটা গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। মদটদ হতে পারে। নেশা করছিল বোধ হয়। ভূত নেশা করে না। মানুষই। কিন্তু অন্ধকারে এই নির্জন রাস্তায় একদল মানুষের পরিবর্তে ভূত হলেই যেন এক বাঙালি তরুণীর জন্য বেশি ভালো হতো।

সুমির হাত–পা শক্ত হয়ে আসে। বুকে চেপে রাখা ব্যাগটা সজোরে জাপটে ধরল। ছিনতাইয়ের ভয়ে নয়। একদল রাবণকে চোখের সামনে দেখে। হৃৎপিণ্ডটা আরেকবার বুকের খাঁচায় ধাক্কা দেয়।

বুঝতে পারল, হতে পারে এটিই পৃথিবীতে কাটানো তাঁর শেষ কিছু মুহূর্ত। সেই সুযোগ আছে।

চোখের পর্দায় ভেসে উঠল আজকেই সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দেখা মায়ের মুখ। নাশতার টেবিলে ছোট বোন টুম্পার জেদ। পত্রিকার তাজা খবর পড়ে বাবার বিমর্ষ চেহারা।

এরপরই তার চারপাশের দৃশ্য বদলে যেতে লাগল। সে দেখল তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে নীলু। সারা দিনের ধকল সহা ক্লান্ত শরীর। কোনোরকমে বাড়ি ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়।

তাকে ঘিরে ধরেছে একদল নরপশু। সাপের মতো লকলক করছে জিব। কুকুরের মতো জ্বলজ্বল করছে তাদের প্রতি জোড়া চোখ। বড় বড়, বাঁকানো, ধারালো, নোংরা নখওয়ালা লিকলিকে হাত বাগিয়ে তাঁকে ঘিরে ঘুরছে জানোয়ারের দল। দূর থেকে ভেসে আসছে কারও অট্টহাসি। কে হাসে? লঙ্কাধিপতি রাবণ? নাকি জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা ইবলিস?

অজগরের সামনে খরগোশ ছানার মতো নীলু বুঝতে পারছে না তাঁর সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে। ছোট্ট বুকের ভেতর ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে থাকে অবিরাম।

তাঁর হাত টেনে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ওরা। নীলুর শরীর বড্ড দুর্বল। কিছুতেই ওদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। দেড় কোটি মানুষের আবাসভূমি ঢাকা শহরের বুক থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হলো। ওর চিৎকারে কোনো জটায়ু এগিয়ে এসে বাধা দিল না!

নীলুর মতো বেদবতীকে লঙ্কায় টেনে নিয়ে যেতে পারেনি রাবণ। তপস্বিনীর শব্দবাণে তিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল সে।

কিন্তু ধার্মিক রমণী বেদবতী এতে সন্তুষ্ট হয় না।

যে পাপী তাঁর পবিত্র দেহকে তার কামাতুর মন নিয়ে স্পর্শ করেছে, তার কোনো বিচার হবে না?

স্বেচ্ছায় আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাই সে রাবণকে বলে গেল, ‘আমি আবার জন্ম নিয়ে ফিরে আসব এবং আমার জন্যই তুমি সবংশ ধ্বংস হবে।’

নীলুও কী তেমনই কোনো অভিশাপ দিয়েছিল মরে যাওয়ার আগে? ওর খুনিদের তো বিচার হয়নি। পুলিশ তো খুঁজেই পায়নি তাদের। রাষ্ট্রও ভুলে গেছে তার কথা। কেউ মনে রাখেনি তাকে।

দূর থেকে অট্টহাসি শোনা যায়। রাবণের হাসি। ইবলিসের হাসি।

বিষ্ণুর অবতার ছিল রাম। রামের স্ত্রী সীতা। যার ফলে সীতা হলেন স্বয়ং লক্ষ্মী। এবং এই সীতার কারণেই রাবণ সবংশে ধ্বংস হয়েছিল। তার মানে বেদবতীর তপস্যা বৃথা যায়নি। বৃথা যায়নি অভিশাপও। সীতারই পূর্ব জন্মে নাম ছিল বেদবতী। সে ছিল কুশ ধ্বজ এবং মালাবতীর কন্যা।

মাথা ঝাঁকা দিয়ে আবারও বাস্তবে ফিরে আসে সুমি। ছায়ামূর্তিগুলো এগিয়ে এসেছে অনেকটা। সংখ্যায় পাঁচজন তারা। ছড়িয়ে পড়ছে তারা। যেন অজগরের মুখ হা হচ্ছে। ঘিরে ধরবে তাঁকে। প্রথম সুযোগেই গ্রাস করে নেবে। কিছুতেই পালানোর জন্য কোনো ফাঁক রাখবে না।

চোখের দৃষ্টিতে আগুন ধরিয়ে মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করে, বেদবতী বা নীলু হয়ে সে চুপচাপ মরে যাবে না। তার নাম সুমি। স্কুলের সবচেয়ে ডানপিটে তরুণী সুমনা হক। পড়ালেখা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে ডিবেটিংয়ে যে মেয়ে ছিল অপ্রতিরোধ্য।

আরও একটা ক্লাসে সে নিয়মিত ছাত্রী ছিল। মার্শাল আর্টস। সামনে এগিয়ে আসা পাঁচ ছায়ামূর্তির কারোরই ধারণা নেই যে সেই ক্লাসেও সে ছিল সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। তার হাতে নিয়মিত মার খেয়ে ধরাশায়ী হয়েছে ওদের মতোই অসংখ্য ষন্ডা পুরুষ।

বুকের কাছ থেকে ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিল সে। চুলের খোঁপা থেকে টেনে আনল ধারালো কাঁটা।

মনে মনে বলল, ‘এসো, লঙ্কাপতি রাবণ! তোমায় বধ করতে আমার কোনো রামের সাহায্য নিতে হবে না!’

রাবণের হাসির শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। ইবলিসও যেন চুপসে গেছে। যেন একালের বেদবতীর ‘তিষ্ঠ’ রবে স্তব্ধ হয়ে গেছে দুজনেই।

হাওয়া বইছে সড়কবাতিহীন অন্ধকার রাস্তার ওপর দিয়ে। আরও কিছু আবর্জনার স্থান বদলের সময় হলো।

(তনুর মতো হারিয়ে যাওয়া শত শত বোনদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। তাঁরা ভালো থাকুক।)

মঞ্জুর চৌধুরী: ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র। ই–মেইল: <[email protected]>