দেখে এলাম এক বৃদ্ধাশ্রম

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার। ছবি: লেখিকা
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার। ছবি: লেখিকা

গত ডিসেম্বরে আমার সুযোগ হয়েছিল ১০ দিনের জন্য দেশে যাওয়ার। ঢাকায় থাকাকালে মিরপুরে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার নামে এক বৃদ্ধাশ্রম দেখে এলাম।

মায়ের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের সেবামূলক কার্যক্রমের কথা অনেক শুনেছি। বৃদ্ধাশ্রম দেখতে একদিন ফোন করে দুপুর ১২টার আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম।

পূর্বনির্ধারিত সময়ে সেখানে পৌঁছে বন্ধুবৎসল সেবাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা দারুণ লেগেছে। তাঁরা পেশাদার আর কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।

বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর। মিল্টন সমাদ্দার এর প্রতিষ্ঠাতা। যিনি পেশায় একজন নার্স। তাঁর এই সেবামূলক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে অনেক করুণ আর মানবিক একটি কারণ আছে।

একদিন পথের পাশে কারও বৃদ্ধ বাবাকে তিনি দেখেছিলেন দুই পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা পরিত্যক্ত অবস্থায়। সেই বাবাকে তিনি নিজ বাড়িতে এনে দুই পায়ের চিকিৎসা করে মরণাপন্ন অবস্থা থেকে সুস্থ করেছিলেন। কিন্তু সেই বৃদ্ধের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।

সেই থেকে যাত্রা শুরু। বর্তমানে ৬৪ জন পরিজনহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন মিরপুরে তাঁর ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া করা দুটি বাড়িতে। আরও আছে চারজন শিশু।

খেয়াল করলাম, নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ব্যালান্সড ডায়েটের আয়োজন করার ব্যাপারে সেবাকর্মীদের আগ্রহ অনেক। না পারার আক্ষেপ প্রচুর। রাস্তার পাশ থেকে তুলে আনা বৃদ্ধ–বৃদ্ধারা অভ্যস্ত ছিলেন রুটি, কলা আর চা–তে। তাঁদের সঠিক ডায়েটে ফেরানো শ্রমসাধ্য। টাকার স্বল্পতা কাজটাকে অনেক কঠিন করেছে।

সেবাকর্মীরা মেডিকেল প্রফেশনাল হওয়ায় প্রায় হাসপাতালের কাছাকাছি লেভেল চিকিৎসার ব্যবস্থার চেষ্টা করেন তাঁরা। দেখলাম প্রথম রুমটিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ। সঙ্গে বৃদ্ধদের বিছানা। যার মাথার সাইড উঁচু করা যায়। যাতে খাদ্য শ্বাসনালিতে না পৌঁছায়। পাশে ওয়াকার রাখা। দুর্বল রোগীদের হাঁটানো বা শরীরচর্চা করানোর জন্য। ক্যাথেটারের মাধ্যমে সুস্থ রাখা বা মাসে একবার রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা তো আছেই।

অনেক সময় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পড়ে গিয়ে জখম বা মারা যেতে পারেন। এ রকম অনেক পরিস্থিতি তাঁরা সামলান হাসপাতালের মতো করেই।

দেখলাম যে শিশুরা আছে তাদের দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী। বাকি দুই শিশুর এক শিশুকে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। অপর শিশুকে মা হাসপাতালে ফেলে গেছেন। তাদের স্ট্রলারে বাইরে রোদে নিয়ে আসা হয়েছে। মানসিক প্রতিবন্ধী দুজন হয়তো সারা জীবন এখানেই থাকবে পরম মমতায়। বাকি দুজন বড় বা স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত।

আরও জানলাম, অনেক সময় হারানো শিশুকে পুলিশ এখানে দিয়ে যায়। পরে মা-বাবা এসে সেই শিশুদের নিয়ে যান খোঁজ পেয়ে।

মিল্টন সমাদ্দার ও অন্য সেবাকর্মীরা মিলে ব্যবসা করে যে টাকা আয় করেন, তার কিছু অংশ নিজেদের জন্য রেখে বাকি অর্থ এ সংস্থা চালাতে দান করেন। এই অর্থ দিয়েই বৃদ্ধাশ্রমের আসল ব্যয়ভার বহন করা হয়, আর আছে কিছু মানুষের সাহায্য।

মিল্টন সমাদ্দার ও সেবাকর্মীরা সবাই নার্স। তাঁরা টাকার বিনিময়ে বাসায় গিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দিয়ে আসেন। এটাই তাঁদের ব্যবসা।

এই বৃদ্ধাশ্রমে শুধু যাঁদের কেউ নেই, তাঁরাই থাকতে পারেন। তাঁদের আরেকটু আলো–বাতাস ভরা জায়গা, আরও চিকিৎসাসেবা বা খাবারের জন্য অর্থ প্রয়োজন। বৃদ্ধ বয়স কার কেমন যাবে, কে জানে। এই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো পথ দেখানো মানুষগুলোর পাশে আমাদের সবার দাঁড়ানো জরুরি।