নিয়তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আফরোজার বাপ, ও আফরোজার বাপ!’

‘উহু।’

‘উঠেন!’

‘কী জইন্যে?’

‘এক হিলি পান খাইতাম মন চায়। বেশি করি জর্দা-চুনা মাইখ্যা!’

‘রাইত বাজে কয়ডা, আফরোজার মা? এত রাইতে চুনা খাইলে মাথা ধরব। ঘুম আইব না আর।’

‘মন কি হেইডা বোঝে? বেবাক মন চাইতাসে, আফরোজার বাপ! মোর মন তো বেশি কিছু চায় না। আপনে এক হিলি পান সাজাইয়া দ্যান।’

আসগর মিয়া ওরফে আফরোজার বাপ উঠে বসল। ঘরময় ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ অঞ্চলে রাতেরবেলা বিদ্যুৎ থাকে না। হারিকেন নিভিয়ে কখনো ঘুমায় না তারা। মাঝরাতে কখন বাথরুম চাপে বা কী দরকার হয়, কে জানে। হারিকেনের টিমটিমে আলোটা তাই জ্বলতে থাকে সারা রাত।

আজ বোধ হয় তেল শেষ হয়ে গেছে। হারিকেনের বাতি নিভে গেছে। তার ওপর কনকনে ঠান্ডায় লেপ আর একটা কাঁথাতেও যখন শীত মানে না, কীভাবে পান সাজাবে সে? সুলতানা ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে এক খিলি পানের জন্য। ডাক্তারের কড়াকড়ি নিষেধে আসগর মিয়া পানের বাটা লুকিয়ে রেখেছে, যাতে সুলতানা সারা দিন পান খেতে না পারে। উপায় না দেখে সুলতানা মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতো বায়না শুরু করে। আসগর মিয়ার তখন প্রচণ্ড মায়া হয়। লুকানো গোপন কুঠুরি থেকে এক খিলি এনে সুলতানার হাতে দেয়।

কিন্তু এত রাতে সুলতানা আগে কখনো পান চায়নি। আজ কী হলো তার কে জানে? স্বামীকে এই শীতের রাতে ঘুম ভাঙানোর মেয়ে সুলতানা নয়। যা হোক, আসগর মিয়া উঠে বসে শেষ চেষ্টা করলেন।

‘রাইতে খাইস না, বউ। সক্কালবেলায় তরে দুই হিলি পান সাজাইয়া দিমু। অহন ঘুম যা। আমারেও ঘুমাইতে দে।’

‘অখন বুক জ্বালা করতাসে পানের জইন্যে। মইরাই যামু আইজকা।’

দমকা হাওয়া টিনের দেয়ালে যেন বাড়ি দিচ্ছে। দরজা-জানালা বন্ধ। তবু হু হু করে কোথা থেকে বাতাস এসে সুইয়ের মতো ফুঁড়ে মশারির ভেতর দিয়ে ঢুকছে গায়ে। দুজনই কাঁপছে প্রচণ্ড। আসগর ভালোভাবে লেপটা বউয়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।

‘এই ঠান্ডায় তুই আমারে মশারির বাইর করবি?’

ঠিক তখনই মশারির ভেতরে গুনগুন করে মশার গান কানে বাজল দুজনের। নিস্তব্ধ শীতের রাতে কনকনে বাতাসের সঙ্গে যেন পাল্লা দিতে চায় উড়ন্ত মশাটি।

অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো করে সুলতানা দু-তিনবার হাত উঁচিয়ে বিকট শব্দে তালি মারল। সে যেমন অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না, মশারও দেখতে পাওয়ার কথা না। এই সূত্রে যদি তার অদৃশ্য তালির ভেতরে দুরন্ত মশাটিকে চ্যাপ্টা করা যায়।

‘এমনে মশা মারে? তালি বন কর। আমারে ঘুমাইতে দে। তুইও ঘুমা। বউ আমার, এত রাইতে মাথা খাইস না আমার।’

‘একহান পান চাইসি। হাতি-ঘোড়া তো চাই নাই। আফরোজা ডাক দিসে আমারে। চইলা যাব। তখন পান কারে খাওয়াইবেন আপনে?’

‘আফরোজার আর খাইয়া কাম নাই, দুই দিন পরপর তরে বুলায়, তাই না?’

‘হাচা কইতাসি। বাতাসের শব্দ পান? ওই বাতাসে আফরোজার সুবাস পাইসি আমি। হেরপর থেইক্যা উইঠা বইসা রইসি। আফরোজা আসলেই চইলা যামু!’

আসগর চুপ করে গেল। আফরোজার প্রসঙ্গ সে তুলতে চায় না। কিন্তু সুলতানার ওই প্রসঙ্গ না তুললে যেন ভাত হজম হবে না। একটি মাত্রই মেয়ে তাদের। মেয়েটি সতেরো বছর বয়সে কোনো এক যুবকের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিল! সেই থেকে সুলতানা অসুস্থ। হঠাৎ হঠাৎ আফরোজাকে দেখতে পায়। কণ্ঠ শোনে। গায়ের গন্ধ পায়। শুধু স্পর্শ পায় না।

আসগর সেদিন থেকেই খুব শক্ত থাকার ভান করে। শুধু মনে হয়, একবার যদি মেয়ের স্পর্শ পেত। মাঝেমধ্যে সুলতানাকে ভীষণ হিংসাও হয়। কী ভাগ্য তার। মেয়ে শুধু তাকেই দেখা দেয়। গান শোনায়। বাপটাকে বুঝি মনে পড়ে না একটুও। একমাত্র মেয়েকে অকালে হারিয়ে বৃদ্ধ এই মা-বাবা প্রতিটা মুহূর্ত যেন নিজেদেরই সামলানোর যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তবুও যে কিছুই সামলাতে পারছে না।

‘আপনে কী চিন্তা করেন? আফরোজা কিন্তু আর একটু পরেই আমারে নিয়া যাবে, বইলে দিলাম। আপনে তখন লেপের ভিতরে আরামসে ঘুমাইয়েন।’

‘আফরোজারে ক, আমারেও নিয়া যাইতে। তুই একা যাবি ক্যান? কেমন বেয়াদব মাইয়া। শুধু মারে নিয়া টানাটানি। বাপটার কথা একবারও ভাবে নাই! কোলে কইরা ইশকুলে দিয়া যাইতাম, নিয়া আসতাম। আর বাপ-মারে ছাইড়া সে পুকুরে ডুব মারে? তোর আফরোজা তোরে বুলাইলে একটা থাপ্পড় দিতে পারস না? ক্যান ডুব মারল সে? আমরা কি তার কেউ না?’

আসগর মিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সুলতানা ডুকরে কাঁদছে। কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। কিন্তু আসগর বুঝতে পারছে, কথাগুলো বলে সে ঠিক করেনি। ডাক্তার বলে দিয়েছিল, সুলতানাকে আফরোজার মৃত্যুর ঘটনা কোনো অবস্থাতেই মনে করিয়ে দেওয়া যাবে না। খুব অপরাধবোধ হলো আসগরের।

গুটিসুটি মেরে বউকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘কান্দিস না, বউ। আমারও তো কান্দন আহে। বুকটা জ্বইলা যায়। আমগো নিয়তি, বউ। কপাল খারাপ। কী আর করবি। শান্ত হ, বউ আমার। আমি পান লইয়া আইতাসি।’

‘না, আপনে যাইবেন না। আপনে গেলে আর আসবে না। আমি জানি আফরোজা আপনেরে নিয়া যাইবে। আমি স্বপন দেখছি। আমি তহন কী নিয়া বাঁচমু? কোত্থাও যাইবার দিমু না আমি আপনেরে।’

‘না গো বউ, আমি যামু না। মাইয়াটার জইন্যে দোয়া কর। আমরা কানলে হের আত্মায় কষ্ট পাইব। পান খাইতে চাইসিলি, বেশি কইরা চুন দিয়া পান সাজাইয়া আনি। তুই বইসা থাক, বউ। আফরোজার লগে গফসফ কর।’

ছবি:লেখিকা
ছবি:লেখিকা

আসগর মিয়া হাতড়ে হাতড়ে কোনোমতে মশারি থেকে বের হলো। এক আধবার হোঁচট খেয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে একটা মোমবাতি ধরাল। তারপর সুলতানার মনের মতো করে পান সাজিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে দেখে সুলতানা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।

খুব শান্তি পেল সে। যাক, যেকোনো কারণেই হোক, রাতের বেলা পানটা এড়ানো গেল। কিন্তু আসগরের চোখের ঘুম উবে গেল একদম। কোনো ভাবেই ঘুম এল না আর। বউয়ের জন্য বানানো পানটা নিজেই মুখে পুরে নিল।

খুব আবেগ নিয়ে পানটা চিবোতে লাগল। সুলতানার এত প্রিয় জিনিসটায় কী যে মধু আছে, বুঝতে চাইল।

পানে মাখানো বেশি চুন–জর্দার নেশায় কি না কে জানে, আসগরের মনে হলো আফরোজা ডাকছে। কোন দিক দিয়ে ডাকছে বুঝতে পারল না। মশারির ভেতরে ঢোকার আগেই মোমবাতি নিভিয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হলো আলোটা যদি রাখত।

ওই যে আব্বা বলে ডাকল না! আসগর ধড়ফড় করে উঠে বসে চিৎকার করে ডাকল সুলতানাকে। আফরোজার মা, আমারেও আফরোজা বুলায়। শুন, শুন।

সুলতানা ঘুমের ভেতরে জবাব দিল, ‘আজান পড়সে আফরোজার বাপ! উইঠা মসজিদে যান!’

আসগর লজ্জা পেয়ে গেল। প্রায়ই আফরোজার কথা মনে করে এই দম্পতি ওলট–পালট নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করে।

তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার মনে হলো একটিবার যদি মেয়েটাকে কাছে পেত। কী নিদারুণ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তারা স্বামী–স্ত্রী বেঁচে আছে, মেয়েটার কাছে যদি চলে যেতে পারত।

কিন্তু নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে যে ইচ্ছা করলেই সবাই মরে যেতে পারে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে জীবনকে এগিয়ে নিতে হয়।

ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিয়তি মেনে নিয়ে আসগর অজু করার জন্য কলতলায় পা বাড়াল।
কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি