শর্টকাট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বেশ কয়েক দিন যাবৎ আমার মনটা ভালো নেই। অসুস্থতা, নিকটজনের চলে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে। বাসা থেকে বের হই কম। পত্রিকায় লিখি। তাই মাঝেমধ্যে খবর নিতে বের হতে হয়।

কয়েক দিন আগে রাতে হ্যামট্রাম্যাকে একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। যখন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাই, তখন প্রবাসের অনুষ্ঠানগুলোর মূল পর্ব, অর্থাৎ বক্তৃতা চলছিল।

কে একজন বক্তৃতা দিচ্ছিল। যেমন তার গলার আওয়াজ, তেমনি তার ভাষার প্রয়োগ। দেখলাম, লাল শার্টের ওপর নীল টাই পরেছে। রাত হলেও চোখে তার রোদচশমা।

লোকটার বক্তৃতা শুনে আমার কৌতূহল বেশ বেড়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি যত এগোতে থাকি, বক্তৃতার আওয়াজ তত কমতে থাকে। যখন আমি মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছালাম, লোকটি বক্তৃতা শেষ করে পেছন দিকে চলে গেল।

আমার শুধু মনে হলো, দূর অতীতে কোথাও যেন তাকে দেখেছি। শুধু দেখা নয়, মনে হলো তার খুব কাছাকাছি ছিলাম।

তারপর বসে অনুষ্ঠান দেখছিলাম আর পুরোনো বন্ধুবান্ধবের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি সেই কালো চশমা পরা লোকটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে জাপটে ধরে বলল, দোস্ত কেমন আছিস।

কোলাকুলির একপর্যায়ে কানে কানে লোকটি বলল, দোস্ত বাইরে চল। কোনো সিনক্রিয়েট করিস না।

তার চোখে–মুখে কী যেন একটা উত্তেজনার ভাব। আমাকে প্রায় জোর করে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে তখন কনকনে ঠান্ডা ও প্রচণ্ড বাতাস।

জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কেমন করে? এখন কী করিস?

বলল, এই তো তোদের সেবা করতে চলে এলাম। আমি তো বাংলাদেশের একজন উদীয়মান শিল্পপতি।

জিজ্ঞাসা করলাম, এত সুন্দর বক্তৃতা শিখলি কোত্থেকে।

বলল, মনে নেই, তুই যখন হরতালের দিনে অলিগলি করতি, তখন আমি বিভিন্ন দলের মিছিলে যেতাম।

আমি বললাম, তাহলে তোর অতীতের কথা মনে আছে।

সে বলল, তুই সারা জীবন অতীত নিয়েই পড়ে থাকলি। এ জন্য তো তোর আর কিছু হলো না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখ।

আসলেই আমি একটু অতীতে ফিরলাম। আমার এই বন্ধুর নাম কইতর আলী। একসময় আমরা দুজনে সিলেট শহরে থাকতাম। আমি টিউশনি করতাম বিভিন্ন স্থানে। এই যেমন বন্দর, আম্বরখানা, জিন্দাবাজার, মেডিকেল এলাকা। এ জন্য আমাকে চরকির মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো। ছাত্রদের পেছনেও সময় দিতাম বেশি। টিউশনি নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।

আমার মতো কইতর আলীও টিউশনি করত। একই এলাকায় আর আমার থেকে অনেক কম সময় পড়াত। কিন্তু মাস শেষে আমার চেয়ে কইতর আলীই বেশি রোজগার করত। আমাকে সে সব সময় বলত শর্টকাট মার দোস্ত। শর্টকাট মেরে আমার বন্ধু কইতর আজ উন্নতির চরম শিখরে। আর আমি।

এমন সময় আমার বন্ধুর ফোন বেজে উঠল। বন্ধু বলল, দোস্ত আমার আরেকটা মিটিং আছে, যেতে হবে। আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল একটি রেঞ্জ রোভার। বন্ধু আমাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠল। হ্যামট্রাম্যাক সিটির বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ ধরে গাড়িটি এগোতে লাগল।

আমি আবার অতীতে ফিরলাম। যে বাংলাদেশ অ্যাভিনিউর ওপর দিয়ে আমার বন্ধুর গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে, একসময় সে সড়কের নাম ছিল কনান্ট স্ট্রিট। বন্ধু হয়তো কোনো দিনই জানবে না কনান্ট স্ট্রিটকে বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ বানাতে কত বাঙালি অবদান রেখেছেন।

মনে মনে বললাম, বন্ধু অতীত ভুলিস না। অতীতই যে গড়ে দেয় ভবিষ্যতের সাফল্যের সোপান।

পার্থ সারথী দেব: মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র