অস্ট্রেলিয়ার বর্ষাকাল

বৃষ্টির পূর্বাভাসের গ্রাফচিত্র
বৃষ্টির পূর্বাভাসের গ্রাফচিত্র

অস্ট্রেলিয়ায় কোনো বর্ষাকাল নেই। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত শরৎকাল। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত শীতকাল। আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বসন্তকাল। আরও সহজ করে বললে এখানে ছয় মাস গ্রীষ্মকাল আর ছয় মাস শীতকাল।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার পারদ অনেক উঁচুতে উঠে যায়। যেটা এ বছর পঞ্চাশের ঘর পার করেছে। আবার শীতকালে তাপমাত্রা নামতে নামতে ইদানীং হিমাঙ্কের নিচে চলে গিয়েছে।

এক অর্থে অস্ট্রেলিয়াতে বর্ষাকালের অস্তিত্ব নেই। আর অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কৌতুক হচ্ছে, এখানে একই দিনে চার ঋতুরই দেখা পাওয়া যায়।

অস্ট্রেলিয়াতে কেউ বাইরে যাওয়ার আগে আনুষঙ্গিক কিছু জিনিস বাধ্যতামূলকভাবে সঙ্গে নেয়। এর মধ্যে একটা শীতের কাপড় ও একটা ছাতা থাকেই। কারণ, সারা বছরজুড়েই অস্ট্রেলিয়াতে বৃষ্টি হয়। তবে তার মাত্রা খুবই কম।

আর সেই বৃষ্টির বেশির ভাগই হয় শীতকালে। তাই বাংলাদেশের মতো করে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ নেওয়ার সুযোগ এখানে খুবই কম। এই বৃষ্টি তাপমাত্রা মুহূর্তের মধ্যে কমিয়ে দেয়। ফলে এই বৃষ্টি গায়ে পড়লে ঠান্ডা লাগবে নির্ঘাত।

অস্ট্রেলিয়ায় গত বছর খরার মাত্রা ছিল অনেক বেশি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল খুবই কম। হয়তোবা এ কারণেই এবার অস্ট্রেলিয়ার বনে অনেক আগেভাগেই আগুন লেগেছে। যেটাকে স্থানীয়রা বলেন বুশ ফায়ার।

এই আগুন ছিল পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত আর মাত্রা ছিল অনেক বেশি। সেই আগুনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিগত সব বছরের পরিমাণকে ছাপিয়ে গেছে। দমকলকর্মীরা কোনোভাবেই এই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হচ্ছিলেন না। কারণ, আগুনের পাশাপাশি প্রচণ্ড গতির বাতাস সেটাকে দূর–দূরান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

কানাডা, আমেরিকা থেকে দমকলকর্মীরা তাঁদের বড়দিনের ছুটি বাতিল করে এসে যোগ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নিবেদিতপ্রাণ দমকলকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তখন সবাই একটা জিনিসের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সেটা হচ্ছে বৃষ্টি।

এর মধ্যে অবশ্য বৃষ্টি হয়েছিল। ছাড়া ছাড়াভাবে খুবই সামান্য পরিমাণে। যেটা তেমন কোনো কাজে আসেনি। অস্ট্রেলিয়াতে বিভিন্ন সংগঠন তাদের মতো করে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছিল।

অস্ট্রেলিয়ার এবারের গরম অনেক দিন পর আমাদের ছোটবেলার অনেক পুরোনো একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে যখন গরম পড়ত তখন অন্য এলাকার তুলনায় চর এলাকায় একটু বেশিই গরম পড়ত। চর এলাকার বেলে-দোআঁশ মাটি খুব দ্রুতই তেতে উঠত আর তেমন বেশি একটা গাছপালা না থাকায় পরিবেশ ঠান্ডা করার তেমন কোনো প্রভাবক থাকত না।

বৃষ্টির পূর্বাভাসের মানচিত্র
বৃষ্টির পূর্বাভাসের মানচিত্র

পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যেত। বেশির ভাগ সময়ই চাপকলে পানি থাকত না। পানি ওঠাতে হলে পুনরায় পানি ঢেলে তারপর পানি তুলতে হতো। মালায় (আইসক্রিম) ওয়ালাদের ব্যবসা জমে উঠত। আমরা বাচ্চারা মালায় কিনে খেতাম আর বড়রা বরফ কিনে খেত। আবার কেউ কেউ বরফ কিনে মাথায় দিত মাথা ঠান্ডা করার জন্য। এই সময়গুলোতে চরের খেতে প্রচুর কাকুর (বাঙ্গি) আর তরমুজ হতো। এগুলোও গরম প্রশমনে কিছুটা ভূমিকা রাখত।

এত কিছুর পরও বৃষ্টির জন্য মনের মধ্যে হাহাকার জমতে থাকত। কারণ, বৃষ্টি না হলে চাষবাস পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। আর চরের মানুষের একমাত্র ও প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। আর সেই চাষবাস পুরোটাই নির্ভর করত বৃষ্টির পানির ওপর। কারণ, তখন পর্যন্ত সেচ দেওয়ার যন্ত্রপাতি অতটা সহজলভ্য হয়নি।

অবশেষে একসময় বৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণের শেষ চেষ্টা হিসেবে শুরু হতো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। গ্রামের মুরব্বিরা সবাই একসঙ্গে বসে ঠিক করতেন কোন দিনটা শুভ হবে এবং গ্রামের কোন জায়গাটাতে হবে প্রার্থনা। তারপর চলত প্রস্তুতি। দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো পাড়া হিসেবে।

নির্দিষ্ট দিনে শুরু হতো কর্মযজ্ঞ। একদল নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত খনন শুরু করে দিত। যাকে গ্রামের ভাষায় আমরা বলতাম খাদ বা মাটিল। প্রায় এক মানুষ সমান গভীর হতো সেই গর্ত। অন্য দলগুলো নিজের নিজের পাড়ায় দান নিতে নেমে যেত। কোনো দাবি নেই। যার যার অবস্থান থেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দান করত।

কেউ চাল, কেউ ডাল, কেউ সবজি, কেউ তেল, কেউ গুড় এমন আরও কত–কী। কারণ, এসবই নিজেদের খেতে ফলানো। তাই সবাই দান করত দুহাত ভরে। দানগুলা সব এক জায়গায় করতে করতে এবং গর্ত খোঁড়া শেষ করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলে গ্রামের সব শিশু-কিশোর-যুবক-বয়স্ক সবাই নেমে পড়ত সেই গর্তে আর গ্রামের মেয়েরা সেই গর্তে কলসিতে করে পানি ঢালতে থাকত।

দেখতে দেখতে সেই গর্ত একটা ছোটখাটো পুকুরের আকার ধারণ করত। তারই মধ্যে চলত সন্ধ্যা পর্যন্ত জলকেলি। একজন গান ধরত—‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে’। আর বাকিরা সবাই মিলে কোরাসে তার সঙ্গে তাল মেলাত। তারপর সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো রান্নার আয়োজন। সে এক এলাহি ব্যাপার।

সবশেষ সবার মাঝে খাবার (শিরনি) বিতরণ। শিরনি বিতরণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা হতো যেন গ্রামের কোনো পরিবার বাদ না পড়ে। যেসব পরিবার থেকে কেউ আসতে পারত না তাদের শিরনি পৌঁছে দেওয়া হতো। তারপর সে রাতে আমাদের আর ভালো করে ঘুম হতো না। এই বুঝি ঘুমিয়ে গেলে বৃষ্টি আসবে আর আমি টের পাব না। তখন সকাল বেলা উঠে সবাইকে বলতে পারব না যে আমি সবার আগে আমাদের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনেছি।

গ্রামবাংলার সবকিছুতেই ছিল প্রকৃতির ওপর শতভাগ নির্ভরতা। কোন দিকের মেঘ ডাকলে গরম পড়বে, কোন দিকের মেঘ ডাকলে বৃষ্টি হবে, কোন দিকের মেঘ ডাকলে নদীর পানি বাড়বে, কোন দিকের মেঘ ডাকলে নদীর পানি কমবে, এমন আরও অসংখ্য বিশ্বাস। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনাও ঠিক তেমনই একটা বিশ্বাস থেকে করা হতো।

বহুদিন বাদে দমকলকর্মীদের অবসর
বহুদিন বাদে দমকলকর্মীদের অবসর

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল শুরু হওয়ার পর থেকেই সবাই আবহাওয়ার পূর্বাভাসের দিকে নজর রাখছিলেন। বড়দিনের দিন বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। এরপরও বেশ কয়েকবার বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। শেষ পর্যন্ত আর কার্যকর হয়নি। এভাবেই ২০১৯ সালটা শেষ হয়ে গেল।

বৃষ্টি না হওয়ার ফলে দুটো মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছিল। এক. বুশ ফায়ারের আগুনকে কোনোভাবেই বাগে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। দুই. সুপেয় পানির স্তর অনেক নেমে যাচ্ছিল।

অস্ট্রেলিয়ার সুপেয় পানির প্রধান উৎস হচ্ছে জলাধারগুলো। অনাবৃষ্টির কারণে জলাধারগুলোর পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গিয়েছিল। তখন পানি ব্যবহারের ওপর দ্বিতীয় স্তরের কড়াকড়ি আরোপ করা হলো। সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটার মধ্যে বাগানে পানি দেওয়া যাবে না। এটা ছিল প্রথম স্তর। এরপর বাগানে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে পানির পাইপের পরিবর্তে বালতি ব্যবহার করতে বলা হলো।

অবশেষে অস্ট্রেলিয়াতে বর্ষাকালের আবহাওয়া হাজির হলো। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে টানা বৃষ্টির কথা বলা হচ্ছিল। বৃষ্টিরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন বৃষ্টি একা আসে না। সে আবার সঙ্গে করে বজ্র নিয়ে আসে। আর বৃষ্টির ফলে বন্যা এবং ভূমিধস নিয়মিত ঘটনা। দেশটিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যেটা চলেছে সোমবার পর্যন্ত।

আবহমান গ্রামবাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে। শনির সাত, মঙ্গলের তিন। তার মানে হচ্ছে শনিবার বৃষ্টি শুরু হলে সাত দিন চলবে আর মঙ্গলবার শুরু হলে চলবে তিন দিন। অস্ট্রেলিয়ার এবারের বৃষ্টিটা দেখেই ও কথাগুলো মনে পড়ছে। একেবারে বাংলাদেশের বর্ষাকালের মতো টানা অঝোরধারায় ঝরেছে বারিধারা। রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে।

মেলবোর্নে বন্যা ও ভূমিধস প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে সবচেয়ে খুশি হয়েছে গবাদিপশুর দল ও শিশুরা। গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিতে ভেজা অবস্থায় শিশুদের হাসিমুখের ছবি ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে গবাদিপশুদের বৃষ্টিতে নাচানাচির ছবিও দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে যে বাচ্চাগুলো জন্মের পর এই প্রথম বৃষ্টি দেখছে তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে।

খাতাকলমে অস্ট্রেলিয়াতে বর্ষাকাল না থাকলেও এবার একেবারে বাংলাদেশের ঋতু বদলের প্রক্রিয়ায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যেই প্রশান্তির পরশ নিয়ে এসেছে পাঁচ দিনব্যাপী এই বৃষ্টি। বুশ ফায়ারের ফলে পুরে যাওয়া বনগুলোতে এই বৃষ্টিতে কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার হবে। কৃষকদের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে এই বর্ষায়। কারণ, সেচের অনেক ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্বের কৃষি এখনো বৃষ্টির পানির ওপরেই নির্ভরশীল।

মাঝে খবর বেরিয়েছিল বৃষ্টির অভাবে অস্ট্রেলিয়ার কৃষকেরা তাঁদের পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। আশা করি, এই বৃষ্টি কিছুটা হলেও তাঁদের সাহায্য করবে। এ ছাড়া পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া দশ হাজার উট মেরে ফেলার মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মৌসুমি বায়ুর ফলে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টিপাত হয়। যেটা বর্ষাকাল নামে পরিচিত। প্রকৃতি যদি প্রতিবছর নিয়ম করে অস্ট্রেলিয়াতেও একটা সময়ে বর্ষাকাল নিয়ে আসত তাহলে খুবই ভালো হতো।

তবে এই সব ঘটনাপঞ্জি আবারও প্রমাণ করেছে এই পৃথিবীতে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে হলে প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হতে হবে। কারণ, প্রকৃতিই আমাদের আসল মা। আমরা যেমন মায়ের পেটে সামান্য একটা ভ্রূণ থেকে পরিপূর্ণ মানব শিশুতে রূপান্তরিত হই, ঠিক তেমনি আমরা প্রকৃতির পেটের মধ্যে বসবাস করে তার বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভর করে আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত বেঁচে আছি এবং ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকতে হবে।