উড়িবার হলো সাধ

ফ্রি ফল বা মুক্ত অবরোহণের মুহূর্তে। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর
ফ্রি ফল বা মুক্ত অবরোহণের মুহূর্তে। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর

উলংগং স্কাই ডাইভিং সেন্টারে যখন পৌঁছালাম তখন ভোর পাঁচটা কী ছয়টা হবে। বেশ কিছুদিন থেকেই পাখির চোখে বিশ্ব দেখার এক অদম্য ইচ্ছা মনের ভেতর বাসা বেঁধেছে। এর কারণ অবশ্য আমার অফিসের বসের স্কাই ডাইভিংয়ের বর্ণনা। আমি তখন বাংলাদেশ থেকে কয়েক মাস আগে সিডনিতে এসেছি।

একদিন আমার বস অফিসে এসে বললেন, দুই দিন আগে তিনি একটি দুঃসাহসিক কাজ করেছেন।

তাঁর এই কথা শুনে কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমি ও আমার বন্ধু (আমরা একই অফিসে কর্মরত) উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম বসের এই দুঃসাহসিক কাজের ব্যাপারে।

বস বললেন, তিনি গত শনিবার স্কাই ডাইভিং করে এসেছেন। প্রায় ১৫ হাজার ফুট উঁচুতে থাকাবস্থায় প্লেন থেকে লাফ দিয়েছেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘একা?’

বস বললেন, ‘না, একজন ইনস্ট্রাক্টর ছিল সঙ্গে।’

আমি তো শুনে, আমার উত্তেজনা আর ধরে রাখতে পারছি না। কথায় আছে পিপীলিকার পাখা গজায়, মরিবার তরে। আমি যেহেতু পিপীলিকা নই মানুষ জাতির অন্তর্ভুক্ত, তাই আমার ক্ষেত্রে হবে ‘মরিবার নয়, উড়িবার তরে’।

বন্ধুকে বলতেই সে–ও লাফিয়ে উঠল। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা গেলাম উলংগং নামক একটি জায়গায়। সিডনি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। গাড়িতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।

এ ক্ষেত্রে আমার উৎসাহ বেশি থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভয় ভয় করতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, যদি শেষ পর্যন্ত প্যারাস্যুট না খোলে বা আমার সঙ্গে যে ইনস্ট্রাক্টর থাকবেন তিনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন মাঝ আকাশে অথবা নিদেনপক্ষে আমারই যদি হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন কী হবে!

আরও ভয় পেলাম যখন শুনলাম আমার ইনস্ট্রাক্টর বললেন, প্লেন থেকে লাফ দেওয়ার পর ‘ফ্রি ফল’ বা ‘মুক্ত অবরোহণ’ আছে প্রায় এক থেকে দুই মিনিট। তার মানে প্যারাস্যুট ছাড়া শুধু মাধ্যাকর্ষণজনিত বলের প্রভাবে নিচে নামতে হবে। আমার মুখ ক্রমেই শুকিয়ে আসছে। আমি ঘন ঘন বাথরুম যাচ্ছি। কী ভয়ংকর কথারে বাবা!

আমি ইনস্ট্রাক্টরকে অনুরোধ করতে লাগলাম, মুক্ত অবরোহণের সময়টা যেন কমিয়ে দেন। আমার বারবার অনুরোধ শুনে তিনি বললেন, আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। কমিয়েই দেব না হয়, শুধু তোমার জন্য।

তারপর ফিসফিস করে আবার বললেন, কাউকে বলো না যেন। আমার সমস্যা হবে।

প্লেন থেকে লাফ দেওয়ার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর
প্লেন থেকে লাফ দেওয়ার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর

আমি এবার মনে হয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। প্লেন থেকে লাফ দিয়েই প্যারাস্যুট খুলে যাবে। আর কোনো চিন্তা নেই। তবু মনকে যতই সান্ত্বনা দিচ্ছি, আসলে খুব একটা লাভ বোধ হয় হচ্ছে না।

ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে আমাদের ডাক পড়ল আরেকটি জায়গায়। সেখানে গিয়ে আরও অন্য সহযাত্রীদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। পরিচয়পর্ব শেষে একজন ভদ্রলোক পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটবে সব বুঝিয়ে বললেন। আমি যেন এখন একটু ভরসা পাচ্ছি।

এরপর ইনস্ট্রাক্টর মহাশয় আমাকে একটি বিশেষ ধরনের পোশাক (প্যান্ট ও নিরাপত্তাজনিত কিছু উপকরণ) পরিয়ে দিলেন।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদের একটি বাসে করে বিমানবন্দরে রানওয়ের কাছাকাছি নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি একটি বিশেষ বিমান অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বিমানটিকে বিশেষ বললাম কারণ এই বিমানে কোনো চেয়ার নেই। আছে কিছু বেঞ্চ। কোনো সিটবেল্ট বাঁধার ঝামেলা বা বিমানবালা নেই।

খুবই ছোট্ট একটি বিমান। বিমানে ঠাসাঠাসি করে প্রায় ১২-১৪ জন উঠে পড়লাম। প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর ইনস্ট্রাক্টর। আমি ও আমার ইনস্ট্রাক্টর সবার শেষে উঠলাম। তার মানে আমাদের লাফ দিতে হবে সবার আগে।

বিমান যখন পনেরো হাজার ফুট ওপরে উঠল, তখন আমার ইনস্ট্রাক্টর বললেন, মাইট (অজিরা Mate-কে মাইট বলে) কোনো চিন্তা নেই। আমি প্রায় ১২-১৩ শ বার লাফ দিয়েছি। এখনো কোনো সমস্যা হয়নি। আর আমাদের দুটি প্যারাস্যুট আছে। একটি কাজ না করলে অন্যটি ব্যবহার করা হবে।

আমি শুধু মুখ শুকনো করে ঢোক গিলছি আরা মাথা নাড়াচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমানের পেছনের দরজা খোলা হলো। তখন বাতাসের কারণে কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। আমি নির্দেশমতো নিচে না তাকিয়ে ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কেন জানি না, আকাশে শুধু আমার মায়ের মুখ ভেসে উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে লাফ দেওয়া হলো। আমার পীঠের সঙ্গে আমার ইনস্ট্রাক্টর খুব শক্ত করে বেল্ট দিয়ে নিজেকে বেঁধে ফেলেছেন আগেই।

প্যারাস্যুট খোলার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর
প্যারাস্যুট খোলার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর

আকাশে উপুড় হয়ে ভেসে রয়েছি। নিচে নামছি হু হু করে। প্রচণ্ড বাতাসে মুখমণ্ডলের চামড়া দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আমাকে মুখ খুলে হা করে নিশ্বাস নিতে হচ্ছে। শুধু একবার ওপরে তাকিয়ে দেখলাম যে বিমানটি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। শরীরের ভেতর এড্রিনালিন হরমোন সে রকম দৌড়াদৌড়ি করছে।

আমি ইনস্ট্রাক্টরের কথা শুনতে পারছি না। তিনিও আমার কথা শুনতে পারছেন না। হাতে বাঁধা ঘড়ির মতো একটি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছেন। ইশারা দিয়ে আমাকে নিচে ও আশপাশে দেখতে বললেন। চোখে আমার ঢাউস আকারের একটি গগলস আছে। চারপাশে যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো ঘন নীল এক বাতাসের মধ্যে পাখির মতো ভেসে রয়েছি। তখন একটু মজা পেতে শুরু করছি। মুক্ত বাতাসে মুক্ত অবরোহণের এক অন্য রকম অনুভূতি। সেটির তুলনা বোধ হয় আর কিছুর সঙ্গে চলে না। আমার ধারণা, ইতিমধ্যে আমরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফুট নিচে নেমে এসেছি।

আমার এই মজা পাওয়ার মুহূর্তে তিনি আবার ইশারা দিয়ে বোঝালেন যে, প্যারাস্যুট খোলা হবে। দেখলাম তিনি একটি বোতাম টিপে প্যারাস্যুট খুলে ফেলেছেন। ওমা এ কী! প্যারাস্যুট খোলার পরপরই মনে হলো আমরা প্রায় এক থেকে দেড় হাজার ফুট ওপরে উঠে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যারাস্যুট, আমরা ও বাদবাকি সবকিছু সুস্থির হলো। এখন তিনি দুটি রশ্মি দিয়ে খুব সুন্দর করে প্যারাস্যুট নিয়ন্ত্রণ করছেন। চাইলেই ডানে–বাঁয়ে বা ওপরে–নিচে নিয়ে যেতে পারছেন।

আমি এখন পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ত। চারপাশ তাকিয়ে দেখছি। এত ওপর থেকে পৃথিবীটাকে অচেনা মনে হতে লাগল। নিচে লাল-নীল-হলুদ নানা রঙের ছাদওয়ালা অত্যন্ত ছোট ছোট ঘরবাড়ি। এক পাশে নীল সমুদ্র। সমুদ্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রাস্তা। সবুজ গাছপালা-ঘাস।

ওহ মাই গড! এত সুন্দর দৃশ্য আমি কোনো দিন দেখিনি আর কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হতে লাগল কোনো শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা একগুচ্ছ রঙের ঝরনাধারা। ছোপ ছোপ করে সাজানো রঙের প্যালেট মনে হচ্ছে দুনিয়াটাকে। রঙের প্যালেট রঙের দুনিয়ায় রং ছড়িয়ে যায়। সত্যিই অপূর্ব। অনিন্দ্যসুন্দর। সেই সঙ্গে আমার অনির্বচনীয় ভালো লাগা।

সেই ভালো লাগা খুব বেশিক্ষণ কপালে সইল না। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন।’

মাটিতে নামার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর
মাটিতে নামার পর। ছবি: ইনস্ট্রাক্টর

আসলে এবার আমাদের আকাশ থেকে নেমে আসার পালা। এখন সত্যিই আমার মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার তো নেই। ভালো জিনিস অল্প দেখাই তো ভালো। ইনস্ট্রাক্টর মহাশয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিরাপদে নেমে এলেন আমাকে নিয়ে। মাটিতে পা দিয়ে বুঝলাম যতই আকাশে উড়তে চাই না কেন, মাটিই আমাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

ইনস্ট্রাক্টরের কাছে থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘কেমন লাগল, তোমার?’

আমি বললাম, ‘এক কথায় অসাধারণ। আমি আবারও লাফ দেব।’

শুনে তিনি খুশিই হলেন। তারপর বললেন সবচেয়ে মজার কথা, ‘মাইট, আমরা কিন্তু মুক্ত অবরোহণ পুরো দুই মিনিটই করেছি। আমি তোমাকে ওই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। তা ছাড়া যেহেতু প্যারাস্যুট খোলার পর কিছুটা ওপরের দিকে উঠে যায় তাই আগে খুললে প্লেনের সঙ্গে ধাক্কা খাবার ভয় থাকে। আর একটি নির্দিষ্ট বাতাসের গতিবেগ ও চাপ না থাকলে প্যারাস্যুট খোলা যায় না।

শুনে কী যে ভালো লাগল। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে চললাম নিজের গন্তব্যে।
---

পারভেজ রাকসান্দ কামাল: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>