ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-সাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ডা. সিরাজের দিন ইদানীং বেশ ব্যস্ত যাচ্ছে। বাংলাদেশের শীতকাল মানে সকালে ঠান্ডা, দুপুরে গরম, আবার বিকেলে ঠান্ডা।

এই বদলের আবহাওয়ায় শিশুরাই ভোগে বেশি। আর শুধু শিশু রোগীর চিকিৎসা করেই কি শান্তি আছে? এদের উৎকণ্ঠিত বাবা-মায়েদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে পাগলপ্রায় সিরাজ। তবে এর মধ্যেই কৃষ্ণার সঙ্গে শনি ও রোববারের আড্ডা হতেই হবে। কৃষ্ণার মার্কিন জীবনের গল্প শুনতে ভালোই লাগে সিরাজ-কাজলের। সিরাজ রোগীদের সঙ্গে হওয়া হাজারো মজার অভিজ্ঞতা শোনান কৃষ্ণাকে।

এদিকে লাইলি যদিও বেশ পাকা রাঁধুনি, তবু ছুটির দিনে কাজল চাচির ভিডিও কলে রান্না শিখতে বেশ লাগে কৃষ্ণার। কাজল হয়তো রান্না শেষে বাসন ধুতে ধুতেই কৃষ্ণাকে কোনো রান্নার প্রণালি শুনিয়ে দেন। যতক্ষণ না সেই প্রণালি খাবার টেবিলে উঠবে, কৃষ্ণা চেষ্টা থামায় না।

নার্সিংয়ের ছাত্রী কৃষ্ণা তার প্রিয় শিপের কাছে সেবা করার খুঁটিনাটিও শেখে। নার্সিং মানে যেমন মানুষের কাজে আসতে পারা, তেমনি আমেরিকায় একজন রেজিস্টার্ড নার্সের আয় নেহাত মন্দ নয়।

শুভর কয়েক বছর আগে কেনা দুটো গোল্ড ফিশের পরিবার বেড়েছে। মাছ পালতে পালতে পোষা কুকুর না থাকার দুঃখ ভুলেছে শুভ। বছর তেইশের কৃষ্ণার সঙ্গে এখন ষোলো বছরের শুভর আরও বেশি ভাব। পড়ার ফাঁকে ক্রিকেট খেলে শুভ।

হামিদ ভাইকে দেখে শুভরও ওই রকম পেশিবহুল শরীর চাই। শুনে হেসে গড়ায় হামিদ। শুভর এখন হামিদ ভাইয়ের সঙ্গেও সপ্তাহে দুদিন গল্প করা চাই-ই চাই। সিরাজ-কাজল দূর থেকে ছেলের কাণ্ড দেখে হাসেন।

মধ্যবয়সী শামস-লাইলি এখন আগের থেকে একটু ধীর হয়েছেন কাজে-কর্মে। একটু স্থূলও হয়েছেন বটে। লাইলি এখনো দূরশিক্ষণে অর্থনীতি পড়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের। শামসুজ্জামান এখনো ব্যাংকেই। তবে পদোন্নতির জোরে ওনার পদমর্যাদাটি আগের তুলনায় বেশ উঁচু।

শেফালি কিছুদিন আগে বাজার করতে গিয়ে পিছলে পড়ে পায়ের হাড় ভেঙেছেন। ফলে এখন শেফালির ঠিকানা হুইলচেয়ার আর কৃষ্ণার কড়া নজরদারি। হাসপাতালে যোগ দেবে কৃষ্ণা মাস সাতেক পর। তাই এখন খালামণির ওপরেই নার্সিংয়ের যত খুঁটিনাটি চর্চা করে নিচ্ছে কৃষ্ণা।

লাইলি বোনকে বলেন, এ দেশ বলে রক্ষা। এখানে শুধু হুইলচেয়ার নয়, সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের জন্যই যে কত রকম সুবিধা! বাংলাদেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা মানে হাজার রকম ভোগান্তি।

ছাব্বিশের হামিদ এখন আরও চৌকস। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফাঁকে চাকরি করে হামিদ। সে মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই রাগায় তার মনের মানসীকে, ‘তোর হরেক রকম পোশাক পরার দিন তো শেষ রে কৃষ্ণা! কেবল নার্সের ইউনিফর্ম জুটেছে কপালে!’

জবাবে হামিদের পিঠে দুমদাম কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেয় কৃষ্ণা। ‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আমি কারাতেতে ব্ল্যাক বেল্ট। খেয়াল আছে তো তোর? এক প্যাঁচে উল্টে ফেলে দেব, তখন কেঁদে কূল পাবি না!’

ঠোঁট উল্টায় হামিদ। ‘ইশ্‌! পালোয়ান একেবারে। আমাকে উল্টে ফেলে নিজে ঠিক থাকতে পারবি তো তুই?’

এ ক্ষেত্রে আবেগকে লুকিয়ে ফেলতে পারল কৃষ্ণা। ‘নার্সিং আমার পেশা। আর পোশাকটাকেও সম্মান করি। সাজের সময় ইচ্ছামতো সাজব, কাজের সময় নয়।’

হামিদের দৃষ্টিতে কৌতুক, ‘তুই বিয়ের সময় কনে সাজবি তো?’

‘আরে থাম থাম...বিয়ের এখনো কুড়ির বাকি আঠারো। আর উনি আছেন কনের সাজ নিয়ে! তোকে পাগড়ি পরলে কেমন দেখাবে সেটা ভাবছি।’

‘হুম্‌, জানি। হাসপাতালে কাজ শুরু হলে তুই আমাকে ভুলেই যাবি।’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ হামিদের।

‘ভুলব, তাই না? ভুলেই গেলাম, দূরে গিয়া মর গা, যাহ!’

‘ওমা, এ কী ভাষা রে তোর, কৃষ্ণা?’ হামিদের চোখ কপালে।

উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়ে কৃষ্ণা। ‘মা বকে পাপাকে এই ভাষায়। আমি একটু মাকে নকল করলাম।’

হামিদের অফিসের বাইরে বাঙালি দোকানে বসে সরষে-ইলিশ খাচ্ছিল দুজন। কাঁটাওয়ালা মাছ মানেই হামিদের বায়না। কাঁটা বাছতে পারব না আমি, খাইয়ে দে! দুজনের খুনসুটি দেখে অনেকেই বুড়ো আঙুল দেখায় ওদের। যার অর্থ, বেশ চলছে, চালিয়ে যাও!

কৃষ্ণার কাছে আমেরিকায় খাবার মানেই বাদাম। পেস্তা, কাঠবাদাম, কাজু অথবা শুকনো ফল। এখানকার পিৎজা, সোডা, চিপস, রুট বিয়ার, স্পারক্লিং ওয়াটার...এসবে পোষায় না ওদের। লাইলি বাড়িতেই সব খাবার বানান মেয়ের জন্য।

কৃষ্ণা যতই খাক, শরীরে মেদ জমতে দেয় না মোটেও। এ দেশে অনেক রোগের মূল কারণই যে স্থূলতা, কৃষ্ণা সেটা ভালো করেই জানে। তাই গাড়ি চালালেও সুযোগ পেলেই সাইকেল টুংটাং করে ঘুরে বেড়ায় কৃষ্ণা। সে সাঁতরাতেও বেশ ভালোবাসে।

অন্যদিকে, পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির হামিদ মার্কিন নাগরিকদের মতো অতটা লম্বা না হলেও সে পরিচিত মহলে বেশ জনপ্রিয়। ছয় থেকে ছেষট্টি, সব বয়সীদের সঙ্গেই সমানভাবে মিশতে জানে হামিদ।

কৃষ্ণার মতো তোড়ারও এখন তেইশ। সে কিছুটা সরে এসেছে মাদক থেকে। তবু সম্পূর্ণ ছাড়তে পারেনি। সেই বসে যাওয়া চোয়াল একটু ভরেছে। নতুন ছোট চুলের স্টাইলে খুব একটা খারাপ লাগে না। লেখাপড়ায় হামিদ কৃষ্ণার মতো অতটা তুখোড় নয় তোড়া। চলনসই বলা যায়। এখনো সেই হামিদের গায়ে পড়া স্বভাব তোড়ার। হামিদ যতই সরে থাকুক না কেন। কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে ফিরে যাবে তোড়া।

কৃষ্ণার জন্মের আগে থেকে শ্বশুর কামরুজ্জামানের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলেছিল লাইলির। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই চোখ বুজেছিলেন কামরুজ্জামান। তবে মৃত্যুর আগে নিজের সঞ্চয়ের একটা অংশ করে গেছেন নাতনি কৃষ্ণার নামে। দাদার দেওয়া সেই উপহারেই চলেছে কৃষ্ণার নার্সিং পড়ার খরচ। জীবনের বড় একটা সময়জুড়ে সেবিকা ছিলেন শাহিনা। দাদির দেখানো পথেই হেঁটেছে কৃষ্ণা।

টফির বয়স কিছুটা বাড়ার পর তার জন্য সঙ্গিনী ব্রাউনিকে কিনে এনেছিল কৃষ্ণা। ব্রাউনি সোনালি আর খয়েরি মেশানো ছয়টা ফুটফুটে ছানার জন্ম দিয়েছিল। বন্ধুদের দিয়ে–থুয়ে সেই ছানার দুটো আছে এখন। টফি ব্রাউনি দুজনই বেশ বয়স্ক। নিয়মিত পশুচিকিৎসক দেখানো হয় তাদের।

সেদিন পরিচিত একজনের বিয়ের দাওয়াত। কৃষ্ণার পরীক্ষা থাকায় সে যেতে চাইলেও পারল না। যার বিয়ে, সেই ভদ্রলোক দুই পরিবারেরই পরিচিত হওয়ায় হামিদের পরিবারেরও দাওয়াত ছিল। কৃষ্ণার পরীক্ষা মানে ক্ষত সেলাই, বিভিন্ন আঘাতের প্রাথমিক চিকিৎসা—এসব দেখাতে হয়। কৃষ্ণা একমনে চর্চা করছিল সেসবের।

আচমকা একটানা মোবাইলের রিংয়ের শব্দে মনোযোগ হারাল কৃষ্ণা—‘হ্যালো!’

কর্কশ, অস্বস্তিকর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে। ‘কী রে, কালা পেতনি, ভাবস হামিদ ভালোবাসে তোরে? হামিদের আসল রূপ দেখবার চাইলে এক্ষণ হামিদের বাড়ি আয়।’

বিরক্তি চেপে রাখার চেষ্টা করল না কৃষ্ণা। ‘কী যা-তা বলছেন? কে আপনি?’

‘আমি তোর আম্মা লাগি ছেমড়ি, এক্ষণ আয়।’

খটকা লাগল কৃষ্ণার। এ ভাষায় তো কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না, কারও কোনো বিপদ হলো নাকি?

পাশাপাশি বাড়ি। সাত মিনিটের রাস্তা মাত্র। সদর দরজা খোলা দেখে কেমন সন্দেহ হলো কৃষ্ণার। হামিদের ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা দৃশ্যটির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কৃষ্ণা। ওর মন বারবার বলতে লাগল, না! সেই ছোট্টবেলা থেকে যে হামিদকে আমি জানি, সে এমন কাজ করতে পারে না! তবে কৃষ্ণা নিজের চোখকেই-বা অবিশ্বাস করে কী করে? ওর পায়ের তলার মাটি দুলে উঠল যেন! (আগামী পর্বে সমাপ্য)

দ্রষ্টব্য: পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, ঠিক কোন ধরনের মুহূর্তে নিজের প্রেমিককে দেখলে কৃষ্ণার বয়সী প্রেমিকার পৃথিবী দুলে উঠতে পারে। এটুকু আমি পাঠকের কল্পনার ওপর ছাড়ছি। গল্পটা কেমন লাগছে আপনাদের? আমাকে চাইলে জানাতে পারেন। ই-মেইল: <[email protected]>। খুব তাড়াতাড়িই আসব শেষ পর্বটি নিয়ে। কৃষ্ণাকে এতটা ভালোবাসা দেওয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ আপনাদের।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন