অনীকের অন্তর্ধান ও এন্ডির মতিভ্রম

উইলিয়াম ট্যারল। ছবি: দ্য অস্ট্রেলিয়ান
উইলিয়াম ট্যারল। ছবি: দ্য অস্ট্রেলিয়ান

সপ্তাহান্তের পত্রিকাতে খবরটা দেখে বহু বছর আগে এ পাড়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সবারই একটু-আধটু মনে পড়ল।

সেবার যখন স্কুলে গরমের দীর্ঘ ছুটি শুরু হলো, ঠিক সে সময়ে অনীকরাও এই পাড়ায় বাড়ি কিনে উঠল। পাড়াপড়শির সবার পছন্দের প্রতিবেশী এন্ডির সঙ্গেও তাদের পরিচয় হলো। তার স্ত্রী মারা গেছে আট-নয় বছর হয়।

এন্ডির বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে তখন। অবসরজীবনে নিঃসন্তান মানুষটি নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের নানা কাজে হাত লাগায়। কারওও গাছ ছাঁটতে বা কারওর ঘাস কাটতে সে হাসিমুখে এগিয়ে যায়।

বয়সের তুলনায় সে এখনো বেশ শক্ত ও কর্মপ্রিয় একজন মানুষ। অলস সময় কাটায় না মোটেও। পড়শিরাও তাকে নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ডাকে। এই পাড়াতে অনেক দেশ, অনেক জাত, অনেক ধর্মের মানুষ বাস করে। এন্ডি বোস সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। সেও মিশুক স্বভাবের। তাই সবার সঙ্গে মিশতে সে পছন্দ করে।

বাড়ি কেনা, বাড়ি পাল্টানোর খরচের ঝামেলায় অনীকের পরিবার ওই বছরে বেড়াতে যাওয়া বাদ দিয়েছে। অনীক নতুন বাড়িতে এসে খুশি। আগে শহরের ছোট এক অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ছিল তারা। এখন বাগান ও উঠোন নিয়ে খোলামেলা বাড়ি। পাড়াটাও ছিমছাম।

এন্ডির সঙ্গে পাড়ার নানা গলিতে ঘুরে ঘুরে পাড়াটা চেনার চেষ্টা করছে প্রাইমারি স্কুল শেষ করা ছাত্র অনীক। পড়শি এন্ডি তাদের ঝোপঝাড় কেটেছেঁটে বাড়ির চেহারা সুন্দর করে দিয়েছে। অনীকের বাবার সঙ্গে ছুটির দিনে বারান্দায় বসে চা-কফি পান ও বাদাম-চিপস খেতে খেতে কত কত গল্প করে।

চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরে পাড়ার কত রূপ পাল্টেছে—সেসব কথা এন্ডি ওদের শোনায়। এন্ডি তার বোস পদবির ইতিহাস বলেছে ওদের। তার দাদা, বোস যার পদবি, তিনি ভারত বা ফিজি থেকে নৌকায় করে এসে এদেশীয় মেয়েকে বিয়ে করে ঘরসংসার পাতেন। তাই তারও পদবি বোস।

শান্তশিষ্ট অনীক চারপাশের সব জিনিস খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে ভালোবাসে। এন্ডির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে অনীক এরই মাঝে আশপাশের বাড়িগুলোর কোনটাতে কী কী গাছ, সব মোটামুটি জেনে ফেলেছে।

এক বাড়িতে দেখল শুধুই গোলাপগাছ। গাছভর্তি ফুল ফুটে আছে। সে বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে মৃদু ঝাপটা দিয়ে যায়। সেই বাড়ির মালিক রোজমেরিও এন্ডির খুব চেনা। অনীককে তার সঙ্গে দেখে ডেকে কথা বলল। গোলাপের ডাল থেকে তৈরি একটি চারা অনীকের হাতে দিয়ে বললেন, তোমার মায়ের জন্য সুগন্ধী গোলাপ চারা।

অনীক মহাখুশি হয়ে চারা নিয়ে বাড়ি ফিরল। মা চারা পেয়ে খুশি হয়ে বললেন, রোজমেরির সঙ্গে যখন দেখা করতে যাব, তখন একটা চকলেটের বক্স নিয়ে যাব, বুঝলি অনীক।

পাড়ার একটা গলিতে দুই পাশের রাস্তায় বেশ বড় বড় গাছ। একজন মানুষ দুই হাত দিয়ে একটা গাছকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না।

অনীক বলল, এন্ডি, চলো তো দেখি দুজনের চার হাত দিয়ে গাছকে ঘিরে ধরতে পারি কি না।

: চলো দেখি।

দুজনে মিলে গাছ ঘিরে ধরার খেলা খেলল আধাবেলা। কোনো কোনো গাছ ছিল সত্যিই বেশ মোটাসোটা। অনীক গাছগুলো গুনে দেখল। একপাশের নেচার স্ট্রিপে ছিল দশটা। অন্যপাশে ছিল এগারোটা গাছ। অনীকের গাছ গণনার কাজে এন্ডিও যোগ দিল।

: জানো অনীক, এ পাড়ার সবচেয়ে পুরোনো দিক এটা। গাছগুলোও তাই বিশাল বিশাল সব।

কয়েক দিন পর ওই একই রাস্তায় এক আশ্চর্য বিষয় দেখে অনীক অবাক। এন্ডিকে ডেকে উত্তেজিত গলায় অনীক বলল, ‘দেখো, দেখো এন্ডি, কী অবাক কাণ্ড।

: কী? কী হয়েছে?

: একটা গাছ উধাও।

: কোথা থেকে? কীভাবে উধাও?

: এই যে রাস্তার এক পাশে এগারোটা গাছ ছিল। আর অন্য পাশে দশটা ছিল। এখন দেখ একটা গাছ নেই।

: কোন গাছটা নেই?

: বুঝতে পারছি না।

এন্ডি এবার আগ্রহ নিয়ে রাস্তার দুই পাশে টহল দিল কয়েকবার। সে আর অনীক দুজনে মিলে আবার গাছগুলো গুনল। নাহ্, কোনো ভুল নেই। গাছ দশটা করেই আছে। তবে একটা গাছ সত্যিই সত্যিই চলে গেছে। সব জায়গা ঘাসে ঢাকা। কোনখানে শিকড় ওপড়ানোর চিহ্নমাত্র না রেখে গাছটা চলে গেছে। বেশ কিছুটা সময় তারা ব্যয় করল বিষয়টা বুঝতে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সব সময়ই যেন রাস্তার দুই পাশে এ রকম দশটি করেই গাছ ছিল বা আছে। তবে ওরা জানে, গত সপ্তাহে ওরাই দশটা একপাশে, এগারোটা অন্য পাশে গুনে দেখেছে। তবে কোন পাশে দশটা আর কোন পাশে এগারোটা গাছ ছিল মনে করতে পারছিল না।

হঠাৎ অনীক একটা বুদ্ধি আটল, এন্ডি, আমরা এখন গাছ নিয়ে কাউকে কিছু বলব না। আগামী সপ্তাহে আবার এসে দেখব গাছগুলো। তারপর ভাবব।

: ঠিক আছে অনীক, তাই হবে।

: আমরা আগামী সোমবারে আবার এই রাস্তায় আসব, ঠিক আছে।

এন্ডি মজা করে গম্ভীর স্বরে বলল, ঠিক আছে বস, তা–ই হবে।

কথামতো পরের সোমবারে ওরা দুজন আবার সেই রাস্তায় ঘুরতে গেল। শুরু হলো তাদের গাছের তথ্য–তালাশ করার কাজ। অবাক কাণ্ড! দেখা গেল রাস্তার দুই পাশে সব মিলিয়ে একুশটা গাছ রয়েছে। একপাশে এগারোটা, অপর পাশে দশটা। সমস্যা হলো কোন গাছটা যে উধাও হয়েছিল আর এখন আবার ফিরেও এসেছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ওরা পড়ল ধন্দে। অনীক এবার কাগজ-কলম নিয়ে এসেছিল। ছোট ছোট করে কাগজ কেটে নম্বর লিখল। সে নম্বরগুলো একেকটা গাছের গায়ে গ্লু দিয়ে সেঁটে দিল।

তারপর অনীক গাছের নিচে বসেই একটি চিঠি লিখল। চিঠিতে এই কয় দিনে ওরা গাছ নিয়ে যা যা দেখেছে, সব বৃত্তান্ত নিখুঁতভাবে লিখল। এন্ডি লেখাপড়া তেমন জানে না। সে বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামল না। জানতে চাইল, কাকে পাঠাবে চিঠি? আকাশের ঠিকানায়, নাকি পুলিশকে?

: দেখি। মনে হয় বিষয়টা বিজ্ঞানীদের জানাতে হবে।

: ওরা কোথায় থাকে?

: ওদের ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। তবে এন্ডি এখনো বিষয়টা কাউকে বলবে না।

: বলব না।

তারপর ঘটল দুঃখজনক এক ঘটনা। এক বিকেলে অনীককে খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রথমে আত্মীয়-বন্ধু, পাড়াপড়শি সবাই মিলে খুঁজল। না পেয়ে পুলিশে খবর দেওয়া হলো। পুলিশ চারপাশ তোলপাড় করে খুঁজল। কোনোভাবেই অনীকের সন্ধান পাওয়া গেল না। মানুষের ফিসফাস কথাবার্তা শুনে এন্ডির ওপর পুলিশের নজর পড়ল। একদিন জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ এন্ডিকে ডেকে নিয়ে গেল। মাসখানেক পর এন্ডি ফিরে এল। সে এক অন্য এন্ডি। কেমন জানি আপনভোলা কখনো। কখনোবা মতিচ্ছন্ন।

গুজব শোনা গিয়েছিল পুলিশের কড়া পাহারা থেকে এন্ডি একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার পুলিশের হেফাজতেই ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে এক অদ্ভুত গল্প বলেছিল। সে এমন এক জায়গায় গিয়েছিল, যেখানে সে আকাশে দুটি চাঁদ দেখেছিল। সেখানে সে অনীককেও দূর থেকে দেখেছে। কাছে যেতে পারেনি। কীভাবে সে ওখানে গিয়েছিল আর কীভাবেই–বা ফিরে এসেছে, তার কিছুই সে মনে করতে পারে না। বিষয়টা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। শোনা যায়, কয়েকজন পুলিশকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয় পর্যন্ত। কোনো এক সময়ে অনীকের পরিবার ওই পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

এরপর থেকে এন্ডি নিখোঁজ হওয়া মানুষ নিয়ে নানা ঘটনা শুনত ও শোনাতও সবাইকে। পাড়ার বাচ্চারাও গল্পগুলো শুনতে চাইত।

: অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবছরই অনেক মানুষ হারিয়ে যায়।

একটি ছোট্ট ছেলে জানতে চাইল, কোথায় যায় তারা?

: কেউ জানে না।

আরেকটি মেয়ে বলল, পুলিশ কেন তাদের খুঁজে বের করে না?

: পুলিশ চেষ্টা করলেও পারে না।

আরেকজন বলল, বোধ হয় আকাশ থেকে এলিয়েন এসে নিয়ে যায়। এন্ডি, তোমাকেও তো একবার নিয়ে গিয়েছিল।

: হ্যাঁ, আমি ওখানে আকাশে দুটি চাঁদ দেখেছি।

বুদ্ধিমতী ছোট্ট মেয়েটি বলল, আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে।

: তুমি জানলে কীভাবে? আমিই তো জানি না আমি কোথায় গিয়েছিলাম।

: দুটি চাঁদ আছে মঙ্গলগ্রহে। তুমি ওখানেই গিয়েছিলে, এন্ডি।

মেয়ের কথা শুনে এন্ডি মাথা চুলকাল। এন্ডি জানেই না মঙ্গলগ্রহ কোথায় আছে। দুই চাঁদই–বা কেন থাকবে। শুধু জানে প্রতিবছর তার দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়।

সে সময়ে যে বাচ্চারা ছোট্ট ছিল, তারা আজ বুড়োবুড়ি হয়েছে। খবরের কাগজে এখন যখন উইলিয়াম ট্যারলের খবরটা পড়ল, তাদের মনে পড়ল অনীকের নিখোঁজ হওয়ার কথা।

ছোট্ট উইলিয়াম। তার বয়স মাত্র তিন বছর। তিন বছরের জীবন তার নানা ঘটনায় ঠাসা। জন্ম থেকেই ওর কপালে বিড়ম্বনার শুরু। উইলিয়ামের জন্মদাতা মা-বাবা তেমন দায়িত্বশীল ও সুবিধার মানুষ ছিল না। তাই জন্মের পর পরই সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তর উইলিয়ামকে নিয়ে আসে। তাকে এক পরিবারে পালক দেওয়া হয়। তারাও তেমন সুবিধার মানুষ ছিল না। এভাবে দুটি কি তিনটি পরিবারের আশ্রয় বদল করে শেষে এক যত্নশীল পরিবারে সে ঠাঁই পায়।

এবারের পালক মা উইলিয়ামকে নিয়ে একবার পালক নানির বাড়ি বেড়াতে যায়। নিরিবিলি শান্ত এক গ্রামে নানির বাড়ি। উইলিয়াম এক সকালে পালক মায়ের সঙ্গে খেলাধুলা করছিল। পর মুহূর্তে বাড়ির সামনে থেকে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। সময়টা ছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। পত্রিকা লিখেছে, পুলিশেরা শত চেষ্টা করেও পারছে না উইলিয়ামের খোঁজ পেতে। ঘোষণা হয়েছে উইলিয়ামের খবর এনে দিলে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। এমনকি পৃথিবীর সব এক্সপার্ট মাথা ঘামিয়েও উধাও উইলিয়ামের কোনো হদিস বের করতে পারেনি। কোথায় সে আছে, নাকি নেই, কেউ জানে না।

অনীকের পাড়ার লোকজন দ্য অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকায় খবর দেখে ভাবে, উইলিয়ামও কি অন্য কোনো গ্রহে আছে? এন্ডির মতো কেউ একজন থাকলে আকাশে উধাও হয়ে যেত হয়তো বা উইলিয়ামের দেখা পেত।

(গল্পটি উৎসর্গ করা হলো ছোট্ট উইলিয়াম ট্যারলকে)