আমাজনের বৃক্ষ হ্রাসে পৃথিবীর বিপদ

গত বছর আট মাসে আমাজনে ৭৪ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: রয়টার্স
গত বছর আট মাসে আমাজনে ৭৪ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: রয়টার্স

আমাজন পৃথিবীর বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট। আমাজনকে অনেক সময় পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। কারণ, এটি পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড দূর করে মানুষ-পশুপাখি সবার নিশ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে।

আমাজনে অনেক বিরল প্রজাতির সাপ, বানর, মাকড়সা, অর্কিড আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, রেইন ফরেস্ট বিভিন্নভাবে স্থানীয় ও সমগ্র পৃথিবীর পরিবেশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।

রেইন ফরেস্ট আমাজন বেসিনে আর্দ্রতা সরবরাহ করে। সমুদ্রপৃষ্টের বাতাস বিষুবীয় আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আর্দ্রতা নিয়ে আসে আমাজনে। কিছু আর্দ্রতা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বিষুবীয় অঞ্চলের গাছের পাতা ও মাটি থেকেও জলীয় বাষ্প বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়। এই জলীয় বাষ্প হয় আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে বা কাছাকাছি এলাকায় ভেসে যায়।

আমাজনের জঙ্গলে ৩০ থেকে ৭০ ভাগ বৃষ্টি হয় রেইন ফরেস্ট থেকে যে বাষ্প নিঃসরণ হয় সেটা থেকে। রেইন ফরেস্ট তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এসবকে প্রভাবিত করতে পারে এবং নিজস্ব জলবায়ু তৈরি করে।

রেইন ফরেস্ট উজাড় হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের হার আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাবে। বৃষ্টিপাতের চক্র বিঘ্নিত হবে। এতে ওই অঞ্চলের জলবায়ু শুষ্ক ও উষ্ণ হয়ে যাবে। এর কারণে আগুন লেগে যাওয়ার ভয় বাড়বে। মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পাবে।

কয়েক বছর ধরে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কবলে পড়েছে আমাজন। ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৬ সালে খরা, ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালে বন্যা কিছু কঠিন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের জীবন এবং পশুপাখি ও গাছপালার জীবনে, তথা ইকো সিস্টেমে কীভাবে প্রভাব ফেলে।

বিগত ১২ বছরের তুলনায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে ৩৬ ভাগ। শুষ্ক ঋতুর স্থায়িত্ব বেড়েছে তিন থেকে চার সপ্তাহের বেশি। এই দীর্ঘ শুষ্কতা আগুন লাগার প্রধান কারণ। ভবিষ্যতে আরও উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় অগ্নিকাণ্ড আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যার ফলে মানুষ এবং আমাজনের বিরল সব প্রাণীর জীবনের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

বিজ্ঞানীরা গণিতের সাহায্যে বের করতে চেষ্টা করছেন কীভাবে ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন হতে পারে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাকে তাঁরা সমীকরণে ফেলে এই সমস্যার সমাধান করছেন। যেমন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, গাছের ঘনত্ব, বায়ু এবং এদের মধ্যে কী পরিমাণ তাপমাত্রার আদান-প্রদান হয় এসব। এই মডেলগুলো দেখিয়েছে যে মধ্য ও পূর্ব আমাজন খুব শিগগির বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে যাবে।

ব্রাজিলের বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনেস সালাতি ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে আমাজনে পানির সমতা থাকে। বেশির ভাগ পানি আসে বৃষ্টিপাত থেকে এবং এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় আর্দ্রতা চক্র।

আরেকজন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, এই চক্রের কারণেই সুবিশাল এই জঙ্গল আজও টিকে আছে। ২ লাখ ৩০ হাজার ঘন মিটার জলীয় বাষ্প সমুদ্র থেকে এই চক্রের মাধ্যমে আসে, যা প্রায় পুরা আমাজন নদীর পানির সমান, যা সমুদ্রে যায়।

গাছপালা কেটে ফেললে পরিবেশে আর্দ্রতা কমে যাবে। আর্দ্রতা চক্র ভেঙে যায়। যে পরিমাণ আর্দ্রতা বা জলীয় বাষ্প আসত, তার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। আমাজন জঙ্গল উজাড় হয়ে গেলে তার প্রভাব আমেরিকা, এমনকি চীনেও পড়বে। আমাজনের একটা অংশের গাছ কেটে ফেললে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রধানত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় বৃষ্টিপাত কমে যাবে। এতটাই কমে যাবে যে চাষিরা চাষাবাদ করতে পারবেন না। অর্থাৎ মানুষ ও অন্য প্রাণীর খাদ্যের ঘাটতি পড়বে।

এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলাফলই হলো বিশ্ব উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) বা পৃথিবীর সার্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। এই শতাব্দীর শুরুতেই অনেক বিজ্ঞানী এ ব্যাপারে সাবধান করেছিলেন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে।

যেহেতু জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের জীবন ও চারপাশের পরিবেশে অনেক ক্ষতি করতে পারে, তাই পৃথিবীর সব দেশেই গাছ কাটা ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আইন থাকা দরকার।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবীর অনেক দেশ প্যারিসে এ ব্যাপারে একটি কনফারেন্সে মিলিত হয়, যেখানে পৃথিবীর জলবায়ু সম্পর্কে প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। সবাই এ ব্যাপারে একমত হয় যে রাষ্ট্রগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ও বৃক্ষ হ্রাসকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই অনুযায়ী চললে আগামী দশকগুলোতে বিশ্ব উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে না, যেটা ওপরে বর্ণিত আশঙ্কাগুলোকে রোধ করতে প্রয়োজন।

সূত্র: Frontiers for young minds (frontiersin.org/)