পিএইচডি জালিয়াতির দায় কার

পিএইচডি জালিয়াতির দায় কার
পিএইচডি জালিয়াতির দায় কার

আমি পিএইচডি করে দেশে ফেরার পর আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করতেন, পিএইচডি করে কী শিখলা?

আমার সহজ উত্তর ছিল, আমার জ্ঞান যে খুব সীমিত, তা জানতে পারছি আর একটা ডিগ্রি যুক্ত হয়েছে নামের সঙ্গে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রথম সপ্তাহে আমি মাস্টার্সের ক্লাস নিয়েছি। আমার সামনে বসা আমার থেকে এক কিংবা দুই বছরের ছোট তরুণ শিক্ষার্থীদের কী পড়িয়েছি, তা মনে না থাকলেও আমি পিএইচডি করে যাওয়ার পর মাস্টার্সের ক্লাস নিতে সাহস করতাম না।

আন্ডারগ্রেডের শিক্ষার্থী আর মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য আছে—এটা এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। দায়সারাভাবে একজন প্রভাষককে (লেকচারার) মাস্টার্সের ক্লাস নিতে হলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান যেমন বাড়ে না, তেমনি তারা তাদের ভবিষ্যৎ কাজ সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে মাস্টার্স লেভেল থেকে মাঝেমধ্যে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে সাধারণ কর্মজীবনে মাস্টার্সের গুরুত্ব না থাকলেও যাঁরা পরবর্তী সময়ে গবেষণা, বিশেষ করে পিএইচডি করতে চান, তাঁদের জন্য মাস্টার্স ডিগ্রি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে পিএইচডি জালিয়াতি নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তা আমরা খুব সহজে গবেষণানির্ভর মাস্টার্স কোর্স প্রণয়নের মাধ্যমে দূর করতে পারি। এ ছাড়া পিএইচডি ও পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে কিছু কথা আমার এই লেখায় উল্লেখ করলাম।

পিএইচডি করার সময় পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক সিলেকশন খুবই জরুরি বিষয়। একজন ভুল তত্ত্বাবধায়ক সিলেকশন আপনার জীবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আমার কাছে পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক মূলত তিন ধরনের।

ক. কঠোর তত্ত্বাবধায়ক। আপনি যদি খুব মেধাবী না হন, কিন্তু পড়ুয়া ছাত্র হন, তবে তাঁদের কাছে পিএইচডি করুন। তাঁরা সব কাজ নিজের হাতে করতে পছন্দ করেন। ফলে আপনার সামাজিক জীবন হুমকির মুখে পড়লেও আপনার পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে চিন্তা করবেন না। ডিগ্রির সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজ শেখা ও ভালো পাবলিকেশন গ্যারান্টি পাবেন।

খ. ভালো তত্ত্বাবধায়ক। তাঁরা আপনার সামাজিক জীবন অথবা লাবের কাজ নিয়ে আপনাকে কিছু বলবেন না। নির্দিষ্ট সময় পরপর তাঁদের আপনার কাজের অগ্রগতি জানালেই চলবে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে আপনাকে অনেক মেধাবী হতে হবে। কাজে ফাঁকিবাজি করা যাবে না। কাজ করার জন্য যাবতীয় সহায়তা তাঁরা করবেন। কিন্তু সব পরিকল্পনা আপনার করতে হবে। আপনি যদি সচেতন না হন, দিন শেষে আপনার কাজ শেখা হবে না। ডিগ্রি হলেও হতে পারে।

গ. উদাসীন তত্ত্বাবধায়ক। তাঁরা আপনার কোনো দায়িত্ব নেবেন না। কাজের শুরুতে এবং শেষে তাঁদের দেখা পাবেন। কাজের মধ্যে তাঁদের দেখা পাবেন না। আপনার পেপার পাবলিকেশন-ডিগ্রি নির্ভর করবে তাঁদের মর্জির ওপর। মাঝেমধ্যে তাঁরা স্বাভাবিক সময় থেকে অনেক পরে ডিগ্রির জন্য সুযোগ দিয়ে থাকেন। সময় থাকতে তাঁদের ত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এই তিন ধরনের বাইরে আরও কিছু ধরনের তত্ত্বাবধায়ক আছেন, যাঁদের মাঝে অন্যতম অযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক। তাঁরা ক্ষমতা, লোভ-লালসার জন্য যোগ্য কিংবা অযোগ্য শিক্ষার্থীদের অযোগ্য বানিয়ে ডিগ্রি দিয়ে থাকেন।

বলা হয় PhD Boss is always right? এ কথাটা আমি প্রথম বুঝতে শিখি যখন আমি আমার জীবনের প্রথম ওরাল প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা প্রেজেন্টেশন আমার পিএইচডির বসকে দিই। ১৮তম বার কারেকশন করার পর যখন প্রফেসর আমাকে বলেন, এখন মোটামুটি হয়েছে। তখন খারাপ লাগলেও পরে যখন প্রথমটার সঙ্গে মিলিয়েছি, তখন বুঝতে পেরেছি, কেন তিনি আমার বস।

পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার জন্য আপনাকে প্রফেসর হলেই চলবে না, হতে হবে জ্ঞানী, আদর্শ ও নীতিমান গবেষক।

২০১২ সালে জাপানিজ প্রফেসর ইয়ামানাকা আইপিএস কোষের ওপর গবেষণা করে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। একই রকম গবেষণার জন্য বিখ্যাত আরেকজন গবেষক ছিলেন প্রফেসর ইয়োশিকি সসাই, যিনি আইপিএস কোষের সহায়তাই কীভাবে মানব অঙ্গ বানানো যায়, তা নিয়ে কাজ করতেন।

প্রফেসর সসাই ২০১৪ সালে আত্মহত্যা করেন তাঁর নিজের হাতে গড়া গবেষণাগারে। ধারণা করা হয়, তাঁর ছাত্রী হারুকো ওবোকাতারকে অপর্যাপ্ত তদারকির জন্য সমালোচিত হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যদিও আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়; কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, গবেষণা ও তত্ত্বাবধান একজন শিক্ষক ও গবেষকের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে পিএইচডি কারা করেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (অধিকাংশই পদোন্নতির জন্য) অথবা ইদানীং টাকায় ডিগ্রি পাওয়া যায় তাই মধ্যম বা শেষ বয়সের সরকারি কর্মকর্তারা। মোদ্দাকথা হলো, আমাদের দেশে পিএইচডি গবেষক বলতে একশ্রেণির প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের বোঝায়। এরাও যে শিক্ষার্থী, এটা আমাদের মাথায় আসে না। এ জন্য আমরা পিএইচডি জালিয়াতির জন্য ছাত্রকে ধরি। তত্ত্বাবধায়কে নামে মাত্র দোষ দিয়ে থাকি।

ধরা যাক, আমি আমার পিএইচডি ছাত্রকে বললাম, বাংলাদেশে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে ব্যবহার করা হয়—এমন পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিকের নাম লিখে নিয়ে আসবে। অনেক গবেষণার পর ছাত্রটি লিখল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সেফালোস্পোরিন, অ্যাসাইক্লোভির, প্যারাসিটামল ও অ্যাসপিরিন।

ব্যাখ্যায় সে উল্লেখ করল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধ। এক সেফালোস্পোরিন দিয়ে অনেক ড্রাগ কভার করছি। অন্যদিকে, মাঝেমধ্যে ডাক্তার ভুল করে ভাইরাল ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক দেন তাই অ্যাসাইক্লোভির রাখছি। আর ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে জ্বর ও ব্যথা থাকে, তাই প্যারাসিটামল বা অ্যাসপিরিন।

এখন আমি যদি তার সুন্দর উপস্থাপনায় খুশি হয়ে পাস করিয়ে দিই এবং পরবর্তী সময়ে সে যদি দাবি করে অ্যাসাইক্লোভির, প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন—এগুলো একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, এর জন্য দায়ী কে হবে?

আমার এক সহগবেষকের পিএইচডির চূড়ান্ত উপস্থাপনার শেষে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আজকে তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার ছাত্রজীবন শেষ করলে। পিএইচডি ডিগ্রি একজন ছাত্রের চূড়ান্ত সম্মাননা। আর এই পিএইচডি ডিগ্রিতে যদি কোনো জালিয়াতি হয়, এর জন্য প্রথমে দায়ী তার তত্ত্বাবধায়ক। দ্বিতীয়ত দায়ী সিস্টেম (ইভ্যালুয়েশন সিস্টেম, পরীক্ষক)। সবশেষে ছাত্র। আমরা যদি আগের দুজনকে না ধরে ছাত্রটিকে দোষারোপ করতে থাকি, তাহলে এ জালিয়াতি কমবে না, বাড়তে থাকবে।

ড. মো. আরিফুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক (বিশেষভাবে নিযুক্ত), ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।