পিএইচডি জালিয়াতি: তত্ত্বাবধায়কের দায়

পিএইচডি জালিয়াতির দায় তত্ত্বাবধায়ক এড়াতে পারেন না
পিএইচডি জালিয়াতির দায় তত্ত্বাবধায়ক এড়াতে পারেন না

বাংলাদেশ থেকে আমাকে প্রায়ই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। না, পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রশ্ন নয়। বাংলাদেশের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আমি লিখি না কেন। সে প্রশ্ন।

লিখতে যে চাই না, তা নয়। বরং লিখতেই ইচ্ছা করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটনা এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে পরিসংখ্যানবিষয়ক গবেষণাকর্ম, শিক্ষকতা, আর পারিবারিক জীবনের বলয় থেকে সময় বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। একটা ইস্যু নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আরেকটা চলে আসে সামনে।

যেকোনো মৌলিক লেখার জন্য সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে উপাত্ত ঘেঁটে লেখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। অবশ্য নিন্দুকেরা বলবেন, এটা অক্ষম লোকের বানানো অজুহাত। যেখানে দেড় বছরে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখা সম্ভব, সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা নিয়ে দুই পাতা লেখা এ আর এমন কী!

তা ঠিক, তা ঠিক। আমার অনেক ছাত্রবন্ধু হরহামেশা ফেসবুকে খুব সুন্দর পোস্ট দেন। আমি অনেকের লেখাগুলো মন দিয়ে পড়ি। ভারী সুন্দর অর্থবহ লেখা। সেসব পোস্ট থেকে দু-একখানা কপি করে দিলেই তো হয়ে যায়। কন্ট্রোল এ, কন্ট্রোল সি, কন্ট্রোল ভি। ব্যস।

এ করতে কারও কেমন করে দেড় বছর লাগল, মাথায় ঢোকে না। না ঢোকারই কথা। দেড় বছরে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লিখতে পারিনি, কাজেই মাথা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা খুব একটা সরেস করে বানাননি।

যাকগে। সেই মোটা মাথা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। তাঁর কৃপায় সেই মাথা দিয়েই দুই-চার টাকা রোজগার করে দিনাতিপাত করি। শিক্ষার্থীদের পড়াই। তাদের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজর) হিসেবে কাজ করি। আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখি।

এ পর্যন্ত যে কজন আমার নির্দেশনায় পিএইচডি সম্পন্ন করতে পেরেছেন, তাঁদের সর্বনিম্ন চার (যাঁদের আগে মাস্টার্স ডিগ্রি ছিল) থেকে সর্বোচ্চ ছয় বছর সময় লেগেছে। মাথা মোটা স্যারের মাথা মোটা শিক্ষার্থীগুলো। এত সময় তো লাগারই কথা।

আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (হার্ভার্ড, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান) যে কী হাল হয়েছে আজকাল, এরাই আবার এ মাথামোটাদের কাউকে কাউকে তাদের ওখানে নিয়োগ দিয়েছে। বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যালস বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এদের ভবিষ্যৎ যে কী হবে, ওপরওয়ালা জানেন।

বড্ড চিন্তার কথা বৈকি। আমেরিকানরা পিছিয়ে পড়ছে উচ্চশিক্ষায়। ট্রাম্পের লোকেরা তো চায় সব বিশ্ববিদ্যালয় নিপাত যাক। আবার ওদিকে খুশির কথা হলো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় যে আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে এগিয়ে।

এসব দেশে যেখানে পিএইচডি করতে তিন থেকে ছয় বছর লাগে, সেখানে দেড় বছরে আমাদের পিএইচডি শেষ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুততম সময়ে পিএইচডি সম্পন্ন করার কোনো রেকর্ড বই কোথাও রাখা হয় কি না, তা আমার জানা নেই। তবে থাকলে যে এ ব্যাপারে আমরা রেকর্ড করে ফেলতাম তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কোনো এক মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছিলেন, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ আমেরিকা-কানাডাকে ছাড়িয়ে যাবে। পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। পিএইচডি দেওয়ায় আমরা রেকর্ড গড়ছি তাদের পেছনে ফেলে।

বছর কয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক সহকর্মীর ফেসবুক পেজে চোখ পড়ে যায় আমার। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলাম, তখন আমরা একই বাসে যাতায়াত করতাম। ভদ্রলোক তখনই সবে জাপান থেকে পিএইচডি করে ফিরেছিলেন। অনেক স্বপ্ন তাঁর চোখে। অন্তত তাঁর বড় কথা শুনে তা–ই মনে হচ্ছিল তখন আমার মতো নব্য প্রভাষকের। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের পিণ্ডি চটকাতেন হরহামেশা।

সে যাক, তাঁর ফেসবুক পেজের কথা বলছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের। আমি বারবার ভাবছিলাম, আমি কোনো ভুল করছি না তো। একই নাম, একই পদবি, একই চেহারা। ফেসবুকে তাঁর পোস্টগুলো দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের কোনো নেতার পেজ হবে ওটা।

একজন সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক রাজনীতিসচেতন হতে পারেন। একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থকও হতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন না। কারণ, নেতা হওয়ার জন্য যে সময় দিতে হয়, সে সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের থাকার কথা নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক মহোদয়েরা নানা কারণে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়েছেন। একদা তিনি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় নম্বর দিয়েছেন, যা শিক্ষার্থীদের মনে হয়েছিল তাদের পরীক্ষার পারফরমেন্সের সঙ্গে বেমানান। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, শিক্ষার্থীরা খাতা দেখতে চাইলে তিনি তাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।

অধ্যাপক মহোদয় হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, এটা তাঁর বা আমার ছাত্রজীবনের সময় না, এটা ২০২০। প্রতিকার চাইতে চাইতে শিক্ষার্থীরা বিভাগীয় প্রধান ও অনুষদের ডিন হয়ে উপাচার্য পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে ও প্রতিকার পেয়েছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তাঁর এক ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক কর্ণধার। দেড় বছর লাগিয়ে অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স থিসিসকে নিজের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন।

দুটো ইংরেজি প্রবাদ দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানব। প্রথমটা হচ্ছে ‘The buck stops here’, পোকার খেলা থেকে এর উৎপত্তি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এটা ব্যবহার করতেন খুব। আদতে এটা তাঁর টেবিলে একটা কাঠের স্যুভেনিয়রে খোদাই করা ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছুর দায়িত্ব না এড়িয়ে বরং নিজে থেকে সেটাকে দৃঢ়চিত্তে গ্রহণ করা।

পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়কদের টেবিলে এ রকম কোনো শিল্পকর্ম রাখা নেই। কিন্তু আমরা যারা এ কাজের জন্য হাত তুলি, তারা সবাই জানি দ্য বাক স্টপস অ্যাট আওয়ার টেবল। তত্ত্বাবধায়কের প্রথম কাজ হচ্ছে যে বিষয়ে ছাত্রটি অভিসন্দর্ভ করতে চাইছে, সে বিষয়ের ওপর ছাত্রটিকে দিয়ে সমসাময়িক গবেষণাকার্যের একটা বিশদ বিবরণ দাঁড় করানো। সেটার ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক অনুমোদন করবেন নতুন গবেষণার পরিকল্পনা, যা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে কমিটির কাছ থেকে।

পরিকল্পনা অনুমোদনের পর ছাত্রটি তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশনায় তাঁর অভিসন্দর্ভ শেষ করে কমিটির কাছে পেশ করবেন। তত্ত্বাবধায়ক অনুমোদন করেননি বলে ছাত্র পিএইচডি শেষ করতে পারেনি—এ রকম ঘটনা বিরল নয় এ দেশে।

নকল অভিসন্দর্ভে সই করা তত্ত্বাবধায়ক বা কমিটি সদস্যরা নকল অভিসন্দর্ভের দায় এড়াতে পারেন না। নকল অভিসন্দর্ভের অভিযোগে অভিযুক্তের পিএইচডি সনদ বাতিল করা এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেমন জরুরি, তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। নিদেনপক্ষে সে তত্ত্বাবধায়কের অন্য ছাত্রদের অভিসন্দর্ভগুলোও যাচাই–বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আর দ্বিতীয় প্রবাদটি হচ্ছে ‘As you sow, so you reap’। বাংলায় একে বলে, যেমন কর্ম তেমন ফল। কিন্তু আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, যেমন বীজ পুঁতবে, তেমন ফল পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার যে সমস্ত সংবাদ পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, তাতে এই ঘটনাগুলো ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তেঁতুলগাছ পুঁতে আমের ফলনের আশা পাগলেও করবে না। কাজেই এসব ঘটনার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয়রাও এড়াতে পারেন না।

কথা হচ্ছে ‘দ্য বাক স্টপস হিয়ার’ কথাটা জোর দিয়ে বলার মতো মনের জোর, ক্ষমতা বা ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয়দের কি আছে এখনো?