ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-৮

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হামিদ কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এখানে কী করে এল? এই অবস্থা কেন তার? মাথা ভার ভার লাগছে কেন? আর তোড়া? তোড়াই বা ঠিক কী করছে এখানে?

‘তোড়া, আমি এভাবে শুয়ে আছি কেন? আর তুমিই বা কী করছ অসময়ে আমার ঘরে?’

‘বাহ হামিদ, বাহ...এতক্ষণ আমার সঙ্গে থাকলে। বললে আমাকে ভালোবাসো। এখন কিচ্ছু বুঝতে পারছ না তাই না? ওটা তবে কী ছিল? খেলা?’

হামিদের মনে হচ্ছিল কেউ তার মাথার ভেতর হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। গলার কাছটা কেমন শুকনো। চোখেও একটু যেন ঝাপসা দেখছে সে।

শুয়ে থাকা হামিদের গায়ের ওপর আচমকা প্রায় চড়ে বসতে চায় তোড়া। ‘আদর করো হামিদ, এতক্ষণ কত আদর করছিলে আমাকে, এখন কী হলো?’

‘আ...আমি? আদর করছিলাম তোমাকে? আমাকে কী পাগলা কুকুরে কামড়েছে, তোড়া?’

প্রায় ধাক্কা মেরে বোনকে নিজের ওপর থেকে সরায় হামিদ। কাঠের মেঝেতে পড়ে তোড়ার কপালের এক পাশ ছড়ে যায়।

ঘেউউউউউউউ! একটানা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে কাপকেক। টফি আর ব্রাউনির সেই সোনালি-খয়েরি মেশানো সন্তানদের একজন। ওদের শেষ দুটো ছানার একটা। কাপকেক আর কুকি। দুটো ছানাই একদম এক রকম দেখতে। কাপকেক ছেলে আর কুকি মেয়ে। টফি-ব্রাউনি দুজনই মারা গেছে গত বছর। বাগানেই ওদের কবর দিয়েছে কৃষ্ণা। মাস চারেকের কাপকেককে নীল কলার পরিয়ে হামিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা। নিজে রেখেছিল ওর বোন কুকিকে।

হামিদ জানে, কোনো বিপদ দেখলে এ রকম চেঁচায় ওর আদরের কুকুরছানাটা।

‘এর আবার কী হলো?’ নিজের মনেই বলতে বলতে, প্রায় টলতে টলতে ঘরের বাইরে গেল হামিদ। তোড়ার ঠোঁটে বাঁকা হাসি হামিদের নজরে পড়ল না।

বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে অবাক হয়ে গেলেন লাইলি। কৃষ্ণা প্রায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে নিজের বিছানায়। গালে চোখের পানি শুকিয়ে দাগ পড়ে গেছে। যে মেয়ে বিকেল হতেই চুল আঁচড়াতে বসে, তার আজ চুল উসকোখুসকো, চেহারা মলিন। ঠান্ডার ভেতরেও শুধু একটা পাতলা টি–শার্ট আর পায়জামা পরা।

‘কীরে মেয়ে, ব্যাপার কী তোর? এ রকম অবস্থা কেন?’

‘মা...হামিদ...।’ কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হেঁচকি তুলে ফেলা কৃষ্ণার ফোঁপানো থেকে যতটুকু বুঝলেন লাইলি, তাতে এই দাঁড়ায়—কোনো উড়ো ফোন পেয়ে তানিশাদের বাড়ি যায় কৃষ্ণা। দরজার ফাঁক দিয়ে হামিদ আর তোড়াকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে সহ্য হয়নি মেয়ের। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরেছে সে।

‘নিজের চোখকে কী করে অবিশ্বাস করি মা? হামিদও এমন ছেলে? হতে পারে না। আমার আড়ালে তোড়ার সঙ্গে সম্পর্ক হামিদের? মা, হামিদ এমন করবে?’

মেয়ের চোখে চোখ রাখেন লাইলি। ‘তুই কি আসলেই ভালোবাসিস ওকে, কৃষ্ণা?’

ওপর নিচে মাথা নাড়ে কৃষ্ণা। কথা বলার শক্তি নেই আর।

‘একসঙ্গে দেখলেই যে দোষী, এমন তো না–ও হতে পারে। তোর পাপাকে যখন ভালোবেসেছিলাম, কেউ একজন আমাকে বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছিল। তোর পাপার পাশে এক মহিলার বিকিনি পরা ছবি। তোর পাপা সেই মহিলার কোমর জড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, ওই মুহূর্তে নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছা করেছিল আমার। কিন্তু নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারাইনি আমি। পরে জেনেছিলাম ওই সব ছবি ফটোশপে এডিট করা। তোর সুপুরুষ পাপাকে অনেকেই চাইত কিনা, তাদেরই একজন চেষ্টা করেছিল আমাদের বিয়েটা ভাঙার, পেরেছে কি?’

মা-মেয়ের কথার মাঝে কখন যে শামসও এসে ঢুকেছেন ঘরে, বুঝতে পারেনি ওরা।

‘অনেকে চাইত ঠিক, তবে আমি তো চাইতাম মাত্র একজনকেই। আমার প্রীতিলতা। তাই আর বাদবাকিদের পাত্তা দেওয়ার সময় ছিল নারে মা। আবার প্রেমে পড়ার চেষ্টা করব নাকি?’

‘আরে ধুত্তরি ঘাটের মরার সাহস কত! চেষ্টা করে দেখ দেখি, ঠ্যাং ভেঙে ফেলে রেখে দেব!’

লাইলি একটু নাটকীয়ভাবে বললেন।

‘ওরে, আমার তো দুইটা মাত্র ঠ্যাং, ভাঙলে যাব কই গো?’

শামসের মাথায় হাত।

মধ্য পঞ্চাশেও প্রেম এখনো অনেক সজীব লাইলি-শামসের। পঁচিশের কৃষ্ণা পাপা-মায়ের খুনসুটি বেশ উপভোগ করে। সারা দিন হাসপাতাল, রোগী, ওষুধের গন্ধ,...নিজের পেশাকে অনেক ভালোবাসে সে। দিন শেষে কুকির আহ্লাদ আর পাপা-মায়ের হাসি সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় ওকে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে মনের ভেতর যুদ্ধ চলছে যেন। নাহ, এর শেষ দেখে তবে শান্তি।

তানিশা হামিদকে তিন দিন ধরে বলছেন বাইরে যেতে। তবে ছেলে নিজেকে গৃহবন্দী করে নিয়েছে প্রায়। অফিসের কাজও করছে বাড়িতে বসে। সঙ্গী বলতে কেবল কাপকেক। চারপেয়ে আদরের বন্ধুটিকে নিয়েই সময় কাটাচ্ছে হামিদ। কৃষ্ণারও ফোন বন্ধ। তানিশা বাইরে বেরোতে যাবেন, দেখেন দরজায় কৃষ্ণা দাঁড়ানো।

‘কীরে মা? মৌনযুদ্ধ চলছে নাকি তোদের দুটোতে? ফোন বন্ধ তো থাকে না তোর কখনো!’

‘না, ফুফু, একটু শরীর খারাপ ছিল। এই জন্য বন্ধ। আসছি এখনই।’

মিথ্যা বলতে না চাইলেও বলল কৃষ্ণা। তোড়া যতই খারাপ হোক, ফুফু ভালোবাসেন তোড়াকে। তাই নালিশ করতে চায়নি কৃষ্ণা।

‘আমি মনে হয় টেডিকে ফেলে গেছি এখানে। খুঁজতে এসেছি।’

টেডি জীবন্ত কিছু নয়। টেডি হলো মাঝারি আকারের এমন এক পুতুল, যা দেখতে ভালুকের মতো, তবে ওর পেটের ভেতর ছোট্ট একটা ক্যামেরা বসানো আছে। আমেরিকানরা একে বলে Nanny Cam. কিছু কিছু আমেরিকান, যারা শিশুসন্তানকে রেখে যান কমবয়সী সাহায্যকারীর কাছে, তারা এ ধরনের ক্যামেরায় নির্দেশনা রেকর্ড করে রেখে যেতে পারেন। শিশুর সঙ্গে খেলতে খেলতেই এ ক্যামেরায় রেকর্ড দেখে কাজ করতে পারেন সাহায্যকারী। কৃষ্ণাকে এই পুতুল উপহার দিয়েছিল কেউ। ওই ক্যামেরা আবিষ্কার করার পর টেডিকে মাঝে মাঝে হামিদের কাছে দিয়ে যায় কৃষ্ণা। হামিদ ওর অর্গানের বাজনা রেকর্ড করে রাখে ওতে। রাতে ঘুমানোর আগে ওই বাজনা শোনে কৃষ্ণা। গভীর রাতে সে ফোন বন্ধ রাখে। তাই ঘুমের ঘোরে হামিদকে কাছে পাওয়ার মাধ্যম ওই বাজনা।

‘কীরে, তুই...ফোন বন্ধ কেন তোর?’

কৃষ্ণাকে সামনে পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে হামিদ।

কৃষ্ণা অন্যমনস্ক। বিড়বিড় করে বলে, ‘যা দেখেছিলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি...কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু ভুল হচ্ছে। আমার চোখের দেখাটা সত্যি নয়...।’

‘কী? কী দেখেছিলি তুই? সেদিন অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম...দরজার বাইরে এটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম...এটা কার? তোর না?’

হামিদের হাতে রুপার নূপুরটা চোখে পড়ে কৃষ্ণার। সেদিন ছুটে বেরোতে গিয়ে হয়তো খুলে পড়ে গিয়েছিল।

খুঁজতে খুঁজতে হামিদের খাটের নিচের কোনায় পড়ে থাকা টেডিকে তুলে নিল কৃষ্ণা।

‘তুই বলছিস তুই আমাকে আর তোড়াকে দেখেছিস, আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না যে!’

ব্যাকুল কণ্ঠ হামিদের।

টেডির পেটের ভেতর ক্যামেরায় চোখ রাখল দুজন। কয়েকটা বাজনার পরের অংশটি দেখে আঁতকে উঠল দুজনে। রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, কফির মগে কিছু একটা বানিয়ে এনেছে তোড়া। হামিদের ঘরে ঢুকে কফিতে চিনি মেশাল সে। একটা মগে চিনি ছাড়াও আরও কী যেন একটা গুঁড়ো মতো মেশাল তোড়া, হামিদ বাথরুমে গেলে।

‘এই দেখ, তোর গুণধর বোন কী খাইয়েছিল তোকে? যা জিজ্ঞাসা কর ওকে!’

তীব্র, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে কৃষ্ণা।

‘নিশ্চয়ই নেশার কিছু। আমাকে আচ্ছন্ন করে উল্টাপাল্টা কিছু করেছে নাকি আমার সঙ্গে?’

এবার হামিদ নিজেও উত্তেজিত।

ভাইঝি যে ছেলের সঙ্গে খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে না, তানিশা জানতেন। তবে তোড়া হামিদকে এমন কিছু করতে পারে, ধারণা ছিল না তানিশার।

তোড়া নেশার কারণে আগেও কারাবাস করেছে। এবার তানিশা নিজেই পুলিশকে ফোন করে। জেরার মুখে তোড়া স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, কফিতে এমন কিছু মেশানো ছিল, যাতে শুধু নেশা নয়, সাময়িক স্মৃতিহীনতা পর্যন্ত ঘটতে পারে। হামিদকে কাছে পেতে আর কৃষ্ণার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করাতেই এই কাজটি করেছিল তোড়া।

অতএব, তোড়ার হাতে হাতকড়া পরিয়ে ওকে ঠেলে গাড়িতে তুলে নিল পুলিশ। বাংলাদেশ নয়, হাজত দেশে চলল তোড়া।

কৃষ্ণা আর হামিদের বিয়ের বাদ্য কিছুদিন পরেই বাজবে। আপনারা আসবেন তো? (সমাপ্ত)

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-সাত