কঠিন বাস্তবতার নাম প্রবাস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমাদের বড় মামা চলনে বেশ টিপটপ ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ভালো চাকরি করতেন। মোটা অঙ্কের মাইনে পেতেন। সেই কষ্টার্জিত অর্থে ঢাকায় বিরাট বাড়ি বানিয়েছেন। সব গুছিয়ে একসময় পরিকল্পনামাফিক বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফেরেন।

তখন ঢাকা শহরে এত যানজট ছিল না। মামার গাড়ি ছিল। নিজেই ড্রাইভ করতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের মফস্বলের বাসায় বেড়াতে আসতেন মামিকে নিয়ে। দুজনেরই পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ ফুটে উঠত। আমরা দূর থেকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে দেখতাম।

আম্মা নিজের ছোট্ট ঘরে বড় ভাইয়ের আগমনে যারপরনাই আনন্দিত হতেন। কী খাওয়াবেন, কোথায় বসতে দেবেন, এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন।

সেদিন আর আমাদের লেখাপড়া করতে হতো না। মাফ পেয়ে যেতাম। অন্য দুই মামার সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম, বড় মামার সঙ্গে তেমনটি ছিলাম না।

ছোটবেলায় আমরা যখন নৌকা করে নানাবাড়ি যেতাম, কখনো কখনো জলজ গাছ পার হতে হতো। বড় মামার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল সেই জলজ গাছের মতো। পাশ দিয়ে নীরবে চলে যাওয়ার মতো। মামাকে সব সময় দূরের মানুষ মনে হতো।

তবুও মামা আমাদের বাসায় এলে মনের ভেতরে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলে যেত। বড় হতে হতে কেমন করে যেন মামা আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি শেষে মেঘ সরে যাওয়া আকাশের মতন।

দেশে গেলে টুকটাক গল্প করতেন। একসঙ্গে বিকেলের চা-নাশতা খেতে খেতে একান্ত সুখ-দুঃখ শেয়ার করতেন। চলে আসার সময় গেট পেরিয়ে সরু রাস্তার অনেকখানি পথ এগিয়ে আসতেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন আমরা দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে যাওয়া অবধি।

লেখিকা
লেখিকা

এই যে দাঁড়িয়ে থাকতেন, এই দৃশ্যটুকু অনেকটা সময় আমাদের বিষাদে গ্রাস করে রাখত। মনে হতো আপন মানুষগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের মনের গহিনে চিরকালই ছিলেন। শুধু আমরা দেখতে পাইনি অথবা দেখতে চাইনি।

শেষবার দেশে গেলে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা। কাছে ডেকে খুব ধীরস্থির কণ্ঠে মামা বললেন, ‘আমার শরীরটা বেশি ভালো নেই। পরেরবার এলে আর দেখবি বলে মনে হয় না।’ মামার অভিব্যক্তিতে বেদনামাখা বিষাদের ছাপ স্পষ্ট ছিল। যেহেতু চারদিকে স্বজনদের কোলাহল, কর্মব্যস্ততা, তাই নির্বিকার চিত্তে অন্য অতিথিদের দিকে হেঁটে যাই।

এসব বছর দেড়েক আগের গ্রীষ্মের কথা। আরেকটি গ্রীষ্ম পেরিয়ে এখন নিউইয়র্ক শহরে শীতের মাঝামাঝি সময়। বাইরে প্রায়ই হাড় কাঁপিয়ে বাতাস বয়। ভারী জ্যাকেট আর বুটজুতা পরে শহরের ব্যস্ত লোকজন ছুটে চলে গন্তব্যে। আমি ছুটছি ছেলেকে মসজিদ থেকে পিকআপ করতে।

শহরে তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে যদিও, কিন্তু চারপাশজুড়ে মধ্যরাতের আঁধার। সঙ্গে নিয়ন বাতির হলদে আলো। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের সামনে হোল্ড করা ফোনের লাইট জ্বলে ওঠে অনেকটা অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকা জ্বলে ওঠার মতো।

রেড লাইটে গাড়ি থামিয়ে মেসেজ চেক করি। মামার মৃত্যুসংবাদ! আমাদের বড় মামা আর বেঁচে নেই! দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। যোজন যোজন দূর থেকে স্বজন, প্রিয়জনদের মৃত্যুসংবাদ, শোক সইবার কঠিন এক বাস্তবতার নামই বুঝি প্রবাস!