মুগ্ধতার এক আয়োজন

ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আবুধাবিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করেছেন। ছবি: নিমাই সরকার
ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আবুধাবিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করেছেন। ছবি: নিমাই সরকার

একটি অনুষ্ঠান মহিমা পায় এর নিজস্ব গুণে। সেদিন ছিল বাণী অর্চনা। কেরালা সোশ্যাল সেন্টার। এখানে সমবেত হন সংস্কৃতি আবুধাবির একটি গোষ্ঠী। বাঙালি বলে কথা! আমরা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। তবে এ আয়োজন অনুষ্ঠানের প্রধান কুন্দন মুখার্জি।

কুন্দন মুখার্জির কারণে এই আয়োজন পায় অন্য মাত্রা। এ আয়োজন পূজার। এ অনুষ্ঠান অর্চনার। এ পূজা কত্থক, ওডিশি, ভরতনাট্যম, কোচিপুরী, মোহিনী নৃত্যর মাধ্যমের। এ অর্চনা রবীন্দ্র-নজরুলসংগীতের।

ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গত বুধবার (২৯ জানুয়ারি) আবুধাবিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করেছেন। শোলা ও হার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি প্রতিমা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিদ্যাদেবীকে সাড়ম্বরে বরণ করতে বিপুল আয়োজন ছিল। ভক্তরা পলাশ ফুল, বেলপাতা, দূর্বা প্রভৃতি দেবী সরস্বতীর পায়ে অঞ্জলি দেন।

‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে, বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’ বাণী বন্দনায় পৌরোহিত্য করেন শুভাশীষ চট্টোপাধ্যায়। অঞ্জলি শেষে ছিল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

দুই নম্বর হল ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমরা ঢুকলাম। প্রথম দৃশ্য। প্রিয়াঙ্কা সুর এলেন। তাঁকে স্বাগত জানালেন ধীরা মুখার্জি। বুকে জড়িয়ে ধরলেন পাঞ্জালি ভট্টাচার্য। বন্ধুর মিলন। এ আমাদের দ্বিতীয় দফায় আসা।

ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আবুধাবিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করেছেন। ছবি: নিমাই সরকার
ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আবুধাবিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করেছেন। ছবি: নিমাই সরকার

প্রথমবার এসে দিয়ে যাই নৈবেদ্যর থালা। রাজ স্টেইনলেস স্টিলের রাজকীয় পাত্র। বাড়ির কাছের কথা নয়! এর সঙ্গে ছিল পঞ্চপ্রদীপ, লাল গামছা—পূজার জন্য যা অত্যাবশ্যকীয়। লাকী হালদার ফোনেই যোগাযোগ করে এসেছেন। তখন হলের সাজসজ্জা চলছিল।

এবার অন্য রকম বেশ। লাল পেড়ে বাসন্তী শাড়ি। নিজে, সেই সঙ্গে প্রিয়তম কন্যা দূর্বা। বলে রাখি, সেও শাড়ি পরে এসেছে। জীবনের এই প্রথম!

আগেরবারের কথা বলছি। তিন তরুণ মহাব্যস্ত তখন। প্রসেনজিৎ দে, প্রসেজিৎ সাবুইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। এক এক করে নাম বললেন পূজার প্রধান কর্মকর্তা। আমি যোগ করি আরেকজনকে। হ্যাঁ, তিনি কলকাতার চিত্রনায়ক। তাঁরা শোলা দিয়ে মণ্ডপ করছেন।

কাগজে বন্দী হয়েছেন ভারতীয় ৫০ কৃতী সন্তান। এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা আছেন, ভারতবর্ষ যাঁদের জন্য গর্বিত বলা হয়েছে। নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ, অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জ্বলজ্বল করছেন।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু যেন এগিয়ে বলছেন, তোমরা এগিয়ে এসো, যেতে হবে বহুদূর।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: নিমাই সরকার
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: নিমাই সরকার

সত্যেন্দ্রনাথ বোস, অশোক সেন ডাকছেন। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, আনন্দ মোহন চক্রবর্তী দেখিয়ে দিচ্ছেন, এই তো পথ। ভয়কে পেছনে ফেলে সামনে যাওয়ার ইঙ্গিত। আমি সাহসী হয়ে উঠি। মনে মনে বলি, তোমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে আজকের প্রজন্ম।

এ কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। রাম সাজবেন যিনি, তাঁরই সঙ্গে দিনভর দড়ি টেনে মঞ্চ সাজিয়েছেন শ্রীকান্ত। আর এই আমার ভেতরকার কান্ত কাগজগুলো দেয়ালে লাগানোর কাজে সময় দিলেন। বিখ্যাত মনীষীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে পড়ে নিলেন প্রথম ভাগে।

শুধু কি তা–ই? আমেশ্বরের মাহাত্ম্য অধ্যয়ন করা হয়ে গেল। আমি বর্গফল, আমেশ্বর দেব গো, এ যজ্ঞে দেব, প্রতিষ্ঠা চন্দন। এরই নাম অভিজ্ঞতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শতকিয়া লিখে ফেলেছিলেন ট্রেনভ্রমণে মাইলফল দেখে দেখে। পাঁচ পাতার আমেশ্বর কোথায় পাওয়া যায়, সে আমি জানতাম। আমার রথে সারথি হলেন তিন পূজারি। নিয়ে গেলাম গন্তব্যে। টক টক করে ছিঁড়ে আনলেন আমেশ্বর। আমেশ্বর আমি জানলাম, বলা যায়, কর্মের মধ্য দিয়ে, অভিজ্ঞতায়।

সরস্বতী দেবী শ্বেতশুভ্রবসনা। দেবীর এক হাতে বেদ, অন্য হাতে বীণা। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব ‘সরস্বতী’ শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী বা নদী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে ঋষি লাভ করেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সেই অর্থে দেবী জ্ঞানের দেবী। ঈশ্বরের বাক্‌শক্তির প্রতীক এই সরস্বতী। তাই তিনি বাগদেবী।

মানুষের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে দেবী প্রতিবছর আবির্ভূত হন ভক্তদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরাই এই পূজায় মনোযোগী হন। সরস্বতী বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী। স্কুল-কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঘরে ঘরে এই পূজা উদ্‌যাপিত হয়। রসমঞ্জুরীর প্রতিষ্ঠাতা কুন্দন। সুতরাং তাঁরও ইচ্ছা এখানে পূজা হোক। হলো, স্বপ্ন পূরণ হলো সবার।

দেবী সরস্বতী শুক্লবর্ণ। স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক। জ্ঞানে গুণান্বিতা বলে তাঁর গায়ের রং শুক্লবর্ণ, অর্থাৎ দোষহীনা। সরস্বতীর বাহন রাজহংস। কারণ, হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করে। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে। মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে শিক্ষা দিচ্ছে, সবাই যেন সার বা কল্যাণকর কিছুই গ্রহণ করে।

বীণার জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে ওঠে ধ্বনি বা নাদ। সরস্বতীর ভক্তরা সাধনায় সিদ্ধ হলে বীণার ধ্বনি শুনতে পায়। বীণার সুর সুমধুর। বিদ্যার্থীদের মুখনিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সংগীতময় হয়। সে কারণেই মায়ের হাতে বীণা। তাই দেবীর আরেক নাম বীণাপাণি।

কুন্দন মুখার্জি পুরান চর্চা করেন। তিনি দেবীকে সে কারণেই হাজির করেন তাঁর যেকোনো আয়োজনে। এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান পায় অন্য মাত্রা। সেদিন লক্ষ্মী দেবী, ধর্মরাজ এসেছিলেন। আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন সোমা চট্টোপাধ্যায়। তিনজন তিন জগতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। একজন ভরতনাট্যম। অন্যজন কোচিপুরী, মোহিনী নৃত্য ধারায় অবদান রেখে চলেছেন। আর সোমা মানেই সংগীত।

আবুধাবিতে সরস্বতীপূজায় সমবেতদের একাংশ। ছবি: নিমাই সরকার
আবুধাবিতে সরস্বতীপূজায় সমবেতদের একাংশ। ছবি: নিমাই সরকার

কুন্দন মুখার্জির নিজেরও বিষয় কত্থক ও ওডিশি।

তাঁর শিক্ষার্থীরা নৃত্য পরিবেশন করে।

ঈশিতা, নন্দা যথারীতি আগের মতোই মঞ্চে ছিলেন দীপ্যমান।

গুরু ধর্মরাজ ও গুরু লক্ষ্মী দেবীর শিক্ষার্থীরা গণেশ বন্দনা করে।

সোমা চট্টোপাধ্যায় ছাত্রীদের নিয়ে মঞ্চে এলেন। নিজে গাইলেন, গাইল ছাত্ররা।

শুরুতে বললেন, নাচের স্কুলে নাচ হবে, গান হবে, বিশুদ্ধ সংস্কৃতির উপস্থাপনা হবে, এটাই প্রত্যাশিত। তিনি অনুষ্ঠানের মূল আয়োজককে শুভাশীষ জানালেন।

‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’–এর সুরে গাইলেন অন্য গান। তাক লাগিয়ে দিলেন।

অনাঘ্রাতা, আগ্নিকা যথাক্রমে কোচিপুরী ও ভরতনাট্যমে ফিরিয়ে নিলেন। এ যে অন্য জগৎ! যেখানে স্বর্গ এসে মর্ত্যে মেলে।

নৃত্যে দীপশ্রী মেধার স্বাক্ষর রাখে। প্রাজ্ঞী, রিওনা, রাহী নাচল মনের মাধুরী মিলিয়ে। লাবণ্য ত্রিপাঠী, শ্রীপর্ণা রায় চমৎকার নাচ উপহার দিল। হাতেখড়ির অনুষ্ঠানও ছিল প্রাণবন্ত।

শ্রীয়ান, লাবণ্য, প্রকৃতি, আরাধ্যক ‘অ’ ‘আ’-কে সামনে রেখে লিখল মা। দেখা হলো জাগৃতির সঙ্গে। সঙ্গে কুশল, দূর্বাও ওই দলে। শওনক এল। ওরা সবাই স্কুলে পড়ে। আড্ডা দিল। নাচ-গান উপভোগ করল।

আবুধাবিতে সরস্বতীপূজায় সমবেতদের একাংশ। ছবি: নিমাই সরকার
আবুধাবিতে সরস্বতীপূজায় সমবেতদের একাংশ। ছবি: নিমাই সরকার

অলক মাইতি গাইলেন আধুনিক। অর্চিশা দে, অনুরাগ মাইতি সবার ভালোবাসা কুড়ালেন ভালো গেয়ে।

অনুপ খাটুয়া গল্প করছিলেন। আমি হাত মেলালাম। টুটুন নন্দী, মৌলিমা রায়, বুদ্ধেশ্বর রায় এলেন। শুভেচ্ছা জানালাম। ক্যামেরা জ্বলে উঠল। হাত বাড়ালেই বন্ধু। জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য তেমনই এক মুখ। দুই কন্যা তাঁর সঙ্গে। আমার ভালোবাসা জানাই ছোটদের জন্য।

শ্রাবন্তী দে আমাকে চেনেন না। বললেন, পণ্যের অর্ডারের সময় আপনার নাম এসেছিল। খলিফা ইউনিভার্সিটিতে আইটি সেকশনে চাকরি। কুশলবিনিময় হলো। দুই কন্যা। রিওনা রানির মতো, ফিওনা পরি জগতের, বুঝিয়ে দিলেন।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন পরে দেখা। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। সুবর্ণা মুখার্জি বার্তা দিলেন, কন্যা তার গান করবে। লাবণ্য গেয়েছিল। কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। তার কন্যা নাচবে। কন্যাসহ ছবি তুললাম। শেষ পর্ব। রাত গভীর। নিচে খাওয়ার ব্যবস্থা। খেলাম সবাই মিলে।

বক্তব্য দেন কুন্দন মুখার্জি
বক্তব্য দেন কুন্দন মুখার্জি

পূজাটা বারোয়ারি। তবে এতে অংশগ্রহণ ষোলোটি পরিবারের। তারা যে যার জায়গায় থেকে এগিয়ে এসেছে। ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছিল এ আয়োজন। রসমঞ্জুরী, ধর্মরাজ, লক্ষ্মী দেবী, সোমা চট্টোপাধ্যায় নামগুলো শ্রদ্ধার। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাঁদের উপস্থিতি অনুষ্ঠান আয়োজনকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। বিস্মিত হই, ভাবি, কী এক বিন্যাস—কত্থক, ওডিশি, ভরতনাট্যম, কোচিপুরী, মোহিনী। মাথা নত হয়। কী যে মুগ্ধতা!