জাপানে শিশু জন্ম ও আমার অভিজ্ঞতা

হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে লেখকের সহধর্মিণী। ছবি: লেখক
হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে লেখকের সহধর্মিণী। ছবি: লেখক

একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সন্তান প্রসব একটি সর্বজনীন বিষয়। কিন্তু বিদেশের মাটিতে ভিন্ন সংস্কৃতির একটি দেশে সন্তান প্রসব করা সত্যিই উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। ভাষাগত পার্থক্য, অজানা মানুষ, আত্মীয়স্বজনদের সান্নিধ্য না থাকা—এ সবকিছু একজন মাকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
কিন্তু জাপানের মতো একটি বিনয়ের দেশে সন্তান প্রসব করা সত্যি সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয়। কারণ, এখানে মানুষের আতিথেয়তা, হাসপাতালের সেবার মান, উন্নত মানের চিকিৎসা ও পরামর্শ, সরকারি প্রণোদনা—এ সবকিছু একজন মাকে নিরাপদ সন্তান প্রসব করার জন্য যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করে থাকে।
বলা বাহুল্য, এখানে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নতম। ২০১৯ সালের তথ্যমতে, জাপানের মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে মাত্র চারজন। আর নবজাতক শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মাত্র ১ দশমিক ৭২৪ জন।

গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ। ছবি: লেখক
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ। ছবি: লেখক

জাপানে ন্যাশনাল হেলথ ইনস্যুরেন্সের আওতায় চিকিৎসার খরচের ৭০ ভাগ বহন করে জাপান সরকার আর বাকি ৩০ ভাগ বহন করেন রোগী। অর্থাৎ চিকিৎসা বাবদ কারও খরচ যদি ১০ হাজার ইয়েন হয়, তাহলে ৭ হাজার ইয়েন দেবে সরকার আর ৩ হাজার ইয়েন দেবেন রোগী।

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে নরমাল ডেলিভারি থেকে সিজার অপারেশনের খরচ কম। নরমাল ডেলিভারিতে সংকটপূর্ণ অবস্থা ছাড়া খরচ প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইয়েনের মতো। অন্যদিকে, সিজারিয়ান অপারেশনে সন্তান প্রসব হলে খরচ প্রায় তিন থেকে চার লাখ ইয়েন।

হাসপাতালে রোগীদের খাবারের ধরন। ছবি: লেখক
হাসপাতালে রোগীদের খাবারের ধরন। ছবি: লেখক

আনন্দের বিষয় হলো জাপান সরকার প্রতিবার সন্তান প্রসব ও প্যারেন্টিংয়ের খরচ বাবদ প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার ইয়েন ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এমনকি গর্ভাবস্থার ৮৫ দিন পরও যদি কারও গর্ভপাত হয় তাহলেও সমপরিমাণ অর্থ জাপান সরকার তাঁকে প্রদান করে। একেই বলে নাগরিক সেবা।
সিজারিয়ান অপারেশন হলে একজন মা সরকার থেকে যে ভর্তুকি পান, তা থেকে কিছু ইয়েন ফেরত পান। নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে ক্ষেত্রবিশেষে একজন মাকে লম্বা সময় লেবার রুমে থাকতে হয়। ফলে খরচও বেশি হয়। কারণ, সিজারিয়ান সেকশনে প্রসব–পরবর্তী মায়েদের অনেক জটিলতা দেখা দেয়। স্পাইনাল অ্যানেসথেসিয়ার ফলে অনেক সময় মেরুদণ্ডে ব্যথা অনুভব হয়। মায়েদের দৈহিক শক্তি ও ক্ষমতা আগের থেকে অনেক কমে যায়। এ জন্য হাসপাতালগুলোয় নরমাল ডেলিভারির প্রতি ঝোঁক বেশি।
জাপানিরা এটা বিশ্বাস করে যে একটি সুস্থ–সবল জাতি উপহার দেওয়ার জন্য নরমাল ডেলিভারির বিকল্প নেই।

অবশ্য নরমাল ডেলিভারি হওয়ার জন্য ডাক্তার আরেকটি বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তা হলো জন্মের আগে বাচ্চার ওজন। হাসপাতালে মায়েদের একজন নিউট্রিশনিস্টের অধীনে সঠিক ডায়েট মেনে চলতে ও নিয়মিত ক্লাস করতে হয়। জাপানে সব সময়ই নরমাল ডেলিভারির জন্য উৎসাহিত করা হয়।

অনেক ইউরোপীয় দেশ ও আমেরিকার তুলনায় এখানে সিজারিয়ানের হার অনেক কম। এমনকি এখানে ব্যথামুক্ত প্রসব অর্থাৎ epidurl anesthesia হার অনেক কম। মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। যেখানে উন্নত বিশ্বে এই হার অনেক বেশি। আমেরিকাতে ৬১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৩৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ৭৭ শতাংশ।

নিউট্রিশনিস্টের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ, ম্যাটারনিটি স্টিকার, প্রতিবেশী জাপানি বন্ধুদের হাসপাতাল পরিদর্শন, শিশু জন্মের পর লালন-পালন সম্পর্কিত ব্যবহারিক ক্লাস। ছবি: লেখক
নিউট্রিশনিস্টের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ, ম্যাটারনিটি স্টিকার, প্রতিবেশী জাপানি বন্ধুদের হাসপাতাল পরিদর্শন, শিশু জন্মের পর লালন-পালন সম্পর্কিত ব্যবহারিক ক্লাস। ছবি: লেখক

সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে বাংলাদেশে গত দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এ জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের মানোন্নয়নের জন্য অধিকতর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
জাপানে একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রায় ১৫ বার নিয়মিত এন্টিনেটাল হেলথ চেকআপ ও আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হয়। অর্থাৎ গর্ভাবস্থা সময় ৪০ সপ্তাহ হলে, ৮, ১২, ১৬, ২০, ২৪, ২৬, ২৮, ৩০, ৩২, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০তম সপ্তাহে প্রতিবার নিয়মিত আলট্রাসনোগ্রাফি টেস্ট, ভ্যাজাইনাল টেস্ট, প্রেশার, ওয়েট, ফিটাল হার্টবিট ও ওয়েট চেকআপ করতে হয়।
এই সব কটিই ডাক্তাররা অত্যন্ত যত্নসহকারে, হাসিমুখে, বিনয়ের সঙ্গে তত্ত্বাবধান করেন এবং প্রতিবার আলট্রাসনোগ্রাফি ছবি প্রদান করা হয়। যার মাধ্যমে একটি শিশু ভ্রূণ থেকে কীভাবে বড় হয়, সে সম্পর্কে একজন মা ও ডাক্তার সম্পূর্ণ অবগত থাকেন।

আরেকটি বিষয় জাপানিরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করেন, তা হলো ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল। বিশ্বে gestational diabetes একটি উদ্বেগের বিষয়। অর্থাৎ ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে গেলে বডি গ্লুকোজ কন্ট্রোল করার জন্য অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ফলে, gestational diabetes হয়। তাই এই গ্লুকোজ লেভেল কন্ট্রোল করার উপায় হলো সঠিক ডায়েট চার্ট।

জাপানে প্রেগনেন্সির সময় লোকাল হেলথ কেয়ার সেন্টার থেকে অন্তঃসত্ত্বা মাকে একটি maternity book নিতে হয়। যেখানে হেলথ চেকআপের তথ্যগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়মিত লিপিবদ্ধ করা হয়। এমনকি জন্মের পরও বাচ্চার রেগুলার হেলথ চেকআপ ও ভ্যাকসিনেশন রেকর্ড এই বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়, যা দেখে যেকোনো ডাক্তার সহজেই মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থা ও হিস্টোরি বুঝতে পারেন।

আরও একটি জিনিস মাকে দেওয়া হয়, তা হলো ম্যাটারনিটি মার্কসংবলিত একটি স্টিকার, যা ব্যবহার করে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী যেকোনো লোকাল ট্রান্সপোর্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বসার সুযোগ পান।

প্রসবের সময় হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের সেবা ও আতিথেয়তা সত্যিই বিশ্বমানের এবং অতুলনীয়। জাপানের হাসপাতালগুলোয় সিজারিয়ান বা নরমাল ডেলিভারির সময় বাবাদের অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সুযোগ প্রদান করা হয়। একজন মায়ের ডেলিভারি সময় কী পরিমাণ কষ্ট, তা উপলব্ধি ও মায়ের মানসিক প্রশান্তির জন্যই তাঁরা এই সুযোগ দিয়ে থাকেন।

হাসপাতালে নার্সদের তৈরি কিছু সুদৃশ্য কার্ড। ছবি: লেখক
হাসপাতালে নার্সদের তৈরি কিছু সুদৃশ্য কার্ড। ছবি: লেখক

সন্তান প্রসবের পরপরই নবজাতক শিশুকে এনআইসিইউতে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে বাচ্চার যাবতীয় সব টেস্ট, হেয়ারিং স্ক্রিনিং ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে বাচ্চাকে মায়ের হাতে তুলে দেন। আর এই সময় মাকে তার কেবিন থেকে এনআইসিইউতে হেঁটে গিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। আর এই হাঁটাই প্রেগনেন্সি–পরবর্তী সার্বিক ধকল কাটিয়ে উঠতে ও স্বাভাবিক চলাফেরাতে ফিরে আসতে সাহায্য করে।
প্রসব–পরবর্তী প্রায় দুই থেকে তিন দিন একজন মাকে ডাক্তার ও নার্সের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। এ সময় নার্সরা ১৫ মিনিট পরপর কেবিন পর্যবেক্ষণ করেন। মাঝেমধ্যে মায়ের ঘুম না এলে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। শরীরে বা পায়ে কোথাও ব্যথা থাকলে ম্যাসাজ করে দেন। কীভাবে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে হয়, তা হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। টয়লেট ও বাথরুমের শাওয়ার নিতে সাহায্য করেন। খাবার খেতে না পারলে খাবার খাইয়ে দেন। ইন্টারনাল ব্লিডিংয়ের সব কাপড় চেঞ্জ করে দেন। হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করেন। কখনো তাঁদের মুখে বিরক্তির ছাপ পাওয়া যায় না।
কতটুকু আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে একলা ফেলে নিশ্চিন্তে রাতে বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারেন। সত্যিই জাপানিরা অতুলনীয়। এখানে হাসপাতালগুলোর খাবারের মান খুবই মানসম্মত ও সুস্বাদু। তিন থেকে চার দিন পরেই ডাক্তার ও নার্সরা বাচ্চা কীভাবে লালন–পালন করতে হয়, তার ওপর ক্লাস নেন। কীভাবে গোসল করাতে হয়, কীভাবে খাওয়াতে হয়, আরও কত–কী।

কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় জাপানের হাসপাতালগুলোয় লক্ষণীয়। যেগুলো মানুষের মনে স্থান করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, নার্সরা বাচ্চার প্রথম গোসলের ছবি তুলে রাখেন। জন্মের প্রথম দিনের ছবি তুলে জন্মদিনের কার্ড তৈরি করেন। বাচ্চার পায়ের ছাপ নিয়ে একটি সুদৃশ্য কার্ড তৈরি করে বাবাকে উপহার দেন। এ ছাড়া জন্মের সময় মা ও শিশুর umbilical cord-এর কিছু অংশ কেটে একটি সুদৃশ্য কাঠের বাক্সে রেখে মাকে স্মৃতি হিসেবে উপহার দেন। এই বিষয়গুলো সত্যি হৃদয়ে গেঁথে রাখা মতো।

হাসপাতালের নার্সদের তৈরি নির্দেশনামূলক দেয়ালিকা। ছবি: লেখক
হাসপাতালের নার্সদের তৈরি নির্দেশনামূলক দেয়ালিকা। ছবি: লেখক

এ ছাড়া বিদেশি নাগরিকেরা গর্ভাবস্থায় কী কী সমস্যার সম্মুখীন হন, তা নিয়েও মেডিকেলের শিক্ষানবিশ ডাক্তারেরা সেমিনারের আয়োজন করেন।
জাপানে যেসব নাগরিকের আয় কম, তাঁদের শিশুদের প্রতি মাসে সরকার ভর্তুকি দেয়। জাপানে প্রতিটি শিশু জন্মের প্রায় তিন বছর পর্যন্ত ১৫ হাজার ইয়েন এবং তিন বছর থেকে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত ১০ হাজার ইয়েন করে প্রতি মাসে পান। এমনকি যাদের বাবা-মা মারা গেছে বা ডিভোর্স হয়েছে, তারাও এই ভর্তুকির অন্তর্ভুক্ত। শিশুদের কল্যাণ ও স্বাভাবিক স্থিতিশীল জীবনযাপনের জন্য সরকার এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
একজন বিদেশি হিসেবে জাপানের মাটিতে সহধর্মিণীর মাতৃত্বের সুবাদে আমার এই অভিজ্ঞতা।
আতিথেয়তা, মমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মাটি ও মানুষ—এই শব্দগুলো বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই সম্বলগুলো কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জিত হবে এবং দেশের মানুষ দেশের মাটিতেই উন্নত চিকিৎসাসেবা পাবে—এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।