জেনিফার আর জুলির গল্প

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

‘মা, টয় ড্রাইভ থেকে আসবে না এখানে খেলনা দিতে? আমার যে একটা নতুন পুতুল চাই বড়দিনে...আমি বলেছি প্রভু যিশুকে...দেবেন না যিশু?’

জুলি বড় বড় নীল চোখ মেলে প্রশ্ন করে মাকে।

‘ঠিক আসবে মা। যিশু তোমার কথা শুনবেন। তুমি লক্ষ্মী হয়ে ছিলে না সারা বছর? যারা যিশুর Naughty List–এ থাকে, যিশু তাদের কথা শোনেন না। তবে তুমি তো দুষ্টু মেয়ে নও জুলি।’

কথাটা বলে চার বছরের মেয়ে জুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন মা জেনিফার।

জুলির হাতে আপেল জুসের কাগজের প্যাকেট। শেষ হয়ে গেছে। তবু চুষছে সে। এ দেশে এমন প্যাকেট ওর বয়সী বাচ্চাদের হাতে হাতে ঘোরে। অনেকে পুরো জুসটা না খেয়েই ফেলে দেয় প্যাকেট। কিন্তু জুলির তো সেই ভাগ্য নেই।

স্বামী পরিত্যক্তা জেনিফার মেয়ে জুলিকে নিয়ে দুই বছর আগে গির্জার এ আশ্রমে এসে উঠেছিলেন। জুলির বাবা মাইকেল যেদিন থেকে চাকরিতে উন্নতি করতে শুরু করল, জেনিফার অনেক রকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন নিজের ছোট্ট পরিবারটা ঘিরে। বাড়ির পাশের এক রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন জেনিফার। সহকর্মী কয়েকজন ছাঁটাই হওয়ার পর হুট করেই মালিক ঘোষণা দেন, রেস্তোরাঁ বিক্রি করবেন তিনি। কর্মীরা যেন যার যার রাস্তা খুঁজে নেয়।

সেদিন আচমকা বিনা দোষে চাকরি খুইয়ে জেনিফারের মেজাজ এমনিতেই সপ্তমে চড়ে ছিল। এরপর যখন বাড়ি ফিরে মাইকেলকে আবিষ্কার করলেন নিজের বিছানায় অন্য নারীর সঙ্গে, রক্ত গরম হয়ে গেল জেনিফারের। একটাই শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন জেনিফার তখন—বিশ্বাসঘাতক!

তিন বছরের জুলির হাত ধরে এক কাপড়েই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। ব্যাগে সামান্য কিছু ডলার নিয়ে।

বাসস্টপে পরিচয় হয় ফাদার রবার্টের সঙ্গে। মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়া জেনিফারকে রবার্ট নিয়ে এলেন এই গির্জার আশ্রমে। এখানে জেনিফারের মতো আরও অনেক একক মায়েরা থাকেন।

জেনিফার আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে সকালে একবার, বিকেলে একবার বের হন। স্কুল–কলেজের সামনে, বাস স্টপের সামনে, যেখানেই দাঁড়ান, ছোট–বড় সবাই আইসক্রিম কেনে।

তবে আমেরিকার মতো একটা দেশে শুধু আইসক্রিম বেচা টাকায় নিজের বাড়ি তো দূরের কথা, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকাও সম্ভব নয়। তাই গির্জার আশ্রমই ভরসা। রেস্তোরাঁর চাকরির পরে আর কোনো চাকরি করতে চাননি জেনিফার। ওই ছোট্ট আইসক্রিমের গাড়িতেই সুখ খুঁজে নেয় মা–মেয়ে।

জেনিফারকে প্রতিটি সেন্ট হিসাব করে খরচ করতে হয়। এক সেন্টের খয়েরি মুদ্রা মানুষের পকেট গলে বাসে–ট্রেনে ছড়িয়ে পড়ে থাকে। কেউ তোলে না। তবে ওই এক সেন্টও জমিয়ে রাখেন জুলির মা। সে জন্য জুলির কাছে খেলনা মানেই এখন মাঝেমধ্যে স্কুল থেকে পাওয়া ছোট ছোট প্লাস্টিকের গাড়ি ছাড়া কিছু নয়। জেনিফার চাইলেও হুট করে দশ ডলারের পুতুল কিনে দিতে পারেন না মেয়েকে। দশ ডলার মানে তার কাছে যে প্রায় দুই দিনের খাবার খরচ!

এই জন্য জুলি সারা বছর অপেক্ষা করে বসে থাকে বড়দিনের জন্য। জুলির কাছে বড়দিন মানেই নতুন খেলনা। আমেরিকার বড় বড় বিপণিবিতানগুলোতে ২৫ ডিসেম্বরের আগে জুলির মতো শিশুদের জন্য Toy Drive–এর আয়োজন করা হয়।

যে কেউ চাইলে নিজেদের বড়দিনের কেনাকাটার সময় নতুন খেলনা কিনে দিতে পারেন সেই শিশুদের জন্য, যারা এমনিতে নতুন খেলনা পায় কম। স্কুলগুলোতেও এমন আয়োজন করা হয়। পরে এই খেলনা বড়দিনের আগে বিতরণ করা হয় উদ্বাস্তুদের মধ্যে আর গির্জায়।

পুতুল ‘সফি’
পুতুল ‘সফি’

গির্জাতে ব্যবহার করা পুরোনো কাপড়ও দিয়ে যায় অবস্থাপন্ন ঘরের লোকেরা। যে জন্য জেনিফারের মতো মায়েদের কাপড় কেনার খরচটা বেঁচে যায়। বড়দিনের আগে খাবারও দেওয়া হয় জুলিদের।

ওদিকে মেয়ের খোঁজে মাইকেল পরে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। তবে জুলির দেখা পাননি। জেনিফার চাননি বিশ্বাসঘাতক বাবার ছায়া পড়ুক মেয়ের ওপর। আমেরিকায় প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে পড়ানোর দায়িত্ব মার্কিন সরকারের। তাই জুলির লেখাপড়ার জন্য কোনো খরচ করতে হয় না জেনিফারকে।

সে বছর বড়দিনে খেলনা বিতরণের সময় জুলির ভাগে পড়েছিল দুষ্টুমিষ্টি খেলনা বিড়াল। যার নাম সফি (Sophie)। নতুন পুতুল পেয়ে জুলির খুশি দেখে কে? সেই থেকে জুলি যেদিকে যায়, সফিও সেদিকেই যায়। কারণ, খেলনা হলেও সফি জুলির প্রিয় বন্ধু যে।

দ্রষ্টব্য: কলেজে অতি গরমের সময় আইসক্রিমের লোভ হলেও অতিরিক্ত দামের জন্য ক্যাফেটেরিয়ার আইসক্রিম খেতাম না। আমার মতো অনেক ছাত্রছাত্রীর প্রিয় ছিল জেনিফারের আইসক্রিম। গল্পটা জেনিফারের মুখেই শোনা। আর রক্তমাংসের পুতুল জুলি সবার সঙ্গেই খেলত। গল্পের প্রয়োজনে জেনিফারের জীবনের গল্পে ১০ ভাগ কল্পনা মেশালাম।

আর সফি আমার জন্মদিনে আমার হাইস্কুল পড়ুয়া ভাইঝির দেওয়া উপহার। যে আপাতত বাংলাদেশে বসার ঘরের শো কেসে বসে আছে। খেলনা হলেও সফিকে ভালোবাসি। তাই ওকেও ঢুকিয়ে নিলাম গল্পে। পাঠকের যদি গল্পটা ভালো লাগে, তবে একটা পুতুল তুলে দেবেন কোনো সুবিধাবঞ্চিত শিশুর হাতে। ওদের হাসি দেখে পাওয়া তৃপ্তির কোনো তুলনা হয় না।
–––

কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। ই–মেইল: <[email protected]>