বছর ঘুরে বিদ্যার দেবী

পূজায় আগত ভক্তদের একাংশ। ছবি: লেখক
পূজায় আগত ভক্তদের একাংশ। ছবি: লেখক

সিডনিতে স্কুলগুলো খুলে গেছে। স্কুল খুলে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে স্কুলের পোশাক আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জামের একটা তালিকা স্কুলগুলোর ফেসবুকে ও অফিসগুলোয় সরবরাহ করা হয়েছে।
গত বছর পর্যন্ত আমাদের মেয়ে তাহিয়া স্কুলে যেত। এবার ছেলে রায়ানও যোগ দিয়েছে। সে এ বছর থেকে প্রি-স্কুলে যাবে।
এ দেশে প্রি-স্কুলে ক্লাস শুরুর প্রথম ধাপ হচ্ছে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকের একটা ইন্টারভিউ। এখানে শিক্ষার্থীকে যাচাইয়ের পাশাপাশি তাকে দেখিয়ে দেওয়া হয় স্কুলে এসে কোথায় কোন জিনিসটা রাখতে হবে, কোথায় টয়লেট করতে হবে—এসব।
সিডনিতে স্কুল খুলেছে ২৯ জানুয়ারি। কাকতালীয়ভাবে রায়ানের ইন্টারভিউয়ের দিনও ছিল একই দিন।
আমি আগে থেকেই ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম। খুব সকালে গিন্নি তৈরি হয়ে কাজে চলে গেলেন। এরপর আমরা তিনজন তৈরি হয়ে নিলাম।

প্রথমে তাহিয়াকে তার স্কুলে নামিয়ে রায়ানের চাইল্ড কেয়ারে গিয়ে সেদিনের খাবারগুলো নামিয়ে এলাম। কারণ, স্কুলের ইন্টারভিউ শেষ করে দিনের বাকি সময়টা তাকে চাইল্ড কেয়ারেই থাকতে হবে। চাইল্ড কেয়ারে খাবারগুলো রেখে রায়ানের স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলাম।

রায়ান স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত কোনো ঝামেলা করল না। আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পাঁচেক আগেই পৌঁছালাম। কিন্তু আমাদের আগে আরও দুজন ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক অপেক্ষমাণ ছিলেন। তাঁদের শেষ হতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। এই সময়ের মধ্যে রায়ান উতলা হয়ে গেল বাসায় ফেরার জন্য। আমি কোনোমতে তাকে বুঝিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম।

শঙ্খনাদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় সিটি কাউন্সিলের মেয়র ও কাউন্সিলর। ছবি: লেখক
শঙ্খনাদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় সিটি কাউন্সিলের মেয়র ও কাউন্সিলর। ছবি: লেখক

অবশেষে আমাদের ডাক পড়ল। আমি রায়ানকে নিয়ে শিক্ষকদের সামনে হাজির হলাম। রায়ান যথারীতি কান্নাকাটি করেই যাচ্ছিল। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও তাকে থামানো যাচ্ছিল না। কথা যা বলার আমিই বলে যাচ্ছিলাম। রায়ান একসময় চুপ করে গেল।
কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর আমাদের দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছিল রায়ানকে স্কুলে নিয়ে আসার পর কী কী করতে হবে। আমরা সব দেখেশুনে স্কুল থেকে বের হয়ে এলাম। কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর রায়ানের মুখে হাসির দেখা মিলল। আমরা পুরো স্কুল কম্পাউন্ড ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর বেশ কিছু ছবিও তুললাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে রায়ান সুবোধ বালকের মতো পোজ দিয়ে গেল। এরপর স্কুল থেকে বেরিয়েই ছুট লাগাতে হলো চাইল্ড কেয়ারে।
রায়ানকে চাইল্ড কেয়ারে নামিয়ে আমি গেলাম আমাদের সবার্ব মিন্টোর রন মুর কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে শঙ্খনাদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছে এ বছরের সরস্বতীপূজার। আমি ভেতরে গিয়ে দেখলাম সবে বিদ্যার দেবী আসন গ্রহণ করেছেন। চলছে আরতির প্রস্তুতি।

ভেতরে ঢুকে আমি সিদ্ধার্থ দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখন হাতেখড়ি দেওয়া হবে?’ তিনি বললেন, ‘দাদা, আরতির শেষে হাতেখড়ি দেওয়া হবে বেলা আনুমানিক দুইটা বা আড়াইটার দিকে। আপনি পৌনে দুইটার দিকে চলে আসেন।’

এরপর বাসায় ফিরে এসে আবার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রায়ানকে চাইল্ড কেয়ার থেকে ওঠাতে হবে আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে আর তাহিয়ার স্কুল ছুটি হবে তিনটার সময়। তাই আগে রায়ানকে উঠিয়ে তারপর তাহিয়ার স্কুলে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তাহিয়াকে নিয়ে ছুট লাগলাম রন মুর কমিউনিটি সেন্টারের দিকে।

এই ফাঁকে আমরা একটু ঘড়ির কাঁটায় ভর করে পেছন থেকে ঘুরে আসি। তাহিয়া যখন ছোট ছিল, আমার খুব ইচ্ছে ছিল ওকে হাতেখড়ি দেওয়ানোর। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত জীবনে আর অবসর হয়ে ওঠেনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রায়ানকে অবশ্যই হাতেখড়ি দেওয়ার।

গত বছরও পরিকল্পনা করে শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কারণ, গত বছর সরস্বতীপূজার দিন কার্যদিবস ছিল। এবার যেহেতু সকালবেলা রায়ানের ইন্টারভিউ ছিল, তাই আমার অর্ধেক দিন ছুটি নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। পরে যখন মনে পড়ল একই দিনে সরস্বতীপূজাও আছে, তাই পুরো দিনের জন্যই ছুটি নিয়েছিলাম। পাশাপাশি হাতেখড়ির উপকরণ খোঁজা শুরু করলাম।

চলছে হাতেখড়ি দেওয়ার কাজ। ছবি: লেখক
চলছে হাতেখড়ি দেওয়ার কাজ। ছবি: লেখক

বাংলাদেশে হাতেখড়ি সাধারণত চক আর স্লেটে দেওয়া হয়। আমিও তাই চক আর স্লেটের সন্ধান শুরু করলাম। সিডনিতে চক মোটামুটি সহজলভ্য। কিন্তু স্লেট পাওয়াটাই একটু কঠিন।
গুগলে সার্চ করে দেখলাম চেইনশপ কেমার্টে স্লেট পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো আকারে একটু বড়। ভাবলাম হোক না একটু বড়। স্লেট তো স্লেটই। একদিন মিন্টো শপিং সেন্টারের কেমার্টে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তারা একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। স্লেট খুঁজে পাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম চক কোথায় পাওয়া যাবে। সেটাও তারা দেখিয়ে দিল।
সেখানে গিয়ে দেখি, সেই চকগুলো বেশ বড় আকারের। আমি তাদের বললাম হাতে লেখার চকের কথা। তখন একজন কর্মী আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। হেঁটে হেঁটে একটা জায়গায় গিয়ে হাতের লেখার জন্য চক খুঁজে বের করলেন। আমি খুবই খুশিমনে চক আর স্লেট গাড়ির পেছনে রেখে দিলাম।

রন মুর কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে পাশের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে আমি রায়ানের হাত ধরে মণ্ডপের দিকে রওনা হলাম। তাহিয়ার হাতে ধরা ছিল চক আর স্লেট। অবশ্য শুরুতে তাহিয়া রাজি হচ্ছিল না স্কুল ড্রেস পরে পূজাতে যেতে। আমি ওকে বললাম, সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তিনি খুশি হবেন তুমি যদি স্কুল ড্রেস পরে যাও।

ওই সময় রবিন দাদা পূজা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে থামলেন। আমি বললাম, রায়ানকে হাতেখড়ি দেওয়াতে চেয়েছিলাম। শুনে তিনি বললেন, খুব ভালো করেছেন। পুরুত মহাশয় এখনো আছেন। সাধারণত সকালের পূজা শেষ করে তাঁর চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন কাকতালীয়ভাবে তিনি থেকে গিয়েছিলেন। রবিন দাদা গণেশ দাদাকে ফোন দিয়ে বললেন, ইয়াকুব ভাই এসেছেন তাঁর ছেলের হাতেখড়ি দেওয়ার জন্য।

আমরা ভেতরে ঢুকলে গণেশ দাদা এসে বললেন, ঠিক সময়েই এসেছ। আরেকটু দেরি হলে পুরুত মহাশয়কে পেতে না। আমরা ভেতরে ঢুলাম।

পুরুত মহাশয় তাঁর ছোট বাচ্চাটাকে স্টলারে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। গণেশ দাদার কথা শুনে তিনি নামাবলিটা গলায় জড়িয়ে একটা আসন নিয়ে এসে দেবী সরস্বতীর সামনে বসলেন। আমি প্যাকেট থেকে চক আর স্লেট দিলাম। ভেবেছিলাম রায়ান হয়তোবা কান্নাকাটি শুরু করবে। কারণ, নতুন কারও কাছে যেতে রায়ান সব সময়ই একটু সংকোচ করে। কিন্তু সেদিন রায়ান খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পুরুত মহাশয়ের কোলে শান্তভাবে বসে তার সঙ্গে চক দিয়ে স্লেটে লেখা শুরু করল।

পুরুত মহাশয় রায়ানের হাত ধরে চক দিয়ে স্লেটের ওপর বাংলা বর্ণমালার অ আ ই এবং ইংরেজি বর্ণমালার এ বি সি আর সংখ্যার ওয়ান টু থ্রি লিখে দিলেন। তাহিয়াসহ সেখানে উপস্থিত আরও কিছু বাচ্চা পুরুত মহাশয়ের পাশে গোল হয়ে বসে রইল। ঠিক যেমন বাংলাদেশে হাতেখড়ির সময় বাচ্চারা পুরুত মহাশয়কে ঘিরে থাকে।

হাতেখড়ির স্লেট হাতে তাহিয়া ও রায়ান। ছবি: লেখক
হাতেখড়ির স্লেট হাতে তাহিয়া ও রায়ান। ছবি: লেখক

হাতেখড়ি শেষ হয়ে গেলে পুরুত মহাশয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি এই লেখাগুলো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রায়ানের ঘরে ঝুলিয়ে রাখব। ও যখন বড় হবে তখন দেখবে। এরপর গণেশ দাদা প্রসাদ খাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। আমি একটু আগেই খাওয়াদাওয়া করেছিলাম তাই খিদে ছিল না। তাহিয়া বলল, সে প্রসাদ নেবে। তাই নকুল দাদা আমাদের জন্য একটা প্লেটে প্রসাদ তুলে দিলেন।
কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হয়ে আমি স্লেটটা এমনভাবে ধরেছিলাম যাতে কোনোভাবেই চকের লেখাটা মুছে না যায়। তারপর সেটাকে সাবধানে গাড়ির পেছনে রেখে বাসায় ফিরলাম। গিন্নি বাসায় ফেরার পর জেনে খুবই খুশি হলেন।
সময়ের পরিক্রমায় প্রতিবছরই বিদ্যার দেবী আসেন মানবকুলকে জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যায় আলোকিত করতে। বাংলাদেশে একসময় এই আচারগুলো ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে পালন করা হতো। জানি না এখন হয় কি না। তবে আমি আমার মতো করে বাচ্চাদের একটা বর্ণিল শৈশবের ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেখানে থাকবে সব রঙের ছোঁয়া।
ধন্যবাদ শঙ্খনাদকে আমাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। রায়ান-তাহিয়া বড় হয়ে যখন ওদের শৈশবের এসব কর্মকাণ্ডের ছবি দেখবে, আশা করি অনেক খুশি হবে এবং নব উদ্যমে জীবনযুদ্ধে আগুয়ান হবে।