বাজপাখি

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সামিয়া সেদিন বেশ সুন্দর একটি অ্যালবাম নিয়ে এলে সবাই তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে। ক্লাসরুমে খুব আগ্রহ নিয়ে সেটি দেখছে সবাই। পাঁচ-সাত মিনিট পরই অরুণ স্যার ক্লাসরুমে প্রবেশ করেন। সাধারণত শিক্ষক রুমে ঢুকতেই বই খুলে পড়ায় মনোযোগ দেয় সবাই। কিন্তু সেদিন তেমন কিছুই হলো না। সবার মনোযোগ অ্যালবামের দিকেই।

অরুণ স্যার কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ তোমরা?

সামিয়া, হ্যাপি, বরকত, রিপন আর সোহেল ম্যানেজমেন্টে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। এই পাঁচজনের এক ব্যাচ। তারা সকাল আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত এই এক ঘণ্টা সময় অরুণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে। সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকায়।

এই পাঁচজনের মধ্যে বরকত ছেলেটা বেশ মুখরা। তার মুখে কোনো কথা আটকায় না। তদুপরি লজ্জাশরম বলতে কিছু নেই। এ জন্য যখন-তখন তাদের মধ্যে ঝগড়া লাগে। প্রচুর মিথ্যা কথা বলে জিতে যাওয়া বরকতের স্বভাব। তাই তার কথা কেউ আমলে নেয় না। প্রতিটি পিকনিকে কিংবা শিক্ষাসফরে সে যাবেই। তবে কখনো এক টাকা চাঁদা দেয় না।

বরকত চট করে বলে ওঠে, স্যার, গতকাল সামিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

অরুণ স্যার স্বাভাবিকভাবেই বলেন, ও আচ্ছা।

বরকত বলেই যাচ্ছে, ছবিগুলো দেখলাম, স্যার। কী সুন্দর দেশ। কী সুন্দর সমুদ্র। সুন্দর সুন্দর মানুষ। আমার চোখে নেশা লেগে গেছে, স্যার। ওই দেশটাতে জীবনে একবার হলেও যেতে হবে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম, তাতে কী? পাত্রের কথা কী বলব, স্যার। ক্র্যাশ খাইছি। আমি যদি মেয়ে হতাম আর সামিয়ার মতো রূপ থাকত, এই ছেলে আমার কবল থেকে কিছুতেই রক্ষা পেত না, স্যার।

সবার অট্টহাসিতে ক্লাসরুম কেঁপে ওঠে।

আচ্ছা, ভালো তো। এখন ম্যাথ শুরু করো। চ্যাপ্টারটা আজ শেষ করতে হবে। অরুণ স্যার বলেন।

অরুণ স্যারের আজ মন ভালো নেই। কোনোভাবে ঠেলেঠুলে কয়েকটা অঙ্ক করে ২০ মিনিট যেতে না যেতেই বলেন, আমার শরীরটা আজ ভালো নেই। তোমরা চলে যাও।

কী যেন আঁচ করতে পেরে পরদিন সামিয়া পড়তে আসে না।

নয়টা বাজতে না বাজতেই হ্যাপি সামিয়াকে ফোন দিয়ে বলে, ঘটনা শুনেছিস?

না, কী হয়েছে বল।

গতকাল বিকেলে অরুণ স্যারের বড় বোন-ভগ্নিপতি আর স্যারের ছোট মামা-মামি এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। আজ নাকি সবাই তোদের বাড়িতে যাবে।

সামিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ে। মনে মনে বলে, এ আবার কোন নাটক? তারপর বলে, কেন? অরুণ স্যারের আত্মীয়স্বজন আমাদের বাড়িতে কেন আসবে?

আর বলছি কী? স্যারের বড় দুলাভাই আমাকে অনুরোধ করেছেন তোদের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে যেতে।

ওপাশ থেকে সামিয়া বলছে না কিছুই। গলা আটকে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বলে, কোনো খবরটবর না দিয়ে, কী বলছিস এসব?

খবরটবরের দরকার মনে করছেন না। তারা শুধু আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করবেন। এটুকুই।

কেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে চান? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আহারে। আর বলিস না। এদিকে স্যারও পড়ে গেছেন বিপদে। এখন তুই-ই বল, স্যারের এত আত্মীয়স্বজন এল তোদের বাড়িতে যাবে বলে। তবে শোন, এখন এক কাজ করি। তারা যাক তোদের বাড়িতে। আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলুক। যা বলার আঙ্কেলই বলে দেবেন। ঝামেলা চুকে যাক। স্যারকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর।

আজ ছয় বছর ধরে এই কলেজে পড়াশোনা করছে সামিয়া। বন্ধুবান্ধবী আর ক্লাস টিচার সবাই এত আপন হয়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে মনে হয় যেন একটি পরিবার। শিগগিরই এই কলেজজীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকে ফিরছে জীবনের গতি। পেছনের ফেলে আসা কিছু মায়া। সামিয়া চোখ মুছে মনে মনে বলে, স্যার এসব কী করছেন। কেন করছেন এসব। আমার যে কষ্ট হয়, স্যার কি জানেন না? ছয়টি বছর। একটু আভাস পর্যন্ত না। ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।

না, সামিয়া অরুণ স্যারের আত্মীয়দের আর কিছুতেই নিষেধ করতে পারে না। ওই দিন বিকেলে সবাই চলে এলেন। অতিথিদের আপ্যায়নের আয়োজন বেশ ভালোই ছিল। তবে অতিথিদের আয়োজন দেখে কারও মুখেই আর কথা সরছে না।

সামিয়ার মা-বাবা অতিথিদের আসার খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একমাত্র মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দেবেন তাঁদের। অরুণ স্যারসহ সবাই যেন বিয়েতে উপস্থিত থাকেন। সেই অনুরোধ করবেন। কিন্তু তাঁরা কী ভেবে এমন বিশাল আয়োজনে এলেন? দেখে মনে হচ্ছে এ আয়োজন দীর্ঘদিনের একজন ছাত্রীর বিদায়ের জন্য একটা গিফট যেমন হয়, এ তা নয় মোটেই। এ আয়োজনও হুটহাট করে এক দিনের প্রস্তুতি নয়। বহুদিনের পরিকল্পনা।

আগামী শুক্রবার সামিয়ার বিয়ে। এ খবর জেনে তার বাবার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে অতিথিরা সবাই চলে গেছেন। এদিকে বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।

সামিয়া তার রুমে এসে অরুণ স্যারকে ফোন দেয়।

স্যার, আপনি কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন?

সামিয়ার এ প্রশ্নের জবাবে অরুণ স্যার বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না। এদিকে সামিয়ার চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। তার এ অনুভূতি সে কিছুতেই আর ব্যাখ্যা করতে পারছে না। আজ তার এমন লাগছে কেন? জীবনে সময়গুলো মাঝেমধ্যে এমন হয় কেন?

বৃহস্পতিবার রাত আটটা। সামিয়ার গায়েহলুদ। ঝলমলে আয়োজন। বন্ধুবান্ধবী, আত্মীয়স্বজনে ভরে গেছে তাদের ছোট্ট বাড়িটি। পাত্রপক্ষ থেকে এসেছে লালপেড়ে হলুদ শাড়ি পরা ২০ জন মেয়ে। সামিয়া হ্যাপি, রিপন আর সোহেলকে ডেকে নিয়ে ভেতরে গেল। সামনে অলংকারের বক্স তিনটা। একটা অরুণ স্যারের বড় বোন-ভগ্নিপতির, আরেকটা দিয়েছেন ছোট মামা-মামানি। সেই সঙ্গে অরুণ স্যারের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটি বক্স, যেটি সামিয়া এখনো খুলতেই সাহস পায়নি। অনেক কষ্ট, একত্র হয়ে তার বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে।

সামিয়া সবাইকে অনুরোধ করে বলে, এই, তোরা এই জিনিসগুলো এখন কী করবি কর।

সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে আছে। সোহেল আস্তে আস্তে বলে, সামিয়া, কথাটা কী করে যে বলি। স্যারের আত্মীয়স্বজন পরদিন সকালে চলে গেছেন। সবাই তো ব্যস্ত। এদিকে স্যারের অবস্থা খুবই খারাপ। ক্লাসে যাচ্ছেন না। আজ সকালে গিয়ে যে অবস্থা দেখলাম, তা চলতে থাকলে কী হবে কে জানে।

রিপন বলে, আসার পথে আমরা এ আলোচনাই করছিলাম। স্যার শুধু এ কথাটাই বললেন, অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে ওখানে নাগরিকত্ব পাওয়া ছেলেরা যদি আমাদের তৈরি করা ছাত্রীদের কাছে এত মূল্যায়ন পায়, তবে এত কষ্ট করে বিসিএস পাস করলাম কেন?

হ্যাপি বলে, সামিয়া শোন, এখন তোর ইচ্ছা। তুই যদি বলিস তাদের দেওয়া সব জিনিস স্যারের বাসায় পৌঁছে দিতে, তবে তা–ই করব। কী করব বল।

সামিয়া মাথার দুপাশের চুল শক্ত করে জাপটে ধরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
---

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>