প্রবাসে দ্বৈত জীবন

প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

প্রবাস শব্দের অর্থ বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে আছে ‘বিদেশে অবস্থান’। আর প্রবাসী শব্দের অর্থ আছে ‘নিজ দেশ ভিন্ন অন্য দেশে বাস করে এমন’।

অভিধানে যা-ই থাক, আমার মনে হয় ‘যে জীবনে একজন মানুষ শারীরিকভাবে একটা দেশে অবস্থান করে আর মানসিকভাবে সে তার জন্মস্থান আর বিদেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত ছোটাছুটি করে। আর এই ছোটাছুটি এতটাই বেশি, যেকোনো মুহূর্তে সেই প্রবাসী কোন দেশে আছেন, এটা তাঁর জন্য বলা কঠিন।

আমার জানা মতে, বেশির ভাগ মানুষ প্রবাসে থাকেন জীবিকার তাগিদে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। আমি নিজেও তাঁদের একজন। অনেকেই পড়ালেখার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। তবে সেটার পেছনেও আছে জীবিকা।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অনেক প্রবাসীকে অনেক রঙিন ছবি আপলোড দিতে দেখা যায়, যা দেখে স্বদেশের অনেক মানুষ সুখে গড়াগড়ি দেন। আবার কেউ কেউ ভেবে বসেন, আমরা কত কষ্টে আছি আর উনি বিদেশে বসে ফুর্তি করছেন। সেই রঙিন ছবিগুলোর পেছনে অনেক কষ্ট থাকে, যা সাদা-কালো। সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

অনেকের ধারণা, বিদেশ মানেই টাকা আর টাকা মানেই সুখ। অথবা বিদেশে টাকা না থাকলেও সুখ। কারণ দেশে সমস্যা অন্তহীন, কোথাও শান্তি নেই। এই ভুল ধারণাটা থেকেই যায় যতক্ষণ না কেউ বিদেশ যায়। তবে এটাও বলছি না বিদেশ মানে শুধুই কষ্ট। যেটা বলছি সেটা দ্বৈত জীবনের কথা, যেখানে মুখে হাসি, চোখে কান্না।

আবার দেশের কালচার আর বিদেশের কালচার মিলিয়ে থাকার যে অন্তহীন সংগ্রাম, সেটা নিয়ে রচনা লিখেও শেষ করা যাবে না।

আর দেশে প্রিয়জন রেখে এলে এই দ্বৈত জীবনের অবস্থা হয় আরও ভয়াবহ। প্রায় ৬৫ বছর বয়সী মো. রফিক (ছদ্মনাম) আমেরিকায় থাকেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি বাণিজ্যিক জাহাজে কর্মরত ছিলেন। একবার সেই জাহাজ পণ্য নিয়ে সানফ্রান্সিসকো পোর্টে নোঙর ফেলে। জাহাজের সবাইকে কয়েক দিনের জন্য স্বপ্নের দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়। এই কয়েক দিনে জাহাজ নিয়ে আসা পণ্য খালাস করে নতুন পণ্য নিয়ে আবার নতুন গন্তব্যে রওনা দেবে।

লেখক
লেখক

ভাঙা কপাল জোড়া দেওয়ার এ রকম সুযোগ আর আসবে না। এই ভেবে রফিক জাহাজ থেকে অন্যদের সঙ্গে নেমে পড়েন এবং পরিকল্পনা মোতাবেক আর জাহাজে ফিরে যান না। এদিকে জাহাজ থেকে দেওয়া সেই নির্দিষ্ট কয়েক দিন পার হয়ে যায় এবং বৈধ কোনো কাগজ সঙ্গে না থাকায় আমেরিকান সরকারের অবৈধ অভিবাসীর খাতায় রফিকের নাম উঠে যায়। ফলে ইমিগ্রেশন পুলিশ রফিককে খুঁজতে থাকে। রফিকও পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশে রেখে আসা তার বউ, ছোট ছেলেটা আর বাচ্চা মেয়েটা তার বাড়ি আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনতে থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও রফিক পরিবার থেকে বিদায় নিয়েছে এবং দু-তিন মাসের মধ্যেই ফিরে আসবে বলে গেছে সবার কাছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য দুই দশক চলে যায় রফিক বাড়ি ফেরে না। যখন ফেরে তখন তার বাবা আর বেঁচে নেই। বউ অর্ধবয়স্ক, ছেলে যুবক, আর মেয়েটা সুন্দরী ছিল বলে বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই এলাকার একটা ছেলে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করে ফেলেছে।

এই দুই দশক রফিকের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, তা পাঠক নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছেন। এটা হলো প্রবাস জীবনের অতি শোচনীয় অবস্থাগুলোর একটা। আবার ভালো গল্পও রয়েছে। অনেক প্রবাসী পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব ভালো আছেন। তবে একটা কথা সবাই স্বীকার করবেন আর সেটা হলো, দেশের কথা তাদের মিনিটে মিনিটে মনে পড়ে। আমি বিদেশ যাওয়ার পক্ষে, তবে সেটা কোনো চাপে পড়ে নয়।

যদি কখনো কোনো প্রবাসীকে একদৃষ্টিতে কোথাও তাকিয়ে থাকতে দেখেন, তবে ভাববেন তিনি দেশে আছেন। ধাক্কা দেবেন না। আর দেশে যদি কখনো কাউকে একদৃষ্টিতে কোথাও তাকিয়ে থাকতে দেখেন, ভাববেন তিনি বিদেশ যাওয়ার রঙিন স্বপ্নে ডুবে আছেন। ধাক্কা দিতে পারেন।