সংক্ষুব্ধ মনে শীতের বরফ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

টরন্টোতে মাঝেমধ্যে সপ্তাহান্তে বাজারে যাই। দেশি শাকসবজি আর মাছ–মাংস কেনার জন্য। অনেক দিন পরপর যাই। তাই বাজারও করি অনেক। একবার আমার এক আত্মীয় চোখ বড় করে বলেছিলেন, ভাই, বিয়েবাড়ির বাজার করছেন নাকি?

আমি অন্টারিওর ছোট্ট শহর গুয়েলফে থাকি। টরন্টো থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে।

কিছুদিন আগে এক মঙ্গলবার অফিসের কাজে টরন্টোতে গিয়েছিলাম। তাই ফেরার পথে বাজারটা সেরে ফেলতে চাইলাম। সন্ধ্যা ছয়টায় গেলাম ডেনফোর্থ রোডের একটি দেশি দোকানে।

ভিড় খুব সামান্যই। তবু মাছ–মাংসের লাইনে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পার হয়ে গেল। এরপর দোকানি জিজ্ঞাসা করলেন, কী লাগবে?

বললাম, ২০ পাউন্ড বনলেস ভিল দিন।

দোকানি নিচে ট্রেতে দেখলেন সেই পরিমাণ হবে না। তাই ফ্রিজের ভেতর থেকে আনতে গেলেন। মিনিট কয়েক পর কাঁধে করে আনলেন। কাটলেন, মাপলেন ও লিস্টে দাম লিখলেন।

তারপর বললেন, আর কী লাগবে?

বললাম, ২০ পাউন্ড বনসহ ভিল দেন।

তিনি নিচে ট্রেতে দেখলেন সেই পরিমাণ হবে না। তাই ফ্রিজের ভেতর থেকে আনতে গেলেন। মিনিট কয়েক পর কাঁধে করে আনলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিকটার দেব?

কাঁধের অংশ থেকে দেন।

তিনি কেটে কাঁধের অংশ ওজন করলেন।

বললেন, আর কী লাগবে?

পাঁচটা হার্ড চিকেন।

চারটা ট্রেতে ছিল, আরেকটা বড় ফ্রিজ থেকে আনলেন। তিনি ফ্রিজার রুমে ঢুকলেন ও বেশ খানিকক্ষণ পর আবার বললেন, আর কী লাগবে?

২৫ পিস ড্রাম স্টিক।

সেটি ট্রে থেকে উঠিয়ে ওজন করতে দেবেন এমন সময় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, এই যে ভাই, আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।

দোকানি থতমত খেয়ে আমাকে বাদ দিয়ে তখন আমার পেছনের ব্যক্তির খেদমত করা শুরু করলেন ও তার মুরগি, মাংস, মাছ—সব অর্ডারই নিলেন।

আমিও তাঁকে কিছু বলতে পারলাম না। মফস্বল থেকে রাজধানীতে গেছি এ রকম ভাব নিয়ে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভিতু প্রকৃতির মানুষ আমি।

লোকটির চোখের দিকেও তাকালাম না। আড়চোখে পাশ থেকে দেখলাম, ফুলহাতা শার্ট ও টেট্রন প্যান্ট। শার্ট–প্যান্টের ইস্ত্রি মলিন। হয়তো কেনার পর আর কোনো দিন ইস্ত্রি করেননি। মাঝবয়সী। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। দেখলে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। আসলে হয়তো তা নয়।

কথায় আছে, While in Rome be a Roman, কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিরা পারলে রোমানদের বাঙালি বানাবে। লাইন ভেঙে নিজে আগে যাবে। বোঝাবে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ফ্রি আলকাতরা খাওয়া শেখাবে।

মনে মনে লোকটাকে ইতর মনে করে গালি দিলাম। সব শেষে নায়াগ্রার জলপ্রপাতের চূড়া থেকে বারকয়েক ছুড়ে মারলাম। লোকটা ১৭৬ ফুট নিচে চ্যাংদোলা হয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য মনে মনে ভেবে এক ধরনের প্রশান্তি পেলাম।

এরপর দোকানি আমার অর্ডার নেওয়া শেষ করলেন।

পরে দেখি, লোকটি দোকানের এ–মাথা থেকে ও–মাথা অনেকটা দৌড়ে জিনিস ট্রলিতে নিতে থাকলেন। অস্থির প্রকৃতির মনে হলো। পাড়ার মনু পাগলার মতো। মনু পাগলার মাথা গরম হলে অনবরত পানিভর্তি বোতল ঝাঁকাত। মনে হচ্ছে, তাঁকে পানিভর্তি বোতল দিয়ে মাথায় এক বাড়ি দিয়ে বলি, নে, এটা নিয়ে ঝাঁকা।

আমিও ট্রলিতে কিছু দেশি সবজি নিলাম। কয়েকবার তার পাশ দিয়ে গেলাম। লোকটি মাথা নিচু করে মুখ ঘুরিয়ে নেন। আমি ভাব দেখালাম ভাবলেশহীন। তোমাকে কেয়ার করি না।

বাজার গাড়িতে তোলা প্রায় শেষ। দেখি, লোকটা ট্রলি আইল্যান্ড থেকে নামানোর চেষ্টা করছেন। আইল্যান্ড থেকে রাস্তার র‌্যাম্পটা অসমান। নিচের চাকা আটকে যায়।

তিনি জোরে ঠেলতে গিয়ে ট্রলিটাই কাত হয়ে পড়ে গেল। জিনিসপত্র সব বের হতে থাকল। বেচারা বেসামাল, একটা তোলেন তো আরেকটা দৌড় মারে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করলাম। সবকিছু তোলা শেষ। একটি ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলেন না। চলে আসছি এমন সময় তিনি পেছন থেকে হাত ধরলেন।

ঘুরে চোখমুখে চরম বিরক্তি প্রকাশ করলাম।

তিনি বললেন, ভাই, মেয়েকে টিউটরিংয়ে রেখে এসেছি, তাই একটু তাড়াহুড়া করছিলাম। মনে কিছু নেবেন না।

আমি হাঁ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যে লোককে কিছুক্ষণ আগে ১৭৬ ফুট নিচে ছুড়ে ফেলছিলাম, এখন আর তাঁকে ছুড়তে ইচ্ছা করছে না।

লোকটি না থেমে বললেন, আসেন না এক দিন আমার বাসায় চা খেতে। ২৪ তলায় অ্যাপার্টমেন্ট। পুরো টরন্টো শহর দেখা যায়। আর এক পাশে অন্টারিও লেক।

আমার সংক্ষুব্ধ ও উত্তপ্ত মনে শীতের বরফ এসে পড়ল। ভাবলাম, মন্দ কী, ২৪ তলায় গাঙচিল হয়ে টরন্টো দেখা যাবে।