বরফে বাংলাদেশি প্রতিভাবানদের জাপানি ছায়া

কানাডীয় শিশুদের সঙ্গে বাংলাদেশি মেধাবীরা
কানাডীয় শিশুদের সঙ্গে বাংলাদেশি মেধাবীরা

তখন নভেম্বর মাস। ২০০০ সাল। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে অনেক গবেষক ঢাকায় আসবেন। এশিয়ায় জৈব রসায়ন গবেষকদের সঙ্গে তাঁরাও বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করবেন।

দেশ-বিদেশের এই বিজ্ঞানীদের মিলনমেলা হবে ওসমানী মিলনায়তনে। সেটা ঢাকায়। সায়েন্টিফিক কনফারেন্স। নাম ASOMPS-X, এশিয়া মহাদেশে ন্যাচারাল কেমিস্ট্রি গবেষণায় অগ্রগতি চিত্রায়ণে উল্লেখযোগ্য এক বড় আসর।

এই আয়োজনে সফলতা আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগ ও বিসিএসআইআরের একদল তরুণ গবেষক প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করছেন আয়োজক শিক্ষকদের।

সেই দলের উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহীরা খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষকদের কাছাকাছি থাকার লোভনীয় সুযোগকে হাতছাড়া করেননি। বিভাগে নিজ কাজের পাশাপাশি কনফারেন্স সময়ে উন্নত বিশ্বের সেই সব শিক্ষক ও তাঁদের গবেষণাকে জানার আগ্রহ তুলে ধরার সে সুযোগ।

বেশ সফলতার সঙ্গে শেষ হয়েছে সেই সায়েন্টিফিক কনফারেন্স।

তখন রসায়নে এশীয় গবেষকদের ভিড়ে অনেক বিদেশি অতিথির একজন ছিলেন জার্মানির প্যাডারবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্স্টেন ক্রন। সাদামনের জ্ঞানী মানুষ।

এসেছিলেন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকেশি কিতাহারা স্যারও। দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পরোপকারী বিজ্ঞজন।

দেশের মাটিতে সাক্ষাতের আগেই তাঁদের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন সহযোগী সেই তরুণ দলের একজন। নাম ভুলু। সাক্ষাতে বিস্তর আলোচনা-গবেষণা, একাডেমিক রেজাল্ট, আগ্রহ ইত্যাদি।

নিজ দেশে ফিরেই অধ্যাপক ক্রন ফ্যাক্সে ভুলুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর ল্যাবে উচ্চতর গবেষণার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে আটকে মাস্টার্স শেষ না হওয়ায় জার্মানির স্বপ্নটা বিলম্বিত হয়ে গেল। ডিগ্রিটা হলো। উচ্চতর গবেষণার স্বপ্নটাও পরে হাতে এল।

তবে অবাক বিস্ময়ের মতো সেটা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খ্যাতনামা অধ্যাপক কিতাহারা সব ব্যবস্থা করেছিলেন। শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভুলু চলে যান টোকিওতে।

বাংলাদেশের অগণিত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও গবেষক উচ্চতর শিক্ষার আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে ভুলুর মতো বিদেশে পাড়ি দেন। বিভিন্নভাবে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা, জাপান সবখানে। সারা দুনিয়ায়।

গবেষণা আর অর্থনীতিতে জাপান একটি উন্নত দেশ। বিশ্বে তারা প্রথম সারিতে। সেখানকার অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া আর গবেষণা করেন। জাপানের হোক্কাইডো থেকে কিউসু, আমাদের উপস্থিতি আছে এর প্রায় সব শহরে।

প্রতিবছর শতাধিক ছাত্রছাত্রী শুধু জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান। সংখ্যায় সব থেকে বেশি। প্রায় ৮৫ ভাগ।

মনবুশো হলো মনবুকাগাকুশো বা মেক্সট। এটা জাপান সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ফান্ড। শিক্ষায় এ ছাড়া আছে রোটারি, জেডিএস, জাইকা, ইউনেসকো ইত্যাদি ফান্ড।

দেশীয়রা সর্বাধিকসংখ্যক যান গবেষণাকাজে। এমএস, পিএইচডি, পোস্টডক ও অন্যান্য গবেষণায়। এসব হলো বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষিসহ অন্য বিষয়ে গবেষণা।

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। আর বাংলাদেশের পতাকায় সুন্দর একটি মিল আছে। সাদার মাঝে লাল বৃত্ত। আর সবুজের মাঝে লাল। তাদের লাল বৃত্ত হলো সূর্য। বাংলাদেশের পতাকায় লাল হলো স্বাধীনতার জন্য দেওয়া রক্ত। পতাকায় মিলের মতো এই দুই দেশের সম্পর্কটাও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ।

উন্নয়নের সূচকে অবস্থান আর সব বৈশিষ্ট্যে বিস্তর ফারাক যদিও। তবে দেশীয় প্রতিভাবান মানুষেরা ওখানে গিয়ে দ্রুতই জাপানিদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিজেদের খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন।

জাপানিরা জ্ঞানপিপাসু, বিনয়ী, পরোপকারী, নিয়মানুবর্তী, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ও সৎ। আর অত্যন্ত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। সর্বোপরি তারা কঠোর পরিশ্রমী।

প্রথম আলোতে ইতিপূর্বের লেখা জীবন যেখানে যেমন –এর তৃতীয়াংশে জাপানে অভিজ্ঞতার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।

নিয়মানুবর্তী আর দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সেই জাতির মানুষের কাছে সময়ের মূল্য সীমাহীন। কর্মদিবসে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পোঁছাতে অফিসগামী মানুষের ছুটে চলার দৃশ্যটা সেখানে অবলোকন করেছি অনেক বছর।

টোকিও, ওসাকা, কিওটো, নাগোইয়ার মতো বড় শহরে পথ চলতে ট্রেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। দূরের পথ চলতে আছে দ্রুতগতির শিনকানসেন বা বুলেট ট্রেন। সিটি বাস, গাড়ি, আর সাইকেলের ব্যবহার সব জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও সাইকেল ব্যবহার করেন।

প্রয়োজনীয় হাঁটাপথটা পার হতে সেখানে সবাই যেন ঠিক দৌড়াচ্ছেন। জীবনের পথচলাটা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। তাই এক মিনিট সময়েরও জবাবদিহি আছে।

কয়েক মিনিট পরপর স্টেশন থেকে একেকটি ট্রেন ছেড়ে যায়। তবু সূচি অনুযায়ী ট্রেন ঠিক সময়ে না ছাড়ায় জাপান রেলওয়ের প্রধানকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার নজির আছে। সততা, পরোপকার, বিনয়ের অনেক উদাহরণ আছে। সেসব লিখব অন্য কোনো দিন।

জ্ঞানপিপাসু জাতির সেই মানুষদের দ্বারে শিক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ থাকে শত শত বাংলাদেশি। দেশের ছোট–বড় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যাওয়া আমাদের মেধাবীরা। শিক্ষা ও গবেষণায় ভালো করে অর্জন হয় মাস্টার্স, পিএইচডি আর পোস্টডক।

সেখানে দেখা শত মেধাবী মুখের চেহারা স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। প্রিয় সেই মানুষগুলো জীবনের প্রয়োজনে আবারও ছুটে গেছেন অন্য কোথাও। জাপান থেকে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে। অনেক বছর কাছাকাছি থাকা সেসব মানুষকে হারালেও বন্ধুত্বটা থেকে যায়।

এমনই অনিন্দ্যসুন্দর বন্ধুত্বের বন্ধনে অন্যদের মতো সেখানে পাশে ছিলেন দেশীয় অনেক প্রতিভাবানেরা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক মলিকুলার বায়োলজিস্ট ড. আনোয়ার। মেধা পাচার লেখায় (<www. prothomalo. com/nagorik-sangbad/article/ 1594945 >) এক তুখোড় মেধাবী। সেখানে একই ভবনে আমরা কাজ করেছি।

শিশুদের হাসিভরা মুখের জন্য জন্মদিনের আয়োজন
শিশুদের হাসিভরা মুখের জন্য জন্মদিনের আয়োজন

সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেএসপিএস ফেলো জিওকেমিস্ট ড. ফারুক ও তাঁর সহধর্মিণী পরিবেশবিজ্ঞানী ড. হাওয়া। আড্ডা জমানোতে তাঁরা গুরুজন।

অরগানোমেটালিক কেমিস্ট যুগল ড. কবির ও ড. বিলকিস গবেষণা করেছিলেন হিওগোতে। পরে সেপনে পোস্টডক।

আইটি বিশেষজ্ঞ নরম মনের মানুষ ড. আলতাফ দেশে নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। উচ্চতর গবেষণা করেছেন ওসাকাতে।

সদা হাস্য বায়োকেমিস্ট জুটি ড. সুমন ও ড. সায়েমা।

কঠোর পরিশ্রমী ও স্বল্পভাষী ইভা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স। গবেষণা করেছেন সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

জীবনসংগ্রামের ছুটে চলায় জাপান থেকে পাড়ি দিয়ে তাঁরা এখন শীতপ্রধান দেশ কানাডায়। ভাগ্যচক্রে কাছাকাছি তাঁরা। বাংলাদেশি এই প্রতিভাবানদের ভেতরে ধারণ করা অনেক সুন্দর জাপানি কালচার কানাডার বরফে নিত্যদিনের পথচলায় বেশ প্রতিফলন দেখা যায়। বরফে তাঁদের জাপানি ছায়া যেন।

লেখক
লেখক

স্বল্পভাষী হলেও ইভা তাঁর নিজ পরিবারের হোম মিনিস্টার। সবকিছুতে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বুকের রক্তে ভেজা বাংলার সবুজকে স্বাধীনতা এনে দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা বাবার আদুরে এই মেয়ে একজন সফল রসায়নবিদও। পরিশ্রমী।

পাইরোফোরিক (অতিমাত্রায় দাহ্য) সব জটিল যৌগের গুণাগুণ অ্যানালাইসিস শেষ করে অফিস থেকে ফিরে বাসায়ও সব কাজ সামলান। রান্নার কাজ, বাচ্চাদের পড়ানো, ওদের বিনোদন—সবকিছুতে। বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা।

শীতপ্রধান দেশে কনকনে ঠান্ডা আর তুষারপাতের মাঝেও তাই এই জানুয়ারিতে একদিন পরিবারসহ আত্মীয় ও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মেধাবী মুখ কম্পিউটার সায়েন্সের রাফা, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আহনাফসহ মঞ্জুর মামার পরিবারকেও।

টোকিওতে জন্ম নেওয়া তখনকার শূন্য বছরের বড়ই আদুরে মেয়ে এখন দুই অঙ্কের বছরে পা দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে সেটা উদ্‌যাপনে। শিশুদের হাসিভরা মুখ দেখতে।

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা। ই–মেইল: <[email protected]> ফেসবুক: <sadequl>