নদী বহমান পানি অফুরান

শিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত সার-কীটনাশক এবং ঘরবাড়ির আবর্জনাও মিশে যাচ্ছে নদীতে। এর প্রভাবে সবচেয়ে দূষিত হচ্ছে তুরাগ নদের পানি। আশুলিয়ার বিরুলিয়ায় তুরাগ নদ। ছবি: দীপু মালাকার
শিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত সার-কীটনাশক এবং ঘরবাড়ির আবর্জনাও মিশে যাচ্ছে নদীতে। এর প্রভাবে সবচেয়ে দূষিত হচ্ছে তুরাগ নদের পানি। আশুলিয়ার বিরুলিয়ায় তুরাগ নদ। ছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশ নদীর দেশ। নদ–নদী, খাল–বিল, ছোট–বড় জলাশয় গাছের পাতার শিরা–উপশিরার মতো আমাদের দেশটির অবয়বজুড়ে সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছিয়ে আছে। বন্যা-জলোচ্ছ্বাস প্রতিবছরের সঙ্গী। এরপরও সে জল কল্লোলিত দেশটির সম্ভাবনার কথা শুনলে আমাদের সবার মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা।

এর আগে একটি কথা মনে করাতে চাই। তা হলো পরিবেশ সম্পর্কিত এক প্রবন্ধে আমাদের দেশে পানি অপচয়ে মানুষের অভ্যাস ও আচরণের কথা বলা হয়েছিল। প্রজ্ঞার সঙ্গে পানি ব্যবহার করলে বাংলাদেশ ও তারই পাশাপাশি বিশ্বেরও উপকার হবে। আমাদের দেশ পানির দেশ। তাই পানি বাংলাদেশে অফুরান। তবুও বলা বাহুল্য যে পানি দেশে সমস্যামুক্ত নয়।

প্রবাসী লোকজন দেশে গেলে পানি পানে সতর্ক থাকেন। কখনো বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের ঠিক দোষও দেওয়া যায় না।

তাঁরা যখন বিরক্তি নিয়ে বলেন, শুধু দূষিত পানি পানের কারণেই তারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে নীত হয়েছিলেন। কেউ কেউ হাসপাতালে যাওয়ার মতো দুর্গতিতে না পড়লেও কিছু সময়ের জন্য হলেও তাঁদের সঙ্গী ছিল বদনা আর ঘন ঘন যেতে হয়েছিল...। ইত্যাদি সমস্যার কারণে তাঁরা বাংলাদেশের পানির ওপর মহাখাপ্পা।

তাঁরা একবারও তলিয়ে ভেবে দেখেন না, পানি যদি এতই খারাপ হতো, তবে বাংলাদেশের অনেক মানুষই সহজে ভবলীলা সাঙ্গ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। বাস্তবে তা তো ঘটছে না।

আসল কথা প্রবাসীদের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা)। বিদেশে নির্ভেজাল খাবার খেয়ে খেয়ে ও বিশুদ্ধ পানি পান করে অন্য ধরনের বা সামান্য নাজুক মানের খাবার খাওয়ার চ্যালেঞ্জ তাঁরা নিতে পারেন না।

প্রবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশিরা নিম্নমানের ভেজাল খাবার খেয়ে ও বিদেশের তুলনায় নিম্নমানের পানি পান করা সত্ত্বেও তাঁদের অবস্থা বিস্ময়করভাবে ভালো। এ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়, in terms of survival capacity বাংলাদেশের মানুষ শক্তপোক্ত বেশ। কথাটা ঠিক নয় কি?

বলা যায় কথাটা ঠিক। সহ্য করার ক্ষমতা আছে বলে বাংলাদেশের মানুষ কি তাই বলে ভেজাল খাবার ও দূষিত পানির আবর্তে পড়ে থাকবে? অবশ্যই নয়। সচেতন ও বিবেকবান মানুষমাত্রই বলবেন, পৃথিবীর অন্য সব মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষেরও অধিকার আছে নির্ভেজাল খাবার ও বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির।

কোনো একসময়ে অস্ট্রেলীয় একটি টিভি চ্যানেলে পানিসংকট নিয়ে আলোচনা চলছিল। নিত্যব্যবহার্য পানির মূল্যবৃদ্ধি করে মানুষকে কম পানি খরচে বাধ্য করার কথা ভাবা হচ্ছে। আলোচকদের একজন ছিলেন অস্ট্রেলীয় লেখক-দার্শনিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির বায়োএ্থিকসের প্রফেসর পিটার সিঙ্গার। তিনি বলেছিলেন, পানির পরিমিত ব্যবহার করার জন্য তাঁর পরিবারে সবাই বালতিতে পানি নিয়ে খরচ করে।

আলোচনাতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হলো, ভবিষ্যতে পানিসংকটের কারণে অস্ট্রেলিয়ায় ধান ও নারকেলের চাষ সংকুচিত করতে হবে।

উপস্থাপক তখন উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন, তখন উপায় কী?

পিটার সিঙ্গার এ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বলেন, নদী ও পানির দেশ বাংলাদেশ, ওখানে প্রচুর ধান ও নারকেল উৎপাদিত হয়; ওখান থেকে আনা যেতে পারে।

আমরা প্রায় সব সময় শুনি দরিদ্র ও প্রায় সম্ভাবনাহীন এক দেশ বাংলাদেশ। এর মধ্যে এমন ইতিবাচক কথা শুনে মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে অবশ্যই।

তবু এ কথা অনস্বীকার্য, বহতা নদীর দেশে সবাই যে চাহিদা অনুযায়ী খরচ করার মতো পানি পান তা নয়। দরিদ্র বস্তিবাসীর কথা বাদই দিচ্ছি। কলকারখানার শ্রমিকেরা কর্মসম্পাদনের সময়েও প্রক্ষালনের জন্য আইনত প্রাপ্য পানিটুকু পান না। আইননির্ধারিত টয়লেট–সুবিধাও শ্রমিকদের দেওয়া হয় না।

একসময়ে শ্রম আইন নিয়ে কিছু কাজ করেছিলাম। আইনের অজ্ঞতা মানুষকে বিপদগ্রস্ত যেমন করে, আবার অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে। কাজের উদ্দেশ্য ছিল Dimystification of Law। এই মোতাবেক সহজ–সরল ভাষ্যে আইনের তথ্য নিয়ে কিছু পুস্তিকা সংকলন করি, যা তৎকালীন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা থেকে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়।

সিলেট শহরের পাশে চেঙ্গেরখাল নদে অনেকেই ঘুরতে আসেন। এই নদের টলটলে শান্ত জলের সৌন্দর্য অন্যরকম। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেট শহরের পাশে চেঙ্গেরখাল নদে অনেকেই ঘুরতে আসেন। এই নদের টলটলে শান্ত জলের সৌন্দর্য অন্যরকম। ছবি: আনিস মাহমুদ

এর মধ্যে একটি পুস্তিকা হলো ‘শ্রমজীবী নারীর অধিকার’। সে সময়ে আইএলও কনভেনশনের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রম আইনের (স্ট্যান্ডিং অর্ডার ১৯৬৫) তুলনামূলক সামঞ্জস্য দেখতে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছিল। তাতে তখন দেখা গিয়েছিল যে বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ শ্রম আইন মন্দ নয়। তবে তার কতটুকু কার্যকরভাবে অনুসরণ ও প্রয়োগ করা হয়, তা পর্যবেক্ষণের বিষয়।

সুন্দর সুন্দর বিধিবদ্ধ আইন পুস্তকে থাকলেই হবে না। এর যথাযথ প্রয়োগ না হলে ওই আইনের সার্থকতা নেই। এ হবে বইয়ের পাতায় বন্দী আইন। আইনজীবী ও মানবাধিকার প্রবক্তা সালমা সোবহান এ ধরনের আইন সম্বন্ধে যথার্থ একটি কথা বলেছিলেন, ‘Cost free legislation’.

শুধু যদি শিল্পকারখানায় শ্রমিকের আইন নির্ধারিত পানির প্রাপ্তির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা যায় তাতেই বোঝা যায় আইন কেবল বইয়েই আছে, প্রয়োগে নেই। শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য যে কয়টি টয়লেট ও প্রক্ষালনের জন্য যে পরিমাণ পানি (শ্রমিক প্রতি আড়াই গ্যালন পানি) সরবরাহ করার নির্দেশ আইনে রয়েছে তা দূরস্ত।

আজ পরিবেশ বাঁচানোর সঙ্গে পানিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিল্পকারখানায় পানির সঠিক ব্যবহারও পরিবেশ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশুদ্ধ পরিমিত পানি যেমন শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য দরকার, যা তাদের সুস্থতা ও কর্মক্ষমতায় অবদান রাখবে। তেমনি শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যমিশ্রিত পানি তার চারপাশের পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনের ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট। ছবি: লেখিকা
আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনের ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট। ছবি: লেখিকা

শিল্পকারখানার নোংরা পানি পড়ে পড়ে নদী দূষিত হচ্ছে। অনেক নদীই বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। শিল্পকারখানার পানি রিসাইক্লিং বা পরিশোধন করে পুনর্ব্যবহার করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই নদী বাঁচবে, পরিবেশ সুস্থ থাকবে।

বাংলাদেশের সুপরিচিত একটি উন্নয়ন সংস্থায় এমনি পানি রিসাইক্লিং বা পরিশোধনের ব্যবস্থা দেখে আশা জাগে বাংলাদেশ চাইলে পারে ও পারবে।

ঢাকা থেকে সামান্য দূরে মানিকগঞ্জ। প্রধান সড়ক থেকে দেখা যায় ব্র্যাকের উদ্যোগে শ্রমজীবী নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি বা উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশন। সুইসুতার কাজ, ব্লক প্রিন্ট, বাটিক প্রিন্ট, ভেজিটেবল টাই ডাই—সব কাজই গ্রামের মেয়েরা করছেন ওখানে। সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে মুখর থাকে আয়শা-আবেদ ফাউন্ডেশন ও সংলগ্ন ব্র্যাক রিজিওনাল।

বেশ কয়েক বছর আগে আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনে গিয়ে ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট দেখে একটু অবাক হই। যে দেশে এত এত পানি উপচে পড়ছে, সে দেশে কেন আবার পানি রিসাইকেল করতে হবে? ভোরবেলা রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছিল। ক্যামেরাবন্দী হলো দৃশ্যটা।

আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট তৈরির যৌক্তিকতা জানা হলো। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেই ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের সীমানা যেখানে শেষ তারপরই খাঁড়া মাটির পাড়। তার নিচেই আবাদি জমি। শস্য আবাদ হয় জমিতে।

ফাউন্ডেশনে নানান কাজে ব্যবহার করার পর ময়লা পানি খাঁড়া মাটি বেয়ে পড়ত। ফসলের জমিতে তখনো পানি পৌঁছায়নি, দেখা গেল ওই পানিতে মাটির রং কেমন বদলে যাচ্ছে। টাই ডাই ইত্যাদিতে ব্যবহার করা কেমিক্যালের কারণে পরিত্যক্ত পানি দূষিত ছিল। তাতেই ধীরে ধীরে মাটির রং বদলাতে শুরু করে।

তখন ব্র্যাক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সচেতন হন। যাতে রাসায়নিক মিশ্রিত পানি পড়ে কৃষকের ফসলের জমির গুণাগুণ নষ্ট না হয়, তাই পানি পরিশোধন যন্ত্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন; যা মানুষ ও পরিবেশ দুই দলের জন্যই ভীষণ জরুরি। সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সুযোগ পাওয়া যায়নি। জানার ইচ্ছা ছিল কৃষকেরা তাঁদের জমি ও পরিবেশ বাঁচাতে আয়শা-আবেদ ফাউন্ডেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন কি না?

যদি ধরে নিই কৃষকের বলার পরেই ব্র্যাকের আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশন পানি শোধন যন্ত্র নির্মাণ করেছিল, তবে বুঝতে হবে এ উন্নয়ন সংস্থা মানুষ ও পরিবেশ—দুটির উন্নতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই কাজটি করে পরিশোধিত পানি পুনর্ব্যবহার করছে।

যেসব শিল্পকারখানা বর্জ্যমিশ্রিত পানি নদীতে বা জমিতে বইয়ে দেয়, তাদের সবার উচিত ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করে পরিবেশ বাঁচানোতে ভূমিকা রাখা। সরকার এসব সংস্থাকে রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট স্থাপনে সাহায্য–সহযোগিতা করুক। এ বিষয়ে প্রয়োজনে আইন করা হোক।

পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুত না হলে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন বাতিল করা হোক বা অনুমোদন না দেওয়া হোক। যারা শিল্প স্থাপনের শুরুতেই পরিবেশ রক্ষায় ওয়াটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করার মতো জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, তাদের আয়কর রেয়াত (Tax Exemtion) দিয়ে উৎসাহিত করা হোক।

বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে বাপা (বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন) ও বেন (বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক)। এ বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণে রাখবে ও জনগণের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। এতে নদী বাঁচবে, মানুষও উপকৃত হবে।