ভালোবাসার এপিঠ ওপিঠ

সপরিবার লেখক
সপরিবার লেখক

জন্মের পর ঠিক কখন থেকে মানব মনের উন্মেষ ঘটে, সেটা আমার জানা নেই। তবে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ভালোবাসার অনুভূতি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ বিভিন্ন রকমের ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে যায়। সেটা কখনো বস্তুতান্ত্রিক ভালোবাসা আবার সেটা কখনো শুধু একটা নিখাদ অনুভূতি।

বস্তুতান্ত্রিক ভালোবাসা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত রূপ বদলালেও অনুভূতিকেন্দ্রিক ভালোবাসা সহজে রূপ বদলায় না। কারও জন্য একটা অনুভূতি একবার তৈরি হলে সেটা সে সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়ায় নিজের অজান্তেই। তবে বাস্তবতার কশাঘাতে হয়তো-বা চোখের আড়ালে চলে যায়। কিন্তু অবচেতন মনে ঠিকই সেই অনুভূতি থেকে যায়। পরবর্তী সময়ে আবার যখন সেই মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়, তখন ফ্ল্যাশব্যাকে আবার সবকিছু মনে পড়ে যায়।

আমার একেবারে ছোটবেলার খেলার সাথি ছিল আমাদের বাড়ির সাহায্যকারী ছেলে আজাদ, ফুফাতো ভাই আনোয়ার আর পাশের বাড়ির চম্পা। আমাদের সবারই বয়স ছিল কাছাকাছি।

আমরা যেকোনো কিছু করতাম দল বেঁধে। হোক সেটা কারও গাছ থেকে পেয়ারা চুরি বা আতাগাছের পাতার ফাঁকে বাসা বাঁধা ঘুঘুর ছানা চুরি করা। তবে সমস্যা ছিল চম্পাকে নিয়ে। সে বাসায় ফিরে বড়দের সব বলে দিত। সে জন্য আমার হাতের কিল-ঘুষিও তাকে হজম করতে হয়েছে কয়েকবার।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে একই সঙ্গে চুরিতে সহযোগিতা করত আবার পরবর্তী সময়ে গুপ্তচরবৃত্তিও করত। চম্পা আমার হাতে যেমন কিল-ঘুষি খেত, আবার তেমনি খাতিরও পেত। কারণ ওর ঠোঁটপাতলা স্বভাবের জন্য পরেরবার বাকিরা ওকে দলে নিতে চাইত না। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমি ওকে আবার দলে নিয়ে নিতাম। এই অনুভূতির নাম কি ভালোবাসা ছিল?

এরপর আমাদের ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো গ্রামের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চর ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে একদিন যাই তো দুদিন যাই না। স্কুলে যাওয়ার নাম করে আমরা বাসা থেকে ঠিকই বের হতাম। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই রাস্তার পাশের জমিতে রাখালদের সঙ্গে সারা দিন কাটাতাম। তারপর সবাই যখন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরত, তখন আবার তাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। এভাবেই একসময় তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলাম।

আমাদের ক্লাসে শেখপাড়া থেকে একটা মেয়ে আসত নাম রুশি। আমার মনে পড়ে না আমি কখনো তার দিকে সাহস করে তাকিয়েছি। কিন্তু এটুকু বুঝতাম, ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে কে কীভাবে রুশির মন জয় করবে।

আমার একটা সুযোগ এসে গেল। আমি অনেক সুন্দর করে ‘ঘ’ অক্ষরটি লিখতে পারতাম। রুশির যখনই তার খাতায় সেই ‘ঘ’ লেখার দরকার পড়ত আমার কাছে এসে বলত, ‘ইয়াকুব “ঘ”-টা লিখে দে তো।’ এমনও হয়েছে, পরীক্ষার সময়ও সে আমার কাছে এসে বলেছে, ‘ইয়াকুব “ঘ” অক্ষরটা লিখে দে তো।’

মজার ব্যাপার হলো, গ্রামের মানুষ কেউই আমার নামটা ভালোভাবে উচ্চারণ করতে পারত না, শুধু আমার দাদি ছাড়া। আর রুশি ছিল দ্বিতীয় যে আমার নামটা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করত। এটাও কি তাহলে ভালোবাসা?

পরবর্তী সময়ে আমরা গ্রাম থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলির বাড়াদীতে আসি। ওখানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের দুই ভাইয়ের দুরন্তপনায় সারা পাড়া তটস্থ হয়ে থাকত। স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া বাকি সময়টা কাটত বিভিন্ন রকমের বাঁদরামি করে। তবে আমাদের একটা নীতি ছিল, আমাদের সামনে কেউ কোনো অন্যায় করলে তাকে আমরা ছাড়তাম না। সে বয়সে যত বড় বা ছোটই হোক।

বাড়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এক হিন্দু ম্যাডাম। কিছুদিন পর ওই ম্যাডামের এক ভাগনি এসে তাঁর সঙ্গে থাকা শুরু করল। তখন হঠাৎ করে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এক ধরনের হুড়োহুড়ি লেগে গেল। আমাদের বেশির ভাগ মনে মনে বিভিন্ন উপায়ে সেই মেয়ের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করত।

একদিনের কথা আমার এখনো চোখে ভাসে। আমি বাসার পাশের রাস্তায় তেমাথায় একটি দোকানের বাঁশের মাচায় বসে জিরোচ্ছিলাম। সেখানে হঠাৎ ম্যাডামের সেই ভাগনি হাজির। সে আমাকে পাশের পুকুরে ফুটে থাকা শাপলা তুলে দিতে বলল। আমি কোনো বাক্য ব্যয় না করে পুকুরে নেমে ফুটে থাকা শাপলা তুলে আনলাম তার জন্য।

এর পর থেকে বন্ধুমহলে সবাই আমাকে ঈর্ষার চোখে দেখত। এটাকে কি ভালোবাসা বলা যাবে?

কলেজে ওঠার পর মনে সত্যিকার অর্থে একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। সালমান শাহের সিনেমা দেখে বেড়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের কাছে কলেজজীবনটা ছিল স্বপ্নের। আমরা ভাবতাম কোনো পড়াশোনা নেই। শুধু একটা ডায়েরি হাতে নিয়ে ঘুরতে হয় আর সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ধাক্কা খেতে হয়।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পড়াশোনার চাপে আমাদের জেরবার অবস্থা। যদিও কলেজে কোনো ক্লাসই হয় না। কোনো না কোনো একটা গন্ডগোল লেগেই থাকে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা একেবারে ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি বিভিন্ন স্যারের বাসায় দৌড়াই। কোনোই অবসর নেই।

এর মধ্যেই একদিন এক মেয়েকে দেখলাম। তখন পর্যন্ত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা আমার জন্য শুধু অসম্ভবই না একেবারে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু কেন জানি তার উপস্থিতি আমাকে কল্পনার রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

এরপর কলেজ শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি ও বুয়েটে ভর্তি হওয়া। জীবনে প্রথম ঢাকায় এসে একেবারে পুরোপুরি আত্মীয়স্বজনহীন পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিজেকে শামিল করে সব ভুলে গেলাম। কৈশোরের এই অনুভূতিই কি তাহলে আসল ভালোবাসা ছিল?

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর নয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা মেয়েদের এমনভাবে বড় করি যে তারা সব সময়ই কোনো না কোনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের সবকিছুতেই বেস্ট হতে হবে এমনকি জীবনসঙ্গী পছন্দের ক্ষেত্রেও তাদের এমন একটা ছেলেকে বেছে নিতে হবে যে তাকে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা দেবে। তাই ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা ছেলেগুলো ছিল তাদের মূল টার্গেট। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও ছিল। তবে তা একেবারেই হাতেগোনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে এবং পড়া শেষ করে যত দিন ব্যাচেলর ছিলাম, আমার জীবনে প্রেম-ভালোবাসা গায়ে এসে পড়লেও জোর করে নামিয়ে দিতাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর গিন্নির সঙ্গে সব ভালোবাসাবাসি করব। কিন্তু বাস্তবতা সেখানেও বাগড়া দিয়ে বসল।

আসলে সংসার জীবন একটা বিশাল ব্যাপার। সবকিছু একসঙ্গে চালিয়ে ভারসাম্যের জীবনযাপন সত্যি বলতে একেবারেই অসম্ভব। কোনো না কোনো দিকে কমতি থেকে যাবেই। অর্থনৈতিক কারণে সেটা আমাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে গেল। উপরন্তু আমরা দুজনেই ছিলাম বহির্মুখী স্বভাবের। তার পরও কোনো কিছু করার আগে আমরা ভাবি অন্যের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে তো। নিজেদের স্বার্থ কখনোই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। তাই আমাদের মধ্যে স্বার্থপর ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়নি।

তবে আমাদের মধ্যে যেটা আছে সেটা হলো একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ। আর সেটাই আমাদের জীবনের চালিকা শক্তি। আমাদের দুজনের পেশাও আমাদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। তাই আমরা শিখে গেছি আমাদের অনেকখানি ছাড় দিয়ে চলতে হবে। হয়তো-বা প্রকারান্তরে এটার নামই ভালোবাসা।

এবার একটু অন্য রকম ভালোবাসার কথা বলি। আমি জীবনেও আমার মাকে বলিনি তাকে আমি ভালোবাসি। কারণ গ্রামদেশে এসব চল একেবারেই নেই আর বলার দরকারও হয় না। মায়ের জন্য ছেলের কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে ছেলে মাকে কতটা ভালোবাসে। আমি এক জীবনে মায়ের হাতে যত মার খেয়েছি সেটা নিয়ে লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। আবার মা-ই সবার আগে সব বিপদে এগিয়ে এসেছেন।

প্রবাস জীবনে এসে আমাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সত্যি কথা বলতে এখনো অনেক কঠিন। কারণ আমার ও গিন্নির পরিবার থেকে আমরাই প্রথম যারা একেবারে দেশান্তরী হয়েছি। প্রবাস জীবন আমাদের জন্য সহজ ছিল। বহু মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ফলে আমরা আমাদের প্রবাস জীবন গুছিয়ে নিয়েছি বলা যায়।

প্রবাস জীবনেও প্রতিনিয়ত অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন চালাতে হয়। মাঝেমধ্যে খুবই কঠিন সময় এসে হাজির হয়, আর তখনই আরও বেশি করে আমার মায়ের কথা মনে হয় কারণ পৃথিবীতে এই একটা মানুষ আমাকে সব সময় ভরসা দিয়ে গেছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। তা না হলে যেকোনো হিসেবেই আমি এত দূর আসতে পারতাম না।

যখন বিদেশে আসি তার আগের দিন আমার শিয়রে বসে মাথায় হাত রেখে মা বলেছিলেন, ‘তুমি যখন ঢাকায় আসো তখন তোমার কেউ ছিল না। আজ দেখ ঢাকাতে তোমার কত মানুষ। অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক মানুষ পেয়ে যাবে।’ এর চেয়ে সাহসের কথা একজন মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে।

মায়ের সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা হয় না প্রায় পাঁচ বছর। কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিন মা আমার মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। অবশ্য এখন আমার আরও একজন মা তৈরি হয়ে গেছে। যে আমার সব পাগলামিতে সায় দিয়ে যায়। সে হচ্ছে আমার মেয়ে।

আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার। আপনি মেয়েকে যত দিন মেয়ে হিসেবে বড় করবেন, তত দিন তারা কখনোই স্বাবলম্বী হবে না। তাদের বড় করতে হবে মানুষ হিসেবে। তাহলে তারা জীবনের যেকোনো প্রতিকূলতা একাই মোকাবিলা করতে পারবে। অন্যের সহযোগিতা ছাড়াই।

আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একে অন্যকে খাঁচায় বন্দী করতে চাই। আমরা ভুলে যাই ভালোবাসা একটা মুক্ত অনুভূতি। যখনই সেটাকে খাঁচায় বন্দী করা হবে, তখন আর সেটা ভালোবাসা থাকবে না। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সবার জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। ভালোবাসা হোক বহুমুখী। নিজের ও নিজের সংসার ছাড়াও আমাদের ভালোবাসা বিকাশ লাভ করুক আমাদের মা-বাবার প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি, বিশ্বের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি। তাহলেই এই পৃথিবী হয়ে উঠবে আনন্দময়।