হারানো বসন্ত

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কলেজের পুনর্মিলনী উৎসব। চারদিকে হারানো স্মৃতির ঘ্রাণ। পুরোনো ধুলোমাখা অ্যালবামটা যেন সবেমাত্র গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। আবারও হারিয়ে যাওয়া সব বন্ধু এককাতারে শামিল হয়েছে। শত শত জমানো কথা মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে কলেজ প্রাঙ্গণে। বাঁধভাঙা আনন্দে আত্মহারা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যেন অনেক বছর পর আবার সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেছে।

সোনালি সেই ফেলে আসা দিনগুলো যেন নিবিড় পরশে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সবার স্মৃতির মণিকোঠায়। বান্ধবীদের সঙ্গে কথোপকথনের একফাঁকে প্রিয়ন্তীর চোখ আটকে গেল কিছু দূরে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটির দিকে।

তানভীর না?

প্রিয়ন্তীর কণ্ঠটা যেন মুহূর্তেই পৌঁছে গেল তানভীরের কর্ণকুহরে। বন্ধুদের ভিড় ঠেলে সরাসরি এসে দাঁড়াল প্রিয়ন্তীর সামনে।

‘কেমন আছ প্রিয়ন্তী? অনেক বছর পর দেখা হলো তাই না? শুনলাম তুমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকো?’

প্রিয়ন্তী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তানভীরের দিকে। কলেজে একই ক্লাসে পড়লেও কখনো তানভীরের সঙ্গে কথা হয়নি প্রিয়ন্তীর।

তানভীর ছিল ক্লাসের সবচেয়ে বোকাসোকা একটি ছেলে। মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। ক্লাসের কমবেশি সবাই তানভীরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত।

বেঞ্চের এক কোনায় বসে তানভীর অপলক চেয়ে থাকত প্রিয়ন্তীর দিকে। প্রিয়ন্তী মাঝেমধ্যে ভীষণ বিরক্ত হতো। তানভীর ছায়ার মতো প্রিয়ন্তীকে অনুসরণ করত। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারত না। বুক পকেটে একটা প্রেমপত্র নিয়ে কতই না চেষ্টা করেছে প্রিয়ন্তীকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কলেজজুড়ে প্রিয়ন্তীর পাণিপ্রার্থীর ভিড়ে সেই প্রেমপত্র অকালেই ঝরে গেছে। না বলা কথা অব্যক্তই রয়ে গেছে।

পরীক্ষার পর শুধু রেজাল্টের দিন শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল প্রিয়ন্তীর সঙ্গে। বোর্ডে প্রিয়ন্তী নিজের রোল নম্বর খুঁজে পাচ্ছিল না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন আঙুলের ইশারায় প্রিয়ন্তীর রোল নম্বরটা দেখিয়ে দিয়েছিল। সেদিনও তানভীর কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সহজ-সরল ছেলেটা ভিড় ঠেলে প্রিয়ন্তীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

‘কী হলো, চুপ করে আছ কেন?’

তানভীরের ডাকে প্রিয়ন্তী অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে এল। একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন দেখে প্রিয়ন্তী কিছু সময়ের জন্য বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

‘আমি ভালো আছি, তানভীর। তুমি কেমন আছ? তুমি ঠিক শুনেছ, আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। বিয়ের পর হাজবেন্ডের সঙ্গে ওখানেই সেটেল হয়েছি। তবে প্রতিবছর দেশে আসি মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে।’

তানভীর মৃদু হেসে উত্তর দিল, ‘আমি আছি কানাডায়। স্কলারশিপ নিয়ে গেলাম। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরি, সংসার—সব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে বারো বছরে আর দেশে ফেরা হয়নি। গত মাসেই দেশে এসেছি আর শুনলাম কলেজের পুনর্মিলনীর কথা। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না।’

প্রিয়ন্তী উৎসুক হয়ে তানভীরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্ত্রী আসেনি?’

‘আমি একাই এসেছি। ক্রিস্টিনা আসেনি। কাজপাগল মেয়ে। অফিস কামাই দিতে রাজি নয়।’

‘তুমি ভিনদেশি মেয়ে বিয়ে করেছ? নিশ্চয়ই প্রেমের বিয়ে তাই না?’

‘তেমন কিছুই না। আসলে দেশে কাউকে ভীষণভাবে চেয়েও পাইনি তাই...!’

তানভীরের কথা শেষ না হতেই দূর থেকে রাতুল এসে জড়িয়ে ধরল তানভীরকে। আশপাশের আরও বন্ধুরা ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে তানভীরকে। প্রিয়ন্তী ধীরে ধীরে বান্ধবীদের সঙ্গে এসে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, যে তানভীরকে নিয়ে সবাই মজা করত, সে এখন সবার মধ্যমণি। তানভীর নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছে। এ কালের তানভীরের ব্যক্তিত্ব আর অভিব্যক্তিতে যে কেউ মুগ্ধ হবে।

প্রিয়ন্তীর কেন যেন সেই পুরোনো তানভীরকে প্রচণ্ডভাবে মনে পড়তে শুরু করল। তানভীরের সেই সহজ, সরল, ভীরু চোখের আঙিনায় কেবলই প্রিয়ন্তীকে পাওয়ার আকুতি ছিল। নীরবে শুধু একতরফা প্রিয়ন্তীকে ভালোবেসেছিল। প্রিয়ন্তী বুঝেও না বোঝার ভান করত। ভিতু ছেলে, যে কিনা ভালোবাসার কথা বলতে পারে না, তাকে নিয়ে প্রিয়ন্তীর মাথাব্যথা ছিল না কোনো কালেই। কিন্তু সময় ও বাস্তবতা প্রিয়ন্তীকে অনেক কিছুই শিখিয়ে দিয়ে গেছে। ফেলে আসা বসন্তে ঝরে পড়া ফুলগুলো আর কখনো ফুটবে না। সত্যিকারের ভালোবাসা একবার হারালে আর কখনো ফিরে আসে না।

প্রিয়ন্তীর মন বিষণ্নতার কালো মেঘে ছেয়ে গেল। কেন যেন ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে এখনো কি তানভীরের মনে প্রিয়ন্তীর জন্য আকুলতা আছে? নাকি ভিনদেশি আবহে ভুলে গেছে পুরোনো সব স্মৃতিকথা। বান্ধবীদের সঙ্গে কথার ফাঁকে দুবার তাকাল বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা তানভীরের দিকে। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে সবার সঙ্গে।

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস প্রিয়ন্তীকে পাশ কেটে চলে গেল। এত বছর পর কেনই–বা তানভীর প্রিয়ন্তীর কথা ভাববে? দুজনের জগৎ এখন দুই দিকে। দুজনই পরিণত ও সংসারী। প্রিয়ন্তী মনে মনে লজ্জা পেল এমন অযাচিত চিন্তা মাথায় এসেছে বলে। অনুষ্ঠানে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে হলো না। বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার মুহূর্তে মনের অজান্তে আবারও তাকাল তানভীরের দিকে। ছলছল চোখে তানভীর অপলক চেয়ে আছে প্রিয়ন্তীর দিকে। সেই সহজ–সরল চোখের আকুতি। বাঁধভাঙা দীর্ঘশ্বাস!

প্রিয়ন্তী পাথুরে মূর্তির মতো নির্বাক তাকিয়ে রইল তানভীরের দিকে। তানভীরের চোখের ভাষা বুঝতে প্রিয়ন্তীর একটুও দেরি হয়নি। আজও হয়তো তানভীর প্রিয়ন্তীকে ভুলতে পারেনি। বহু বছর পর প্রিয়ন্তীকে দেখে আবারও হৃদকোঠরে লুকিয়ে রাখা আবেগটুকু চোখের জলের পদ্মপুকুরে ভেসে উঠেছে। প্রিয়ন্তীর ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল তানভীরের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু সময় পড়িয়েছে অদৃশ্য শিকল। সেই শিকল ভেঙে যাওয়ার ক্ষমতা কারওও নেই...।