ভালোবাসা বারণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমাকে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি যে আমি ভালোবাসতে পারব না। আমি অসচ্ছল পরিবারের নই যে ছাত্রাবস্থায় আমার মাথায় বিরাট চিন্তা ছিল, আমাকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে।

দেখতে শুনতে আমি আহামরি ভালো বা মন্দ নই। শুধু নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কে আমার প্রবল অনীহা ছিল।

আমার সব সময় মনে হতো সব ভড়ং। বন্ধুদের ডেটিং আর ভালোবাসার গল্পে আমার ঘুম পেত। এদের ভীষণ বোকা মনে হতো। হরমোনাল কারণে নারীর শরীরের আকর্ষণীয় কোনো অংশে যে আমি চোখ বোলাইনি, তা আমি বলতে পারব না।

কিন্তু সে তো ভালোবাসা নয়। সে একধরনের ক্ষুধা। যা পশুমাত্রই আছে। মানুষও একজাতীয় পশু।

মানুষের সব চিন্তাভাবনার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। ভালোবাসার প্রতি আমার এই অবিশ্বাসের পেছনেও কারণ ছিল।

মধ্যরাতে পাশের ঘরের চিৎকার–চেঁচামেচি শুনতে না চাইলেও কানে চলে আসত। এই দুজন মানুষ আমাকে ভালোবেসে এক চক্রে আটকে গেছে। ঝগড়া করবে, তারপর আবার একটু স্বাভাবিক। আবার ঝগড়া হবে, আবার ঠিক হবে।

তাদের যুদ্ধ আর শান্তি চুক্তি আমাকে যা শেখাল, তা হলো সংসার এক জটিল জায়গা। যেখানে বিয়ের নামে সন্তানের জন্য দুজন মানুষ আটকে থাকে।

এদের হতাশা আমি দেখতে পেতাম। বাবার রঙিন গ্লাসে কিংবা মায়ের চোখের পানিতে।

কিন্তু আমিও স্বার্থপর ছিলাম। আমি চাইতাম, এরা এই যুদ্ধক্ষেত্রে একসঙ্গেই থাকুক। অন্তত সামাজিকভাবে সেটাই আমার জন্য সুবিধাজনক।

কী নিয়ে দুজনের ঝগড়া হতো, তা নিয়ে আমি ভাবতাম না। কখনো বাবার মদ্যপান কিংবা মায়ের অতিরিক্ত স্থূল হয়ে যাওয়া নিয়ে বাবার কটাক্ষ—অনেক কিছুতেই দুজন দুজনকে বাক্যবাণে টুকরো টুকরো করত। আমি ভেবে পাই না, কীভাবে এই দুজন মানুষ পালিয়ে বিয়ে করেছিল।

মা প্রায়ই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতেন, ‘ভাবতে আমার গা জ্বলে যায় যে এই লোকের জন্য আমি সব ছেড়েছি। আমার বাবা যখন মারা যায়, তখন পর্যন্ত আমি যেতে পারি নাই।’

আমি বুঝতে পারি, ভালোবাসার জন্য তাঁরা অনেক কিছু করেছিলেন। কিন্তু তারপরও ওই প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়েছে। আর তাঁদের ব্যর্থ প্রজেক্টের ফসল আমি রঞ্জু। আমি শিখেছি প্র্যাকটিক্যাল হতে। প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাস না করতে।

দুই.

ছোটবেলা থেকে আমার অনেক বন্ধু ছিল। হয়তো বাড়িতে নানা অশান্তির কারণে আমি বন্ধুদের আড্ডায় ভালোই সময় দিতাম। স্কুলের অনেক বন্ধু কলেজে রইল না আর কলেজের অনেক বন্ধু ইউনিভার্সিটিতে ছিল না।

তবে আমি, শিহাব আর টুটুল—আমরা তিনজন সেই ছোটবেলা থেকেই একই পাড়ায় থাকতাম। একই স্কুলে পড়তাম। আবার একসঙ্গেই একই ইউনিভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে ভর্তি হলাম।

অবস্থাপন্ন পরিবারের হওয়ায় আমার বাবার একটা গাড়িও ছিল। কিন্তু বাবার গাড়িকে রিজেক্ট করে আমিও ওদের সঙ্গে বাসে ঝুলতে ঝুলতে যেতাম। বন্ধুরাই ছিল আমার মানসিক আশ্রয়।

আমাদের তিনজনের মধ্যে টুটুল সব থেকে মেধাবী ছিল। বলতে গেলে লেখাপড়ায় সেই আমাকে গাইড করত। কুইজের আগের দিন সে আমাকে বলত, রঞ্জু মামা, চ্যাপটার তিনের চার নম্বর অঙ্কটা করিস।

আমার ক্লাসের অ্যাটেনডেন্সও টুটুল দিয়ে দিত। কিন্তু শিহাবের সঙ্গে প্রায়ই টুটুলের ঝগড়া লেগে যেত। টুটুল লেখাপড়ায় সাহায্য করবে। কিন্তু টাকাপয়সায় কঠিন হিসাবি। খাতায় এত ছোট ছোট করে লিখত যেন সেমিস্টার এক নোটবুকে লিখে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

তাতে আমাদের সুবিধে হতো। ফটোকপি করতে বেশি খরচ হতো না।

টুটুল সারাক্ষণ টিউশনির টাকাপয়সা জমিয়ে কীভাবে দেশের বাইরে যাবে, সেই হিসাব করত। রেস্টুরেন্টে খেয়ে বিল দিতে চাইত না। তখন শিহাব রেগে বিল মিটিয়ে আমাকে বলত, তোর জন্য এই কৃপণটাকে আমি সহ্য করছি।

আমি তখন টুটুলের পক্ষের উকিলের মতো সাফাই গাইতাম, আহা, কী বলিস! কত সাহায্য করে আমাদের।

: হ্যাঁ, করে। ভালো ছাত্ররা ততক্ষণ ভালো, যতক্ষণ তোর সঙ্গে ওর কমপিটিশন নেই। তোকে আর আমাকে সাহায্য করে। কারণ, আমরা ওকে টপকাব না। ওর লেজে পা দিলে দেখবি আসল চেহারা।

শিহাব ছিল সব থেকে সুদর্শন। শিহাব অনেক লম্বা আর ফরসা ছিল। রমণীমোহন হিসেবে স্কুল থেকেই তার গার্লফ্রেন্ড ছিল। কলেজে গার্লফ্রেন্ড পাল্টে গেল। আর ইউনিভার্সিটিতে এসে নতুন বান্ধবী হলো তুলি। এমনিতে শিহাব বন্ধু হিসেবে দিলদরিয়া। তবে রেগে গেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। স্কুলে সে যাকে–তাকে পিটিয়েছে।

তুলিকে যেদিন প্রথম শিহাব নিয়ে এল, টুটুল তার আঁতেল আঁতেল চশমার কাচটা মুছতে মুছতে আমাকে ফিসফিস করে কানে কানে বলল, আহা রে, মেয়েটা বুঝতে পারছে না, কোনো ধুরন্ধরের পাল্লায় পড়েছে।

আমি কোনোরকমে হাসি চেপে টুটুলের সব দুষ্টু কথা শুনছিলাম।

তুলির মুখটা ছিল পান পাতার মতো। থুতনি লম্বাটে। মুখ টিপে হাসত। শিহাবের দিকে সে খুব মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে সে চুলটা উঁচু করে বাঁধত। তার লম্বা গলায় একটা পাতলা চেইন থাকত।

মাঝে মাঝেই আমরা চারজন আড্ডা দিতাম। তবে একসময় কপোত–কপোতীকে ছেড়ে দিয়ে আমি আর টুটুল ফিরে আসতাম। ফিরে আসার পথে টুটুল প্রায়ই গজ গজ করত।

: আচ্ছা, তোর খারাপ লাগে না, তুলির মতো এমন ডিসেন্ট একটা মেয়ে এ রকম একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে?

আমি হেসে উত্তর দিতাম, তোর এত জ্বলে কেন?

বন্ধুত্ব অনেক সময় দাম্পত্যের মতো চক্রে পড়ে যায়। আমরা তিনজন তিনজনের সব দোষত্রুটি বুঝতে পারতাম। তারপরও আঠার মতোই লেগে থাকতাম।

একসময় তুলি আমাদের এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল যে আমরা তিনজন তিন দিকে ছিটকে গেলাম।

তিন.

মানুষের জীবনে নাটকীয় ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। কিন্তু দু-একটা অতিনাটকীয় ঘটনা ঘটবে। এ রকম এক নাটকীয় ঘটনাই ঘটে গেল।

সেদিন রাত এগারোটায় টুটুল সেলফোনে ফোন দিয়ে বলল, দরজা খোল, আমি তোর বাসার সামনে। আমি খুব সন্তর্পণে চাবি দিয়ে দরজা খুলে টুটুলকে ভেতরে ঢোকালাম। এত রাতে আমি তাকে আশা করিনি আর তার চোখেমুখে একটা ক্ষোভ।

টুটুল রাগী কণ্ঠে আমাকে বলল, দোস্ত, আমি তো অনেক দিন থেকে বলছি, একটা লম্পটের সঙ্গে তুলির মতো একটা ভালো মেয়ে আটকে যাচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে না। সে কালকেও গিয়েছিল।

: কোথায়?

: জানিস না কোথায়? আমার কাছে আবার রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে। বলে, তুই তো ব্যাটা নারী দেহের স্বাদ পেলি না। তুই বেশি করে ডিম, তরমুজ খাবি। শরীরে একটু শক্তি হোক, তারপর তোকে নিয়ে যাব। আমার মনে হচ্ছিল থাপ্পড় মারি।

এরপর যে ভয়াবহ কথাটা টুটুল বলল তা হলো, আমি ঠিক করেছি তুলিকে বলে দেব।

: কী বলবি?

: বলব যে শালা একটা লম্পট।

: শোন, এসব ঝামেলা করার দরকার নাই। ওদেরটা ওরা ভালো বুঝবে।

: তুই আমার সঙ্গে আছিস কি নাই? আমি তোকে ভালো মানুষ ভাবতাম। এই ছেলের সঙ্গে থেকে থেকে তুই ন্যায়নীতি ভুলে ইবলিস হয়ে যাচ্ছিস।

আমি একটু ভেবে বললাম, শোন টুটুল, নারী-পুরুষের সম্পর্ক খুব জটিল জিনিস। তুই বলে বিপদে পড়বি। মনে কর, সবকিছু শুনেও তুলি মেনে নিল। আমি যতটুকু বুঝি, ওদের সম্পর্ক বেশ গভীর। মাঝখান থেকে তুই ব্যাটা খারাপ হয়ে যাবি। তুই এসব প্রমাণ করবি কীভাবে? তুলি তোর কথা বিশ্বাস করবে?

: এই জন্য তো তোর বাসায় এসেছি। মেসেজ তুই পাঠাবি। আমার সঙ্গে যে শিহাবের একটু–আধটু লাগে, তা তুলি জানে। তুই বললে বিশ্বাস করবে।

: শোন, আমি এসবের মধ্যে নেই। তুই এখন যা।

এরপর আমি সম্ভবত রেস্টরুমে গিয়েছিলাম। আমার ফোনে কোনো লক ছিল না। আর আমার ফোন থেকেই তুলিকে মেসেজ পাঠিয়েছিল টুটুল।

পরদিন সকালে শিহাব এসে আমাকে আমাদের সিঁড়িঘরে কয়েক দফা ঘুষি মেরে ফেলে রেখে গেল।

সে যখন মারছিল তখন এই কথাগুলো কানে আসছিল, শালা, তুই মেনী মুখ করে থাকিস আর ভেতরে ভেতরে বদের হাড্ডি।

অজ্ঞান আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। আমি পুলিশকে কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ করিনি। আমি মার খেয়ে বেঁচে গেছি। টুটুল হয়তো মরেই যেত। বেচারা সব সময় একটু দুর্বল ছিল। আমি পুলিশকে বললাম, আমি অন্ধকারে দেখতে পাইনি কিছু।

টুটুল আমাকে একদিন দেখতে এসেছিল। বলল, দোস্ত, আমি দুঃখিত। মেয়েটাকে বাঁচানো দরকার ছিল। শিহাবের সঙ্গে ও ভালো থাকত না।

আমি নীরব ছিলাম।

এ ঘটনার পর আমি খুব একা হয়ে গেলাম। পরিবারের সঙ্গে আমার আলগা একটা সম্পর্ক ছিল আর বন্ধুদের সঙ্গে ছিল সখ্য। কাছের বন্ধুরা ছিটকে পড়ে গেল। বাসায় এসেও আমি অনেক দিন বাড়ি থেকে বের হইনি। সন্ধ্যাবেলায় তুলি ফোন করত। অনেক কথা বলত। ফোন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত।

আমি জীবনে প্রথম বুঝতে পারছিলাম, পৃথিবীতে ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে। একজন প্রতারকের জন্য মেয়েটা কাঁদে। আমি খুব দিশেহারা বোধ করতাম। কিন্তু আমি এটাও বলিনি, মেসেজগুলো আমার ছিল না। শুধু জটিলতা বাড়িয়ে লাভ কী? তবে মেয়েটার জন্য একটু খারাপ লাগত।

আমি শুধু বলতাম, ভুলে যাওয়া যায় না?

: কীভাবে? আমার সারা শরীরে তার স্পর্শ। আপনি জানেন, আমি এ পর্যন্ত গত তিন বছরে দেড় শ চিঠি লিখেছি। কীভাবে মানুষ এত সস্তা হয়। ইউনিভার্সিটিতে আসে, কথা বলতে চায়। মাফ চায়। অসহ্য!

আবেগ আমার খুব একটা আসে না। আমি অসহায় বোধ করি। মেয়েটাকে ঠিক কী সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারি না।

ধীরে ধীরে প্রতি সন্ধ্যায় আমি অস্থির বোধ করি। একদিন একটা কবিতা লিখি। নিজের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাই। কী হচ্ছে এসব?

সেদিন টুটুল আসে। বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। আমি গান শুনছি—

তোমরা যে বলো দিবস–রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।


টুটুল টেবিলের ওপর আমার লেখা কবিতাটা পড়ে আর গানের কথা শুনে জোরে জোরে হাসে।

: কিরে বন্ধু, প্রেমে পড়েছিস নাকি?

আমি টুটুলের সঙ্গে তেমন কথা বলি না। টুটুল বুঝতে পারে আমার অভিমান শক্ত।

সেদিন মনে হয় তুলি আমাকে শেষবার ফোন করেছিল।

: রঞ্জু ভাই, আমি কক্সবাজারে যাচ্ছি। মন খারাপ করে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আপনি কাউকে বলবেন না। আমি সানসেট রিসোর্টে থাকব। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফিরে আসব।

তুলি চলে যাবার পর সন্ধ্যার দিকে আমার একটু খারাপ লাগত। আমি গান শুনি, সিগারেট খাই। তুলি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড নয়। তবুও ওর প্রোফাইলে ঢুঁ মারি। আমার পাশের ঘরে এখনো চাপা কান্না শোনা যায়। আমি স্বার্থপরের মতো দরজা বন্ধ করে নিজের ভুবনে ডুব দিই। সেই ভুবনে খুব সকালে একটা মেয়ে আমাকে এক কাপ চা এনে দেয়। মেয়েটার চুল উঁচু করে বাঁধা থাকে। লম্বা গলায় একটা পাতলা চেইন। এই মেয়েটা এখন মন খারাপ করে সমুদ্রসৈকতে একা হাঁটছে। আমার খুব ইচ্ছা হয়, আমিও পাশে গিয়ে হাঁটি। আঙুলে আঙুলে স্পর্শ করে হাঁটি। হাত না হয় না–ই ধরলাম। আমি ব্যাগ গোছাই। সন্ধ্যাবেলা অপেক্ষা করি। আর কোনো ফোন আসে না। বন্ধুর প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিজের ভাবতে কোথায় যেন বাধে। আমার আর যাওয়া হয় না।

চার.

দুই বছর চাকরি করে আমি ভাবছিলাম দেশ ছাড়ব। সে সময় একটা ছোট মেসেজ পেলাম টুটুলের।

: বিয়েতে তোকে বলা হয়নি। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে তোকে মনে পড়ছে। চলে আয়।

সঙ্গে একটা ছবি। টুটুল, তুলি আর ছোট একটা বাচ্চা।

আমি কিছু সময়ের জন্য হিসাব মিলাতে পারছিলাম না। ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ছিল।

অনেক দিন আগে শিহাবের বলা একটা কথা মনে হয়, ‘ভালো ছাত্ররা ততক্ষণ ভালো যতক্ষণ তুই তাদের কম্পিটিটর না।’

তবে কি আমার ফোন থেকে মেসেজ করে আমাকে মার খাইয়ে আসলে টুটুল সব করল তুলিকে পেতে। আমার সবকিছু জানতে ইচ্ছা হয় না। ওরা ভালো থাকলেই ভালো।

যাব না যাব না করেও গেলাম। টুটল যত্ন করে খাওয়াল। তুলিকে দেখলাম কালো একটা শাড়ি পরা। এর আগে কখনো তাকে জমকালো শাড়িতে দেখিনি। চুলটা আজও উঁচু করে বাঁধা। পুরোটা সময় সে দূরে দূরে রইল যেন মুখোমুখি হতে চায় না।

ফিরে আসার আগে আগে হঠাৎ তুলি এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে সেই আগের মতো মুখ টিপে হেসে বলল, আপনার লেখা পড়লাম।

আমি কেঁপে উঠি। আমার খুব স্বল্প সময়ের জন্য তুলির প্রতি দুর্বলতা যেমন গোপন, তেমনি টুকটাক লেখালেখিও নিজের মধ্যেই রাখি। ছদ্মনামে লিখি।

আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে তুলি বলে, ওই কবিতাটা টুটল আপনার টেবিলে দেখেছিল। ও আমাকে বলল। না হলে বুঝতে পারতাম না। আপনার বন্ধু অনেক বুদ্ধিমান।

আমি ধরা পড়ে যাওয়া মানুষের মতো ম্লান করে হাসি।

: হুম্‌, বুদ্ধিমান তো বটেই।

তুলি চুপ করে থেকে বলে, রঞ্জু ভাই আপনি এলেন না কেন?

: কোথায়?

: কক্সবাজার।

: আমার কি আসার কথা ছিল?

: হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন। বন্ধুর প্রেমিকাকে পবিত্র মনে হয়নি? আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি ভেবে রেখেছিলাম, এরপর যেদিন দেখা হবে আপনাকে বলব, আমাকে কষ্ট দিয়েছিলেন।

এরপর কিছু বলার থাকে না। হয়তো এক মিনিট ছোট্ট এক নীরবতা ছিল।

আজ অনেক দিন পরেও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। কীভাবে আমাদের তিন বন্ধুর জীবনে তুলি জড়িয়ে গেছে। একজনের প্রেমিকা, একজনের স্ত্রী আর একজনের বিরুদ্ধে সে হয়তো সারা জীবন মনে খেদ পুষে রাখবে। প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আমি? কেন? নীতিবোধ নাকি ভালোবাসায় অবিশ্বাস? আসল ব্যাপারটা আমি নিজেও জানি না। তবে সমুদ্রের পাড়ে গেলে এখনো আমি কিছুটা পথ একা একা হাঁটি। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সঙ্গে কথা বলি। বালির বুকে লিখি—

‘ভালোবাসা খুব অপ্রত্যাশিতভাবে আসে
শব্দ না করে আসে,
দমকা হাওয়ার মতো আসে, ঝড়ের মতো আসে,
মেঘের মতো এলোমেলো পথে আসে।

তখন নিজেকে সম্পদশালী মনে হয়
মাঝে মাঝে মনে হয় ভীষণ নিঃস্ব,
আপনি খিলখিল করে হাসবেন
আপনি অনর্থক ফুঁপিয়ে কাঁদবেন।

গভীর সে বোধ আপনাকে ডুবিয়ে দেবে
কিংবা আকাশে উড়িয়ে দেবে,
কিন্তু শান্তি দেবে না
শুধু এলোমেলো করে একা করে চলে যাবে।’
–––

ইশরাত মাহেরীন জয়া: ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।