বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কতটা উপযোগী

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয় বা অনুষদের উপযোগী শিক্ষার্থী ভর্তি করার ওপর জোর দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে একজন শিক্ষার্থী যে বিষয়ে সবচেয়ে ভালো, তারও সব সময় ইচ্ছা থাকে সে বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। যেমন কেউ প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে চাইলে বায়োলজির ওপর জোর না দিলেও চলে। আবার কেউ প্রাণরসায়ন ফার্মেসি বা অণুজীববিজ্ঞান পড়তে চাইলে তার বায়োলজি জানা জরুরি।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর কাজ করে একটি নির্দিষ্ট মান তৈরির জন্য। এ কারণে দেখা যায়, সবাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সবাই তো পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারে না। যত মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, তত তার কাছে পৌঁছানো কঠিন।

আমাদের দেশেও বুয়েটে পরীক্ষা দিতে হলে আমরা দেখেছি, মিনিমাম যোগ্যতার পরেও আবার বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়। এটাই বুয়েটের মান সম্পর্কে সবাইকে পরিচিত করে দেয়।

শুধু বুয়েট কেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় চায় এই ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট স্টাইল তৈরি করতে, যার মাধ্যমে তার উপযোগী সেরা শিক্ষার্থী পাবে। আমার জানামতে, পৃথিবীর কোথাও এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাপদ্ধতি নেই। তবে আমরা কেন এই রকম একটি সিস্টেম উদ্ভাবন করতে চাইছি?

এ পর্যন্ত একটা যুক্তি সবার কাছে শোনা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়। আবার অনেক সময় একই শিডিউলে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একই সময়ে হয়। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়।

মোটকথা, শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমানোর কথা চিন্তা করে এক দিনে একই প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।

শুধু দূরত্ব বা শিডিউল ওভারল্যাপের কারণে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি শুরু করার মধ্যে আমি কোনো ধরনের যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। যদি এটা অনেক বড় কারণ হতো, তাহলে আমেরিকার মতো বিরাট দেশ এই সমন্বিত পদ্ধতি আরও আগেই গ্রহণ করত।

তা ছাড়া এটা বিশ্ববিদ্যালয় স্পিরিট থেকে যোজন যোজন দূরে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংবিধান আছে, একাডেমিক কাউন্সিল আছে, সিন্ডিকেট আছে। সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনের মাধ্যমে করে। একাডেমিক কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপদ্ধতি, ভর্তিপদ্ধতি নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কাঠামোর কথা বাদই দিলাম। এরপরও আরও অনেক যৌক্তিক কারণ আছে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিপক্ষে।

ক. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কারণে এখানে স্বচ্ছতা অনেক বেশি। সবাই অনেক বেশি কনসার্ন থাকে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট না হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষাসংক্রান্ত বিপর্যয়ের দায়ভার কে নেবে?

খ. যেহেতু প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা প্রশ্নপত্র থাকে, সেহেতু কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন ফাঁস হলেও তা অন্যদের ওপর প্রভাব পড়ে না। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিলে একই প্রশ্ন থাকবে। যা কোনোভাবে ফাঁস হলে পুরো পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আমরা দেখেছি, কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থী–অভিভাবকদের মধ্যে ভোগান্তি সৃষ্টি করে।

গ. সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ দিক হলো একজন শিক্ষার্থী একবারই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থী কোনো কারণে এই পরীক্ষা না দিতে পারলে তার আর কোনো কিছু করার থাকবে না।

আমার মনে হয়, আমরা খুব তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। আরও আলোচনা করে ভালো–খারাপ দিক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারত। অন্য দেশ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে, তা আমরা বিবেচনা করেছি বলে মনে হয় না। আমার মনে হয়, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাপদ্ধতি ভবিষ্যতে গলার কাঁটা হবে। এটা একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টের সঙ্গে যায় না, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্যও এটা ভালো হবে না।

আমাদের সামনে অনেক উদাহরণ আছে, যেখান থেকে আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাচ্ছি। আমরা হুট করে পিএসসি–জেএসসি চালু করেছি এবং তা এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। আমরা সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে এখন বিপদে আছি।

এবার আমরা নতুন করে যোগ করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার আগে এখনো আমাদের সময় আছে আরও ভালো করে ভেবে দেখার। আরও সময় নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে।

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।