ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করবে

মুক্তিযুদ্ধ চেতনার মূলমন্ত্র হলো মুক্তির চেতনা। অবরুদ্ধ জীবনের বিপরীতে মুক্তির স্বাদ হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল স্লোগান। এর মধ্যে বাক্‌স্বাধীনতা অন্যতম। বাক্‌স্বাধীনতা পেতে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছি পাকিস্তানিদের পরাজিত করে।

পাকিস্তান শাসনামলে প্রতিটি সংগ্রাম গড়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সোনালি সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধুসহ সব বরেণ্য নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি যখন প্রতিনিয়ত মার খান, তখন দেখতে যেমন কদর্য লাগে, তেমনি মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব দিনে দিনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ক্ষত আমাদের রক্ত ঝরায়। ইদানীং এই বিশ্ববিদ্যালয় নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান থেকে প্রশাসনের অযোগ্যতা নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে।

যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় সব জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে আমাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি যখন আক্রান্ত হয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন, প্রশাসন কোনো ধরনের সহযোগিতা না করে বরং পুলিশের ভয় দেখিয়েছে।

শুধু এবারই নয়, বরাবর এ রকম অভিযোগ এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তারা অভিভাবক হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। কখনো তারা নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করেছে, এ রকম শোনা যায়নি। বরং সব সময় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে যখন প্রশ্ন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় একজন সাধারণ ছাত্র সরকারের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকে পরাজিত করে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভিপি হয়েছেন। এটা যদি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হয়, তবে তাঁকে প্রতিহত করার নামে সব সময় আক্রমণ করা ভিন্নমত দমন করার কৌশল বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনে সরকারের কৌশল নিয়ে যখন নানা সমালোচনা রয়েছে, তখন ঢাবির ভিপি নুরের ওপর এই আক্রমণ ভিন্নমত নিয়ে সরকারের অসহিষ্ণুতার চিত্র ফুটে ওঠে। তবে আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী ঢাবি ভিপিকে আক্রমণকারী দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যা হলো সবকিছু দেখতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে।

এখনো আবরার হত্যার দাগ মুছে যায়নি। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। বারবার হেরে যাচ্ছে সহনশীলতা ও আস্থার পরিবেশ। এখানে শুধু যাঁরা ভিকটিম তাঁরাই নন, দেশ হারাচ্ছে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মেধাবী তরুণদেরও। এই যে বুয়েটের আবরার হত্যার জন্য ২৫ জনের মতো অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা কি ভালো ছাত্র নন? প্রত্যেকের অভিভাবকের বড় স্বপ্ন ছিল তাঁদের নিয়ে। অথচ আবরারের পরিবারের মতো এই পরিবারগুলোও নিঃশেষ হয়ে যাবে।

আমাদের আসলে ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি কতটুকু দরকার, ভেবে দেখতে হবে। ছাত্ররাজনীতি যদি না-ও থাকে সরকারের কি খুব আসে-যায়? বর্তমান সরকারের অনেক নেতিবাচক খবর এসেছে এই দলীয় সংগঠনের ছাত্রদের হাত ধরে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে আসলেই কি স্বায়ত্তশাসনের ছাপ আছে? দলীয় রাজনীতির কারণে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের শিক্ষক সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আসলে কিছু করে? বরং বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক বিষয়গুলো তাঁদের কারণে সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের চেয়ে তাঁরা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির তেমন দরকার আছে বলে মনে হয় না। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই সংগঠনগুলো কী ভূমিকা রাখছে, আমার কাছে বোধগম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাই বুয়েটের মতো করে ভাবতে পারে। শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার ব্যাপারে তারা একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সব রকমের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়র হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং একটি সত্যিকারের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার এটাই উপযুক্ত সময়।
---
ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।