আমরা কি সত্যি বাংলাকে ভালোবাসি

কয়েক দিন আগে পার্কের পাশে গাড়ি থামিয়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান শুনছিলাম। ‘আমি বাংলায় ভালোবাসি/ আমি বাংলাকে ভালোবাসি/ আমি তারি হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’।

কিছু কিছু কথার মনে হয় চুম্বকীয় শক্তি থাকে। গান শোনার সময় হঠাৎ কানে এসে ধাক্কা খেল, ‘তুমি যে আমাকে এত ভালোবাসি ভালোবাসি বলো, তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাস?’

কী সংশয়বাদী কথা। এসব সংশয়বাদী কথার এক ধরনের সংক্রামক গুণ আছে। আমার মাথা সংক্রমিত হয় সংশয়বাদে। সংশয় ঢুকে পড়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের মধ্যে। আমরা কি সত্যি বাংলাকে ভালোবাসি?

যুক্তরাষ্ট্রের মতো এই বিদেশ বিভুঁইয়ে নানান দেশ থেকে আসা বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, ভাষার মানুষের সঙ্গে মিশতে ও কথা বলতে হয়। সে ক্ষেত্রে যোগাযোগের জন্য ইংরেজিই আমাদের একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা।

সবার ইংরেজি সবাই বুঝতে পারে না, কথা বলার জন্য প্রচলিত ইংরেজি ভাষার জ্ঞান, অভ্যাস আর বাচনভঙ্গির পার্থক্যের কারণে।

কোনো কোনো ইংরেজি ভাষার মানুষেরা আবার অন্যদের ইংরেজি বুঝতেই চান না। কথা বলা শুরু করতেই তাঁরা ‘এক্সকিউজ মি’, ‘সরি’ বলে থামিয়ে দেন।

এসব বাস্তব সমস্যা নিয়েই আমাদের বিদেশের জীবনযাপন।

কিন্তু আমি খুব অবাক বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করি, বাঙালিরা যখন উপমহাদেশের হিন্দি ও উর্দুভাষী মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তখন অনেকে বিগলিতভাবে তাঁদের সঙ্গে হিন্দি-উর্দুতে কথা বলতে থাকেন। এর মাঝে কারও কারও বেশ গর্ববোধ আছে যে তাঁরা ভালো হিন্দি উর্দু বলতে পারেন।

গর্ব করার কিছু থাকলে গর্ব করতেই পারে। কিন্তু যাঁরা ভালো হিন্দি-উর্দু বলতে পারেন না, তাঁরাও জানপাত করে ফেলেন হিন্দি-উর্দু বলার জন্য। অথচ বিপরীত পক্ষ থেকে কখনো কোনো চেষ্টা দেখা যায় না বাংলা বলার।

জানি এর জন্য আপনাদের এক হাজারটা যুক্তি আছে। যেমন আমরা হিন্দি-উর্দু সিনেমা দেখে ভাষা শিখতে পারি। হিন্দি-উর্দুভাষীরা তো আমাদের বাংলা সিনেমা দেখেন না। আমাদের সিনেমা অতটা উন্নত না। আমাদের ভাষা অনেক কঠিন। শতভাগ খাঁটি যুক্তি। তবু যুক্তিতে মুক্তির কোনো পথ দেখি না।

আমরা দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশি বাঙালির একটা অংশ পাকিস্তানের নাম শুনলে সাতটা গালি দিই। আরেক অংশ ভারতের নাম শুনলে আরও বেশি গালি দিয়ে অশেষ ছোয়াবের ভাগী হই। অথচ সামনাসামনি তাঁদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে একটি নতজানু অধস্তন ভাব ফুটে ওঠে আমাদের চোখেমুখে।

এটা শুধু ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই না। আমরা যেকোনো দেশের যেকোনো অঞ্চলের মানুষকেই ‘ফরেনার’ বলি। এই ‘ফরেনার’ বা বিদেশি মানেই উচ্চ শ্রেণির প্রাণী। আমরা নিজেদের অধস্তন ভাবি। এটি আমাদের রক্তের মাঝে মিশে আছে, যা আমাদের আচরণে প্রকাশ পায় এবং অন্যরা সে সুযোগটি গ্রহণ করেন।

যেমন আমার অফিসে আমরা একই পদে প্রায় ১০০ জন কাজ করি। এর মধ্যে আমরা ২৫ জন বাঙালি, ৫ জন হিন্দি ও ৫ জন উর্দুভাষী। তাঁরা সবাই দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী।

আমার অধিকাংশ বাঙালি সহকর্মীই আদাব-সালাম সৌজন্য প্রদর্শনের সময় বাঙালিদের চেয়ে হিন্দি-উর্দুভাষীদেরই অগ্রাধিকার দেন এবং তাঁদের সঙ্গে হিন্দি-উর্দু বলে নিজেদের ধন্য মনে করেন।

সেই সুযোগ নিয়ে একদিন এক হিন্দিভাষী সহকর্মী আমাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি হিন্দি বলতে পারেন না?’ আমি কোনো উত্তর দিই না। যেন আমি তাঁর কথা বুঝিনি।

তিনি আবার বললেন, ‘বেশির ভাগ বাঙালি তো হিন্দি বলতে পারে। এই যে আবদুল, সে তো আগে হিন্দি বলতে পারত না। এখন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে সুন্দর হিন্দি বলতে পারে।’

এবার আমি তাঁকে অত্যন্ত শীতল ও দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, ‘আপনি ২৫ জন বাঙালির সঙ্গে কাজ করেও একটা বাংলা শব্দ বলেন না আর আমাকে মাত্র ৫ জন হিন্দিভাষীর সঙ্গে কথা বলার জন্য হিন্দি শিখতে হবে কেন?’ এর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে আর কখনো হিন্দি বলেন না।

আমি জানি আপনারা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন না। তাঁদের জন্য অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমাদের বাংলা ভাষায় ইংরেজি ‘ইউ’ শব্দটির তিনটি বাংলা প্রতিশব্দ আছে—আপনি, তুমি ও তুই। সাধারণত মর্যাদা ভেদে এবং কখনো কখনো সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনুযায়ী আমরা এগুলো ব্যবহার করি।

অথচ বিদেশে এসে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এখানে ইংরেজি ‘ইউ’-এর বাংলা প্রতিশব্দ তুই ব্যবহার হয়। ধরে নিন আপনার বস ডেভিড আপনাকে বলেছেন, ‘মি. রহমান, ডু মি এ ফেবার, কুড ইউ প্লিজ কাম টু অফিস অ্যাট সেভেন ও’ক্লক টুমরো।’

আমরা প্রবাসীরা অনেকে এটার বাংলা করি, ‘ডেভিড বলেছে কাল “তুই” সাতটায় কাজে আসবি।’ এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, আমরা নিজেরা মনেপ্রাণে নিজেদের তুচ্ছ ভাবি। এক যুগের অধিক সময় এ দেশে বসবাস করার পরও এ ধরনের ‘তুই’ বলা শুনলে মনে হয় আমার কানের ওপর কে যেন ঠাস করে একটা চড় মারল। আপনাদের কি কখনো এমন মনে হয়েছে?

ভালোবাসার সঙ্গে সম্মানের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা যদি জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের সম্মান দেখাতে না পারি তাহলে অন্যরা আমাদের জাতিকে, আমাদের ভাষাকে সম্মান দেখাবে কীভাবে?

আমরা অনেক গর্ব ভরে স্মরণ করি আমাদের বায়ান্নর ইতিহাস, একাত্তরের ইতিহাস। কথায়-কবিতায় গানে আমরা আমাদের দেশ, জাতি, ভাষাকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। অথচ আমাদের অনেকের আচরণ দেখে সংশয় দেখা দেয়, আমরা কি সত্যি বাংলাকে ভালোবাসি?

আমার স্কুলজীবনের একটি হাসির গল্প দিয়ে শেষ করি। স্যার ক্লাসে ‘একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য’ বিষয়ে একটি রচনা লিখতে বললেন। আমার বন্ধু রাশেদ রচনার মাঝে এক জায়গায় লিখেছিল, ‘বাঙালি বিড়ির জাতি।’ তাই নিয়ে শুধু আমাদের ক্লাসেই হাসাহাসি হয়নি, সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পুরো এলাকায়।

রাশেদের নামের সঙ্গে বিড়ি শব্দটা প্রবচনের মতো আঁটকে গেল। অথচ রাশেদ সামান্য আঞ্চলিকতা দোষে একটা বানান ভুল করেছিল মাত্র। আমাদের এলাকায় ‘বীর’-কে আঞ্চলিক ভাষায় বীরি বলা হয়। একটুখানি অসচেতনতার ভুলে ওই বানান বিপত্তি।

তেমনি আমরা প্রবাসীরাও যেন একটু অসতর্কতার কারণে আমাদের জাতিসত্তাকে অন্যদের কাছে ছোট না করি। নিজেরাই নিজেদের তুচ্ছ না ভাবি। অন্যদেরও তুচ্ছ ভাবার সুযোগ না দিই। অন্যের কাছে আপনার হিন্দি-উর্দু জাহির করতে গিয়ে নিজের জাতিসত্তাকে ছোট করবেন না।

যিনি আপনাকে সম্মান দিয়ে ‘ইউ’ বলছেন, তাঁর বাংলা করার সময় ‘আপনি’ বা 'তুমি' বলুন, ‘তুই’ নয়। শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে বলার জন্য বলা বা সুন্দর সুরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাওয়ার জন্য গাওয়া নয়। অন্তর দিয়ে বিশ্বাস ও আচরণ দিয়ে তা প্রকাশ করা উচিত, আমরা সত্যি বাংলাকে ভালোবাসি।