এক বিয়ের কাহিনি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমাদের বিয়েতে কোনো সানাই বাজেনি। হলুদ–মেহেদি কিংবা বিয়ের কোনো আড়ম্বর অনুষ্ঠান হয়নি। ফুল দিয়ে ‘শুভবিবাহ’ লেখা কোনো গাড়ি নিয়ে বরযাত্রী আসেনি। বরযাত্রী কী বলছি, বরই তো আসেনি।

কিন্তু আমি লগ্নভ্রষ্ট হইনি। পাত্র ছাড়াই বিয়েটা সময়মতো হয়ে গেছে। আমার বিয়েটা হয়েছে, টেলিফোনে। বিয়ের দিন পাত্র ছিলেন আমেরিকায়। আর আমি ঢাকা শহরে।

পাত্রের সঙ্গে আমার শর্ত হয়েছে, যদি ভিসা না হয়, আমি বিয়ে করব না। ‘বিদেশ গিয়ে বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না, চিঠি দিয়ো, পত্র দিয়ো, জানাইও ঠিকানা’–জাতীয় গান গেয়ে অপেক্ষা করার মতো মেয়ে আমি নই।

তাই আগে ভিসা হলে তবেই বিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো ভিসা হয়ে গেলে এরপর টেলিফোনে বিয়ে করে তবেই সংসার করতে যাওয়া যাবে। যদিও সংসার করা কাকে বলে, এর মাহাত্ম্য কী আমার জানা নেই। সমাজের তৈরি করে দেওয়া ছাঁচকাটা নিয়মে আমাকে ফিট হতে হবে।

যা হোক ‘টেলিফোনে বিয়ে’—এই উর্বর চিন্তা কার মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছে, তা আজ আর মনে নেই। তবে তাকে সাধুবাদ না দিয়ে পারছি না।

বিয়েটা আমরা আমেরিকাতেই করতে পারতাম। বিয়ের প্রধান দুই উপাদান পাত্র ও পাত্রীর উপস্থিতিতে।

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে না করে ড্যাং ড্যাং করে আমেরিকা চলে যাবে। এরপর কবে কীভাবে বিয়ে হবে। এর মধ্যে যদি দুজন দুজনকে ছুঁয়েটুয়ে ফেলে। তাহলে কী কেলেঙ্কারিটাই না হবে। এখানেই মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে বিয়ে হতে হবে।

আমার কাছে বিয়ের এই প্রথা বড়ই হাস্যকর। টেলিফোনের বিয়ে তো কথাই নেই। শুধু কেউ যে ‘দূরালাপনীর বিয়ে জায়েজ নয়’ বলেনি, তাতেই আমি আহ্লাদে আটখানা। যা খুশি করুক। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা যেভাবে শান্তি পান। নিজের জন্য বা সমাজ–সংসারের মুখবন্ধ করার জন্য যা করে করুক।

আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমাদের বাসায় তখন টেলিফোনও ছিল না। আব্বা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সবে রামপুরায় ছোট দোতলা একটা বাড়ি করে তার সঞ্চয়ের সিংহভাগ উজাড় করে দিয়েছেন। টেলিফোনের জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু উপরি টাকা না দেওয়ায় টেলিফোনে তখনো লাগেনি। তাই বিয়েটা হবে সামনের বাসার টেলিফোনের মাধ্যমে।

বিয়ের দিন আমার বন্ধুরা কয়েকজন এল। রীতা বিউটিশিয়ান। আমাকে সাজিয়ে দিল। আমি আমার আম্মার লাল পাড়ের নীল কাতান পরে আর কান ও গলায় সোনার অলংকার পরে বারান্দায় গিয়ে বসে রইলাম।

আমার আব্বার বাসায় আমার ঘরের সঙ্গে একটা লাগোয়া বারান্দা ছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের উল্টো দিকের বিস্তীর্ণ ঝিল দেখা যেত। যা এখন আধুনিক হাতিরঝিল। সেখানে তখনো অর্ধনিমজ্জিত ডিঙি মাথা উঁচু করে জেগে থাকত।

আমি বারান্দায় আমার বেতের চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও শক্তি পড়তাম। নিজের মতো বাঁচার, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।

আমি বড় মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত বাবার বড় মেয়ে। আমার পেছনে আরও তিন মেয়ে। দুই ছেলেও আছে। বড়জন ঘন ঘন বিদেশযাত্রা করেন। ছোট ছেলে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়।

মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক টানাপোড়েনের তাপ তাদের ছুঁতেও পারে না। চাইলেই হাতখরচ পেয়ে যাচ্ছে। কোনো অজুহাত নেই। যত শিক্ষিত ও অবস্থাপন্নই হোক না কেন, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বড় অসহায়। তার ওপর যদি চার কন্যা হয়, তবে তো কথাই নেই।

আমি বাড়ির বড় মেয়ে। সমাজ–সংসারের সবার চোখ যেন লেজার লাইটের মতো আমাকে খুঁজে বেড়ায়। আত্মীয়, অনাত্মীয়, প্রতিবেশী অপ্রতিবেশী, চায়ের দোকানদার, ডাকপিয়ন, খবরের কাগজের হকার, এমনকি কলিং বেল বাজিয়ে যে ভিক্ষা করে, সেই বুড়ো ভিক্ষুক, সে–ও হাতে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে জানতে চাইবে—এইডা বুঝি আপনার মাইয়্যা? বয়স কত? বিয়া অয়নাই? ইয়া আল্লা! কয় নম্বর? এরপরে কয়ডা?

ব্যস শুরু হয়ে গেল নম্বর লাগানো। আমার আব্বাও তত অস্থির। আমার বই পড়া জ্ঞানী আব্বা, যিনি সারা জীবন খুঁজে খুঁজে ভালো ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন আমাদের, তিনিও বলতে শুরু করলেন, ‘স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঘর। সবকিছুর একটা সময় আছে।’

যিনি সারা জীবন ছেলেমেয়েদের একইভাবে মানুষ করেছেন, তিনিই কর্মজীবন থেকে অবসরের গিয়ে অন্য মানুষ। হঠাৎ তার মুখেই অসহায়ত্ব। আর আমিই তার প্রথম রক্ষাকর্তা। যেন একটি মেয়ে বিয়ে হলে তার কলঙ্ক ঘুচবে।

এসবের মধ্যেও পড়াশোনা করছি। চাকরি করছি। কবিতা পড়ে, মিছিল–মিটিং করে দেশ উদ্ধার করছি। এর মধ্যে দুটি এনজিও থেকে আমন্ত্রণ এল ফেলোশিপের। একটা রাজশাহীতে আর একটা কক্সবাজারে। সবকিছু বিবেচনা করে রাজশাহীরটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, সেখানে আমার চাকরি করার ইচ্ছে আছে।

তিন মাস মুক্তির আনন্দে, অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়াব, লেখালেখি করব, কী আনন্দ। টাকাও ভালোই পাব। টিকিট কাটতে গাবতলী গিয়ে বন্ধু রীতার বাসা থেকে টেলিফোনে তৎকালীন ক্যাজুয়াল বয়ফ্রেন্ডকে ক্যাজুয়ালি বলে নিজেই নিজের ভুলের ক্যাজুয়ালটি হয়ে গেলাম।

‘এক্ষুনি রাজশাহীর টিকিট ক্যানসেল। আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে যাও। আমি বাসায় আমাদের বিয়ের কথা বলছি।’

আমি এমনিতেই গেছো মেয়ে। চাকরি করা মেয়ে। ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া মেয়ে। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করা মেয়ে। কবিতা পড়া মেয়ে। এরপর যদি সেই মেয়ে সারা দেশ একা একা চষে বেড়ায়, তবে তো সে মেয়েকে বিয়ের কথা মুখে আনা যাবে না। বেচারা আমাকে নিয়ে নাজেহাল।

আমেরিকার ভিসা হয়ে গেল। ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’র মতো করে বিয়েটাও হয়ে গেল খুব ছোট করে। সারা জীবন নিজের শক্ত দুটি পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা মেয়েটি বিনা বাক্যে হাঁটু মুড়ে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসল। সেই দিন সেই রাজশাহী যাওয়া ছিল আমার আমার উন্মুক্ত পৃথিবীতে হাঁটার প্রথম পদক্ষেপ। আমার স্টেপিং স্টোন। সে পথে পা না দিয়ে আমি স্বামীর ছায়াসঙ্গী হয়ে অজানার পথে পা বাড়ালাম।

যা বলছিলাম, বিয়ের দিন তেমন কাউকে বলা হয়নি। শুধু মুন্নি, বিজু, রীতা এল। পাত্রের পরিবার, আমার কাকা আর চাচি। বিয়ে পড়াবেন কোনো এক কাজি। পাত্র প্রতিবেশীর টেলিফোনের ওই প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রে আর পাত্রী রামপুরার ঝিলের পাড়ের বারান্দায়।

আমার কাকা, আব্বা আর লম্বা আলখাল্লা পরা কাজি সাহেব একটা নীল রঙের বড় নথিপত্র নিয়ে এবাড়ি–ওবাড়ি করে এই মহান কাজ সাঙ্গ করছেন।

কাজি সাহেব আমার ঘরে আসার আগেই আমাকে আমার বিছানায় এনে বসানো হলো। আমার পাশে বিজু। রুমাল হাতে নিয়ে বসে আছে। আমাকে বোঝাচ্ছে, মন খারাপ করিস না। কান্নাকাটি করবি না…ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কাজি বলার সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলে দিস না। অন্তত তিনবার বললে তারপর রাজি হবি।

আমি বললাম, ঠিক আছে, তাই হবে।

কাজি এলেন কাকার সঙ্গে—‘মা বলো…অমুকের ছেলের সঙ্গে, অত টাকা দেন মোহরে …। তুমি বিয়ে করতে রাজি?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম রাজি। যেখানে দস্তখত করতে বললেন, করে দিলাম। সম্পূর্ণ ঘটনাটা দু-এক মিনিটের বেশি সময় নেয়নি।

বিজু প্রথমে মুখ খুলল, এটা কী হইল?

: কী হইল?

আমি উত্তর দিলাম।

: আমি যে রুমাল নিয়ে বসে আছি!

: তুই রুমাল নিয়ে বসে আছিস কেন?

: তুই রাজি হওয়ার আগে কান্নাকাটি করবি, আমি তোর চোখ মুছে দেব।

: তাই? সরি, কান্না আসে নাই।

বিজু আশাহত। মুন্নিও বিজুর অবস্থা দেখে আশাহত। মুন্নি বলল, তুই কি ইদানীং ঘন ঘন বাংলা সিনেমা দেখছিস?

ওদিকে (পরে শুনেছি) কাজি যখন পাত্রকে ‘অমুকের মেয়ের সঙ্গে …অত টাকা দেন মোহরে...তুমি বিয়ে করতে রাজি?’ প্রশ্ন করেছে, পাত্র তার উত্তর দিয়েছে ‘ওকে’। কাজি এই উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে শুদ্ধ ভাষায় বলেছেন, ‘ওকে বলিলে চলিবে না, কবুল বলিতে হইবে!’

এরপর আমাদের বন্ধু মহলে ‘ওকে বলিলে চলিবে না, কবুল বলিতে হইবে’, এই ডায়ালগ বহুল সমাদৃত হয়।

লেখিকা
লেখিকা

আমার আম্মা রাগ হয়ে গেলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। কাজি সাহেব এহেন পাত্র–পাত্রীর বিয়ে দিতে এসে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন কি না জানা যায়নি।

আমার জানামতে, পাত্রের ভোকাভোলারি সীমিত। আর তার সবচেয়ে প্রিয় দুই শব্দ হচ্ছে ‘খামাখা’ ও ‘ওকে’। তার অপ্রতুল শব্দ ব্যবহার আমার অনুকূলেই কাজ করেছে। যেকোনো প্রশ্নের উত্তরে সে প্রথম বলবে খামাখা (কী দরকার)। তারপর রাগ হয়ে একই প্রশ্ন আরেকবার জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘ওকে’। এর মানে, তার কোনো কিছুতেই না নেই এবং কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। সেই লোকের সঙ্গে আজ আমার বিয়ের পঁচিশ বছর।

আমার লাল শাড়ি পরে বিয়ে হয়নি। আমার বিয়ের বাসররাত সুচিত্রা-উত্তমের ‘এই রাত তোমার আমার’ মতো হয়নি। বাসররাত কাটিয়েছি মুন্নির সঙ্গে রাত জেগে গল্প করে। আমরা বিয়েবার্ষিকী, ভ্যালেন্টাইন—কিচ্ছু পালন করি না। খামাখা।

বিয়ের পরদিন সকালে আমার শাশুড়ি মশারি উঠিয়ে নতুন পুত্রবধূর মুখ দেখেছেন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। মুন্নি কনুইয়ের গুঁতোয় জেগে উঠে দেখি আমার শাশুড়ি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

এতসব গল্প বলতে গিয়ে যা বোঝাতে চাচ্ছি, তা হলো আমার অনাড়ম্বর বিয়ের মতো আমার বৈবাহিক জীবনটাও অনাড়ম্বর। বলা যায়, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের চেয়ে আমরা বন্ধু হয়েই বেশি কাটিয়েছি। দাবিদাওয়ার, উচিত–অনুচিত, দায়িত্ব–কর্তব্যের চেয়ে সম্পর্কের আরামটাকে প্রয়োজন ছিল।

দুজনের মধ্যে বিস্তর পারাবার নাকি খুব মিল, তা বোঝার উপায় নেই। কারণ, এসব ছেলেমানুষি গল্প আমরা করি না। তবুও একটা হাত ধরে থাকা আছে।

তিনি কথা বলেন না। আমি দুজনের হয়ে সে ঘাটতি মিটিয়ে দিই। আমি মিষ্টিমধুর নই। বলতে গেলে একপ্রকার রুক্ষ বলা যায়। তিনি সেই ঘাটতি মিটিয়ে দেন তার প্রায় দেবতাসুলভ (!) আচরণ দিয়ে।

আমাকে তার ছায়াসঙ্গী হয়ে বাঁচতে হয়নি। এতেই আমি আমার আগামী জীবনও খামাখা তার সঙ্গে কাটিয়ে দিতে রাজি আছি। আমি জানি, তিনিও বলবেন ‘ওকে’!