সাস্কাতুনে এক টুকরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মিলনমেলার অংশগ্রহণকারীরা
মিলনমেলার অংশগ্রহণকারীরা

কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশের ছোট্ট শহর সাস্কাতুনে এখন অনেক বাঙালির বসবাস। দিনে দিনে তাঁদের সংখ্যাও বাড়ছে। তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী।

এর মধ্য দু-একজন তরুণ অনেক দিন থেকেই ভাবছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এমন একটি প্রাণের সংগঠন করা যায় কি না, যা একটি ছোট্ট পরিবারের মতো হয়ে উঠবে।

মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

যেখানে সবাই কয়েক ঘণ্টার জন্য জন্য হলেও প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবেন। মন ভরে হাসতে পারবেন। একজন আরেকজনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবেন। কিংবা কখনো মানসিকভাবে শক্তি জোগাবে।

সে কারণেই ভাবা হলো, তথাকথিত সংগঠনের মতো নেতানেত্রী দিয়ে এটি চলবে না। এটি চালাবেন সব অ্যালামনাই সদস্যরা, সবাই। ঠিক করা হলো, ছোট ছোট কমিটি করে দেওয়া হবে। তাঁরাই আয়োজন করবেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

এর জন্য পাঁচজন ফোকাল পয়েন্ট (মুখপাত্র) বাছাই করা হলো। তাঁরা হলেন সাঈব শাহরিয়ার, দেবাশীষ ভৌমিক, তাহমীনা শাহিন, নাজিয়া আরিফা ও জাকির সরকার, যাঁরা অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।

মাঝে মাঝে পুনর্মিলনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বনভোজন, চায়ের আড্ডা নিয়ে সারা বছরই এটিকে সক্রিয় রাখা হবে।

খোলা হলো ফেসবুক পেজ। যেখানে নতুনদের চাকরি, বাসস্থান, পড়াশোনা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হবে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ রাখা হবে।

এই লক্ষ্যে কয়েকজন প্রাক্তন ঢাবি ছাত্রছাত্রী সাস্কাচেওয়ান ইউনিভার্সিটির মাঠে বসে গোড়াপত্তন করল এই সংগঠনটির। যাত্রা শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইয়ের। আর এই অসাধ্য সাধন করেছেন যে শিক্ষার্থী, তাঁর নাম সাঈব শাহরিয়ার।

ইতিমধ্যেই পরিবারের সদস্যসহ জনা ৫০ জন নিয়ে প্রথম ছোট পুনর্মিলনী হলো। প্রথম পুনর্মিলনীর পরই সদস্য সংখ্যা বেড়ে গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হলো। সে কারণেই গুড শেফার্ড লুথারন চার্চের কমিউনিটি সেন্টারে একটি হলরুম ভাড়া করা হলো।

উপস্থাপনায় ছিলেন ভিকারুন নিসা, সাঈব শাহরিয়ার ও নাজিয়া আরিফা
উপস্থাপনায় ছিলেন ভিকারুন নিসা, সাঈব শাহরিয়ার ও নাজিয়া আরিফা

পুনর্মিলনীতে মনে হচ্ছিল বরফের দেশে যেন এক টুকরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন (২৬ জানুয়ারি) ভীষণ শীত। চারদিকে শুভ্র বরফে ছেয়ে আছে ছোট্ট সাস্কাতুন শহর। প্রচণ্ড ঠান্ডা। বইছে হাড়কাঁপানো বাতাস।

তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইয়ের সদস্যরা একত্র হয়েছিল চমৎকার একটি প্রাণমাতানো অনুষ্ঠানে পুরো পরিবার নিয়ে। সবাই মিলে আবার ফিরে গিয়েছিলেন যেন সবার জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালি সময়ে।

‘পুরোনো সেই দিনের কথা, ভুলবি কিরে হায়, ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।’ কবিগুরুর গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই সত্যি সত্যি ফিরে গিয়েছিলাম আমাদের ফেলে আসা তরুণবেলায়। আমাদের গর্বের সময়টায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী হিসেবে আমরা গর্ব বোধ করি। সব সময়ই ভীষণ একটা প্রাণের টান অনুভব করি। তাইতো প্রাণের টানে আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্য আবারও আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালি সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম।

সেদিন সবাই এসেছিলেন, চমৎকারভাবে সেজেগুজে। মেয়েদের পরনে ছিল দেশীয় শাড়ি। ছেলেরা পরেছিলেন পাঞ্জাবি।

সবার মুখেই চমৎকার হাসি। ভীষণ সুখী সুখী চেহারা। ছোট্ট মিলনায়তন সত্যিই যেন এক টুকরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠল।

সত্যি বলতে কি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়টাই তো ছিল আমাদের জীবনের অন্যতম সুন্দর সময়। সে রকমই একটি সুন্দর সময়কেই ফিরিয়ে আনার অব্যর্থ চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে।

প্রথমেই চা-শিঙাড়া দিয়ে আপ্যায়িত হলেন অতিথিরা। তার পরই শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমেই আমাদের নতুন প্রজন্ম কানাডায় বড় হওয়া বাচ্চাদের অনুষ্ঠান। এরপর প্রাক্তন ঢাবিয়ানদের নিয়ে প্রাণবন্ত আয়োজন।

নতুন করে আবার প্রাণের মেলায় প্রাণ জুড়িয়ে একসঙ্গে গলা মেলাল, গান গাইল, কবিতা পড়ল আর প্রাণ ভরে গল্প করল। সবশেষে ছিল ফ্যাশন শো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা হলের প্ল্যাকার্ড নিয়ে হলো প্রদর্শনী। তার পরই শুরু হলো একসঙ্গে সবার গানের সঙ্গে নাচ, ফটো সেশন।

অনুষ্ঠানটির সাংস্কৃতিক সমন্বয়কারী ছিলাম আমি ভিকারুন নিসা, আমার সঙ্গে ছিলেন নুরুল হুদা পলাশ, শাহরীমা তাহসীন, সাঈব শাহরিয়ার, নাজিয়া আরিফা ও মাসুদ আল মামুন। খাদ্য কমিটিতে ছিলেন দেবাশীষ ভৌমিক গৌতম, মাসুদ আল মামুন, ফাতেমা শাহিন, মাহবুবা আহসান পুতুল, জাকির সরকার ও রুহুল আমিন।

আরও অনেক ছোট ছোট কমিটি অনুষ্ঠানটি সার্বিকভাবেই সার্থক করে তুলেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সাস্কাচেওয়ান ইউনিভার্সিটির মাঠে বসে গোড়াপত্তন করেন সংগঠনের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সাস্কাচেওয়ান ইউনিভার্সিটির মাঠে বসে গোড়াপত্তন করেন সংগঠনের

স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিতে ছিলেন নুরুল হুদা পলাশ ও রহমত মুনশি। ইসরাত পাপড়ির গলায় আধুনিক গানটিও ছিল অসাধারণ। আসলে সবাই কিছু না কিছুতে অংশ নিতে চেয়েছে। সবার নাম আর নাই লিখলাম। অনুষ্ঠানের শিল্পীরা আসলে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বারবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনায়, সংস্কৃতিতে, নেতৃত্বে মেধাবীদেরই সূতিকাগার।

সেই রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে গল্প আর গল্প, টিএসসির বারান্দাতে বসে কবিতা আবৃত্তি, ডাসের মঞ্চে গান গাওয়া কিংবা রোকেয়া হলে বা শামসুন নাহার হলের সামনের রাস্তায় অলস হাঁটাহাঁটি। কতই না স্মৃতি আর ভালো লাগা আর গর্ব জড়িয়ে আছে সেই সময়কে ঘিরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সব প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরই তো সেই চমৎকার দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে মন চায়। আবার সেই তরুণ ছাত্রটি হতে ইচ্ছে করে। আর সেটা যদি হয় দূর পরবাসে, কানাডার ছোট্ট শহর সাস্কাতুনে? কিছু তরুণের অদম্য ইচ্ছা আর আন্তরিকতায় সেটি সম্ভব হলো। পুরোনো আর নতুনের মেলবন্ধনে যাত্রা শুরু হলো এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইয়ের পরিবারের।

নতুন প্রজন্মের পরিবেশনা
নতুন প্রজন্মের পরিবেশনা

অন্যদিকে খাদ্য কমিটি তৈরি ছিল খাসির বিরিয়ানি, কোক, বুটের ডাল আর সালাদ নিয়ে। বড়দের চাঁদা ছিল দশ ডলার, ছোটদের পাঁচ ডলার, আর পাঁচ বছরের নিচে ফ্রি। এত কম টাকায় এমন পেট পুড়ে খেয়ে বাসায় খাবারও নিয়ে গেল অনেকে। দেবাশীষ ভৌমিক গৌতম, মাসুদ আল মামুনকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয় এমন মজাদার খাবার পরিবেশনের জন্য।

শীতের সন্ধ্যাটি ভীষণ উষ্ণতা ছড়িয়ে যেন ফুরিয়ে গেল ভীষণ দ্রুত।। সবার মুখেই তৃপ্তির হাসি। খাবারদাবার, গল্প, হাসি আনন্দ, গান-বাজনা কোনো কিছুরই তো কোনো কমতি ছিল না অনুষ্ঠানে। সবচেয়ে বড় কথা, সবাই ছিল ভীষণ রকম আন্তরিক, প্রাণোচ্ছ্বল আর আবেগে আপ্লুত। আবারও নতুন আরেকটি পুনর্মিলনীর স্বপ্ন নিয়ে আর একমুঠো সুখস্মৃতি নিয়ে সবাই ফিরে গেল ঘরে। এভাবেই শেষ হলো প্রাক্তন ঢাবিয়ানদের পুনর্মিলনীর চমৎকার ‘এসো মিলি প্রাণে’ অনুষ্ঠানটি।