প্রভাতফেরি

লেখকের বাসার ছাদে তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনার (২০১৫)
লেখকের বাসার ছাদে তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনার (২০১৫)

আমার শৈশবে বছর, মাস, তারিখ এইগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় বা বুদ্ধি কোনোটাই আমাদের ছিল না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপনের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসত মাত্র। পরিবার–পরিজনের কাছ থেকে বাংলা মাসের হিসাবটা জানতে পারতাম। বিশেষ করে হিন্দু বাড়ির কর্তার কাছ থেকেই আমরা এই সব ধারণা পেতাম। তাঁর কাছে চন্দ্র বর্ষের দিনপঞ্জিকা ছিল। সেটা দেখে উনি আমাদের ঠিক ঠিক দিন তারিখ বলে দিতেন এবং সেই অনুযায়ীই ফসল বোনা ও কাটার দিন তারিখ ঠিক করা হতো। ইংরেজি দিন তারিখের হিসাব আমাদের জীবনে ছিল না বললেই চলে। শুধুমাত্র একটা বিশেষ দিন ছাড়া সেটা হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী দুজন বড় ভাই যারা বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তাঁরাই আমাদের এই তারিখটা মনে করিয়ে দিতেন এবং তাঁদের কাছ থেকেই এই বিশেষ দিনটার মাহাত্ম্য সর্বপ্রথম জানতে পারি। আজ আপনাদের সেই গল্পই বলব।

আমাদের শৈশবে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমাদের পাড়ারও দুজন মেধাবী ছাত্র এই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং একেবারে সক্রিয় রাজনীতি করতেন সেই স্কুল জীবন থেকেই। তারাই ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলা আমাদের জানিয়ে দিতেন কাল ২১ ফেব্রুয়ারি সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে থাকবা। প্রভাতফেরিতে যেতে হবে। এরপর থেকে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। প্রচণ্ড রকমের উত্তেজনা নিয়ে আমরা ঘুমাতে যেতাম এবং ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখতাম আমরা সবাই দল বেঁধে প্রভাতফেরিতে হাঁটছি। কোনোমতে রাতটা পার করে খুব ভোরেই আমরা ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে পাড়ার তেমাথায় (তিন রাস্তার মোড়) জড়ো হওয়া শুরু করতাম।
এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার সেটা হচ্ছে, আমরা যতটা উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম ঠিক ততটাই আতঙ্ক নিয়ে কিছু মানুষ ওই দিন ঘুমাতে যেত যাদের বাড়িতে ফুল বাগান বা ফুলের গাছ ছিল। কারণ সকাল হওয়ার আগেই কোনো এক অজানা জাদুর কাঠির স্পর্শে গাছগুলোর ফুলগুলো হারিয়ে যাবে তাই তারা ঠিকমতো রাত্রে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতেন না। প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে শুভেচ্ছা জানানোর ফুল জোগাড় করা হতো এভাবেই। পাড়ার সব ছেলেমেয়ে জড়ো হওয়ার পর গুণে দেখা হতো সবাই এসেছে কিনা? যদি তখনো কারও ঘুম না ভাঙত, অন্যরা গিয়ে তাকে দ্রুত ডেকে নিয়ে আসত।
এরপর আমাদের রেল লাইনের মতো করে সমান্তরালভাবে দুই সারিতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। আর সামনে রেল লাইনের স্লিপারের মতো থাকতেন ভাইয়ারা। মাঝেও আরও দু-একজন দাঁড়িয়ে যেতেন যাতে লাইন বাঁকা না হয়ে যায় সেটা দেখার জন্য। আমরা ছোট ছোট কদমে হেঁটে শহরের দিকে এগোতে থাকতাম। শহরে পৌঁছানোর পর সেখানে আগে থেকেই আমাদের মতো আরও কয়েকটি দল অপেক্ষা করত। সব দল একত্রিত হওয়ার পর আমরা সবাই মিলে বিশাল একটি মিছিলের আকৃতি পেতাম। এই যাত্রার সময় সারাক্ষণই আমরা মুখে গাইতে থাকতাম সেই অমর দুটি লাইন—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
এরপর আমরা একসময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে অবস্থিত শহীদ মিনারে পৌঁছাতাম এবং একেবারে সুশৃঙ্খলভাবে একে একে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আমরা আবার একইভাবে সারিবদ্ধ হয়ে পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরতাম। এই প্রক্রিয়াটা বেলা বাড়ার আগেই শেষ করা হতো। কারণ রোদের তেজ বেড়ে গেলে আমাদের খালি পায়ে হেঁটে ফিরতে সমস্যা হবে। একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস তখনো আমাদের অজানা ছিল। তবে মনের মধ্যে একটা আলাদা রকমের সম্ভ্রম কাজ করত। শৈশব–কৈশোরের দিনগুলোতে এভাবেই আমরা ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শহীদ মিনারে গিয়ে ঘুমানো একটা শখের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল কিন্তু যতবারই শহীদ মিনারের বেদিতে পা দিয়েছি জুতা খুলে হাতে নিয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারির রাত্রির প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভার স্কাউটদের কর্মতৎপরতা আমাকে মুগ্ধ করত। হল থেকে আমরা দল বেঁধে গিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখতাম। মাঝরাতে শহীদ মিনারের পলাশ গাছে উঠে ফুল পাড়া ছিল আমার আর আমার রুমমেট ফরহাদের অন্যতম পছন্দের কাজ।

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনার (২০১৭)
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনার (২০১৭)


বিয়ের পর মেয়ে বড় হওয়ার পর কতবার ভেবেছি মেয়েকে কাঁধে নিয়ে শহীদ মিনারের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাব। কিন্তু সেটা আর কখনই করা হয়ে ওঠেনি। সেই অভাবটা কিছুটা পূরণ করে নিতাম আমরা সবাই মিলে বাসার ছাদে শহীদ মিনার বানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। প্রতিবছরই আমরা অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করতাম আর তাতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। একবার ফাল্গুনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ শিমুল ফুল দিয়ে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। আমার মনের একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল তাহিয়া যখন বড় হবে তখন এই ছবিগুলো দেখে ওর বর্ণিল শৈশবটাকে স্মরণ করবে এবং ভাষার প্রতি ও ভাষা শহীদদের প্রতি ওর ভালোবাসা তৈরি হবে।
কিন্তু কিছু ব্যাপার আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে। সকালে বের হয়েছিলাম শিমুল ফুল জোগাড় করতে। উত্তরার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম নামজাদা সব বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো তাদের স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে প্রভাতফেরি বের করেছে। তার সঙ্গে ভ্যানে করে হারমোনিয়াম, তবলা বাজিয়ে এক অদ্ভুত সুরে ভাষাবিষয়ক বিভিন্ন গান গেয়ে যাচ্ছে। সবার হাতেই বিভিন্ন রকমের ফুলের তোড়া। সবার পরনেই স্কুলের নির্ধারিত পোশাক আর শিক্ষক শিক্ষিকারা পরেছেন ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে মিল রেখে সাদা-কালো দিয়ে ডিজাইন করা বিভিন্ন রকমের পোশাক। এই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল কিন্তু এরা সবাই জুতা পরে প্রভাতফেরি করছিল।
দেশান্তরি হওয়ার পর মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা কাজ করছিল বিদেশ বিভুঁইয়ে কীভাবে এগুলো ধরে রাখতে পারব। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আসার দ্বিতীয় সপ্তাহেই আমরা খোঁজ পেলাম আমাদের সবার্বেই বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা স্কুল আছে ‘ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল’ নামে। প্রতি রোববার বেলা দশটা থেকে একটা পর্যন্ত সেখানে বাংলা ভাষা ও গান শেখানো হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল জাতীয় দিবস যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যে পালন করা হয়। সেই থেকে শুরু। এরপর প্রতিবছর নিয়ম করে আমাদের বাচ্চারা ২১ ফেব্রুয়ারিসহ অন্যান্য দিবস পালন করে আসছে। আসলে স্কুলের শুরু থেকেই তারা এই দিবসগুলো পালন করছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় ২১ ফেব্রুয়ারি যেহেতু আলাদাভাবে ছুটির দিন না, তাই কাছাকাছি কোনো একটা ছুটির দিনে সেটা পালন করা হয়। সেটার প্রস্তুতি চলে অনেক দিন আগে থেকেই। আর আগের দিন রাত থেকে শুরু হয়ে যায় আমাদের শহীদ বেদি ও পুষ্পমাল্য বানানোর কাজ। এখানে ২১ ফেব্রুয়ারিটা এমন এক সময় আসে যখন গাছে তেমন কোনো ফুল থাকে না। তাই আগের দিন সন্ধ্যায় ঠিক বাংলাদেশের মতো আমরা খুঁজে খুঁজে বের করি কার বাসায় ফুল আছে। তারপর হানা দেওয়া হয় সেই বাসায় ফুল চুরি করতে। তারপর রাত জেগে বানানো হয় পুষ্পমাল্য। আমাদের সঙ্গে আমাদের বাচ্চারাও সমানতালে হাত লাগায় আর করতে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন।
খুব ভোরে উঠে আমরা বাকি কাজগুলো শেষ করতে লেগে যাই। কাঠের তৈরি শহীদ মিনার নিয়ে এসে বেদিতে বসিয়ে দিয়ে একেবারে বাংলাদেশের শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তারপর বাচ্চারা চলে আসলে আমরা সবাই মিলে খালি পায়ে পুষ্পমাল্য হাতে নিয়ে দুই সারিতে পুরো স্কুলটা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে সেটা অর্পণ করা হয়। এরপর বাচ্চারা সবাই একে একে শহীদ মিনারে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এভাবেই বিদেশে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে পড়ছে।
ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেটাকে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। খুবই খুশির খবর হচ্ছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয়ভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের বিল পাস করা হয়েছে। আশা করা যায় এতে করে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা আরও বেশি উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে দিবসটি পালন করবেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরবেন।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।