ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: মুগ্ধ হওয়ার দেশ লাওস

বৃত্তাকার নৃত্য। ছবি: লেখক
বৃত্তাকার নৃত্য। ছবি: লেখক

লাওসের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় উৎসব হলো নববর্ষ উদ্‌যাপন। এরপর নৌকাবাইচ, রকেট নিক্ষেপ ও উপজাতিদের বিভিন্ন রকমের উৎসব।

প্রতিবছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে একই তারিখে মহা ধুমধাম করে নববর্ষ উদ্‌যাপন করা হয়। নববর্ষের সময় ছেলেমেয়েরা বাড়ি ও রাস্তাঘাটে পরস্পরের প্রতি বালতি, ওয়াটার পাম্প, প্লাস্টিক ব্যাগ, এমনকি হাতির শুঁড় থেকেও পানি নিক্ষেপ করে থাকে।

অবাক হওয়ার মতো একটা বিষয় হলো এদের নববর্ষ ও আমাদের বাংলা নববর্ষ একই সময়ে উদ্‌যাপিত হয়। তবে এরা নববর্ষ উদ্‌যাপন করে ১৩ থেকে ১৫ তারিখে। আর আমরা উদ্‌যাপন করি ১৪ এপ্রিল। এদের বর্ষগণনা এখন ২৫৬২ হলেও আমাদের বাংলা সন হচ্ছে ১৪২৬। সুতরাং এদের সভ্যতা আগে শুরু হয়েছে বলতে হবে।

নৌকাবাইচ সাধারণত অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠান নৌকাবাইচ ও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল উভয় নামেই পরিচিত।

সাধারণত প্রতিবছর এপ্রিলের শেষে বা মে মাসে রকেট নিক্ষেপ উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। মেকং নদের দুই ধারে যারা বাস করেন, তাঁরাই মূলত এ উৎসবে বেশি অংশ নিয়ে থাকেন।

বাঁশের ভেতর বারুদ ভরে সুন্দর সুন্দর ডিজাইনে রকেট তৈরি ও নানা ধরনের সাজগোজ করে নিক্ষেপের জন্য সবাই এক জায়গায় মিলিত হন। বিরাট জনসমাগমের ফলে নদীর পাড়ে বসে জমজমাট মেলা।

এক সময় আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত হয় রকেটগুলো। যাঁর রকেট সবচেয়ে বেশি ওপরে ওঠে, তিনি প্রথম পুরস্কার পেয়ে থাকেন।

এদের বিশ্বাস, বেশি ওপরে ওঠা রকেট প্রভু বুদ্ধের কাছে চলে যায় এবং তিনি পুরস্কার হিসেবে মেঘমালাকে মর্ত্যে বর্ষণের আদেশ দেন। উত্তপ্ত ধরণি বর্ষণের পানিতে সিক্ত হয়ে সবুজ–শ্যামল আকার ধারণ করে। উৎপাদিত হয় হাজারো রকমের ফলমূল, শস্যদানা। প্রশান্তি আসে জনজীবনে।

উপজাতিদের অনেকে তাঁদের নিজস্ব নববর্ষ আলাদা করে পালন করার সময় যুবক-যুবতীদের ওই গোত্রের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধানে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।

এদের একটি উৎসব হলো ছেলেমেয়ে পরস্পরের মুখোমুখি লাইন করে দাঁড়ানো এবং একে অন্যের প্রতি প্লাস্টিকের বা বেতের তৈরি বল নিক্ষেপ করা।

এ অনুষ্ঠানে একটা দারুণ উল্লেখযোগ্য দিক আছে। নিয়মমাফিক একজন বল নিক্ষেপ করবে, অন্যজন ধরে সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দেবে। কিন্তু নিক্ষিপ্ত বল ধরে যদি কেউ ফেরত না দেয়, এর অর্থ সে বল নিক্ষেপকারীকে ভালোবাসে।

অন্য সময় মা–বাবা এমন সম্পর্ক মানতে রাজি না হলেও এ উৎসবের সময় তাঁরা অনেকটাই নমনীয় হয়ে যান ও ছেলেমেয়ের ইচ্ছা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ান না।

বাজারে পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা। ছবি: লেখক
বাজারে পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা। ছবি: লেখক

বিশ্বাস করুন আর না–ই করুন, একটি গোপন তথ্য প্রকাশ না করে পারছি না। বয়োপ্রাপ্ত পুরুষের পুরুষত্বের বহিঃপ্রকাশ নাকি দাড়ি আর গোঁফে। কিন্তু লাওসে দেখছি ভিন্ন। এ দেশের পুরুষদের দাড়ি-গোঁফ কিছুই নেই। হয় না। চীন ও ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত লাওশিয়ান পুরুষদের কারও কারও থুতনিতে কিছু লম্বা দাড়ি থাকলেও আদি অধিবাসী যারা, সৃষ্টির অজানা কারণে তাদের দাড়ি-গোঁফ নেই। হাজারে একজন পুরুষের দাড়ি-গোঁফ জন্মালে তাকে অত্যন্ত লাজুক অবস্থায় সমাজে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে থাকতে হয় এই দাড়ির কারণে।

যাঁদের প্রতিদিন সকালে দাড়ি-গোঁফ শেভ করার অভ্যাস, তাঁরা লাওসে বেড়াতে এলে সঙ্গে শেভিং ফোম আর আফটার শেভ লোশন আনতে ভুলবেন না। কারণ, এখানে এগুলো পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যার ভুক্তভোগী আমি নিজেই।

মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া অন্যদের সঙ্গে ইংরেজিতে যোগাযোগ অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার এখানে। সুতরাং এ দেশে আসার আগে সম্ভব হলে শিখে নিন কিছু প্রয়োজনীয় বাক্য ও শব্দ। যেমন

হ্যালো—‘সাবাইডি’।
আপনার নাম কী—‘চাও সু ইয়াং’।
আমার নাম ...—‘খয় সু ...’।
প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন—‘কালুনা ছুয়াই খয়’।
কোথায় যাবেন—‘পাই ছাই’।
হোটেল কোথায়?—‘হং হ্যাম ইউ ছাই’।
কাঁচা বাজারে যাব—‘পাই তালাত খোয়াডিন’।
তুমি কি ইংরেজি বলতে পারো—‘ফুট ফাছা আংকিত ওয়াও ডাই ব’।
তুমি কী করো—‘চাও হেড নিয়াং’।
আমি একজন ট্যুরিস্ট—‘খয় নাক থিয়াও’।
শুভ বিদায়—‘শোক ডি’।
রেস্টুরেন্ট কোথায়—‘হান আহান ইউ ছাই’।
অনেক ধন্যবাদর–‘খব চাই লাই লাই’।
প্লিজ মেনু দাও—‘খ লাইকান আহান ডেহ’।
আমি শূকরের মাংস খাই না—‘খয় কিন মু বডাই’।
ফ্রাইড রাইস উইথ চিকেন—‘খাও ফাত কাই’।
ফ্রাইড মিক্সড ভেজিটেবল—‘ফাত ফাক’।
রাইস স্যুপ উইথ চিকেন—‘খাও পিয়াক কাই’।
তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল—‘ডি লাই থি ফোপ কান চাও’।
আবার দেখা হবে—‘ল্যাও ফোপ কান চাও’।
টাকা নেই—‘বমি গান’।
বাজার যেতে ভাড়া কত—‘পাই তালাত থাও ডাই’।
কোনো সমস্যা নেই—‘বমি বানহা’।

‘ব পেন ইয়াং’ এখানে বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য, যার ভাবার্থ নেভার মাইন্ড বা কোনো সমস্যা নেই। চেষ্টা করুন, শিখে যাবেন শিগগিরই।

রাস্তার ধারে বিক্রি হয় এসব খাবার। ছবি: লেখক
রাস্তার ধারে বিক্রি হয় এসব খাবার। ছবি: লেখক

নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নানা ধরনের বিভ্রাট হতেই পারে। যেমন হয়েছিল আমার বেলায়। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, কী সেই বিভ্রাট? প্রথম যখন এ দেশে এলাম, সবকিছুই এলোমেলো অর্থাৎ খাবারদাবার থেকে শুরু করে কেনাকাটা—কোনোটিই সুবিধামতো চলছিল না। কেবল ভাষা না জানার কারণে।

কথায় বলে, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী, কথায় কথায় ডিকশনারি। দু-চারটি শব্দ শিখেছি মাত্র। ওই বিদ্যা নিয়ে এক দিন বাজারে গেলাম মাছ, সবজি ও রান্নার কিছু মসলাপাতি কেনার জন্য। লবণ কিনতে গিয়ে দোকানিকে বললাম, ‘আউ ফুয়া’ (লবণ দাও)। লবণ না দিয়ে দোকানি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলাম লবণ।

পরদিন অফিসে জানলাম, ‘ফুয়া’ মানে স্বামী। আর ‘কুউয়া’ মানে লবণ।

আরেক দিনের কথা। দোকানে গেলাম দুধ কেনার জন্য। বললাম, ‘আউ তাও নম’।

দোকানের তরুণী বিক্রেতা হা করে আমার দিকে চেয়ে থাকল অবাক হয়ে। তবে বিদেশি হিসেবে বিষয়টি বেশি দূর যাওয়ার আগেই দোকানি বলল, ‘খ থোট, বমি নোম’ (সরি, দুধ নেই)। আবার হাতে দেখিয়ে দিলাম, এই তো দুধ। অনেক বিরক্ত হয়ে সে দুধ দিল। পরে জেনেছিলাম, ‘তাও নম’ মানে হচ্ছে স্তন।

আরেকটা উদাহরণ দিয়ে ভাষাবিভ্রাট প্রসঙ্গ আপাতত শেষ করছি। বমি বানহা (নো প্রবলেম) বাক্যটা বেশ প্রচলিত এখানে। আমার এক বন্ধু তার অফিস সেক্রেটারিকে কথা প্রসঙ্গে ভুলে বলেছিলেন, ‘বমি তানহা’।

সেক্রেটারি বিষয়টা হালকা করার জন্য বলে, তোমার কি গার্লফ্রেন্ড দরকার?

বন্ধু বলেন, এ কথা বলছ কেন?

সেক্রেটারি হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি জানো, ‘বমি তানহা’ মানে কী?

আমার বন্ধু বলেন, জানি। বমি তানহা মানে নো প্রবলেম।

সেক্রেটারি এবার গম্ভীর হয়ে বলে, ভুলেও এ কথা আর কাউকে বলবে না। বমি তানহা মানে হচ্ছে যৌনমিলনে আপত্তি নেই।

তাহলে বুঝতেই পারছেন ভাষাবিভ্রাট জিনিসটা কী এবং কত প্রকার।

পোকার লার্ভা। ছবি: লেখক
পোকার লার্ভা। ছবি: লেখক

পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে এখানে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ রয়েছে। চালু আছে বয় ও গার্লফ্রেন্ড শব্দ দুটির জনপ্রিয় ব্যবহার। এখানে সুযোগ রয়েছে খণ্ডকালীন বিয়ে করার। তিন মাস, ছয় মাসের চুক্তিতে বেতন ও ভরণপোষণের ভাতা দিয়ে একজন প্রবাসী চাইলে এ দেশীয় নারীকে বিয়ে করতে পারেন। চুক্তি শেষে দেনাপাওনা মিটিয়ে দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে বাধা নেই।

এটা রাষ্ট্রীয় আইনে সম্ভবত স্বীকৃত নয়। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতায় এমন সিদ্ধান্ত নিতেও বোধ হয় বাধা নেই। এমন ঘটনার কথা শোনা যায় ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে।

এ দেশের লোক কষ্টসহিষ্ণুতার পাশাপাশি দারুণ ফুর্তিবাজ। আমাদের প্রকল্পের এক ঠিকাদার রাস্তার কাজ উদ্বোধন উপলক্ষে একবার অনেক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন। বেশ বড় আয়োজন। প্রায় ৫০০ লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা।

এখানে অধিকাংশ অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার পর নারী-পুরুষ সবাই মিলে নাচগান আর বিয়ার-মদ পান করে। এটা এদের সংস্কৃতির একটি অংশ।

শূকরের মাংস এ দেশের লোকদের আমিষের প্রধান সরবরাহকারী ও একটি প্রিয় খাদ্য। প্রায় সব উপভোগ্য ও সুস্বাদু খাদ্যের সঙ্গে শূকরের মাংসের সংমিশ্রণ একটি সাধারণ বিষয়। তাই আমরা আগেই বলে রেখেছিলাম, আমাদের জন্য আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য।

আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল বটে, তবে তা দুরস্থ করা ততটা সহজ ছিল না। চামড়াসহ আস্ত দুটি গরু গ্রিল করার আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে। পশুর লোম আর চামড়া পোড়ার দুর্গন্ধে চারদিকে যখন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ, তখন স্থানীয় লোকজন দারুণ উপভোগ করলেন ওই আয়োজনকে।

একসময় খাবার তৈরি হয়ে গেল। চামড়াসহ গ্রিল করা গরুর মাংস খণ্ড খণ্ড করে কেটে পরিবেশন করা হলো। গরুর মাংস ও গরুর আধা সিদ্ধ নাড়িভুঁড়ি খাওয়া আর বিয়ার–মদ পানে যখন স্থানীয় লোকজন মহাখুশিতে মশগুল, তখন আমরা প্রহর গুনছিলাম কতক্ষণে এ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না।

যেহেতু অনুষ্ঠানে আমরা ছিলাম প্রধান আমন্ত্রিত অতিথি, তাই শেষ অবধি সেখানে থাকাটা ছিল অত্যাবশ্যক। খাওয়াদাওয়া শেষে নাচ আর গানের পালা। স্থানীয় অফিসের অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী গাইতে ও নাচতে অভ্যস্ত থাকায় তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল নিতান্ত সাধারণ। কিন্তু আমরা পড়লাম সমস্যায়।

আমার টিম লিডার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান নোয়েল জোসেফ। তাঁর স্ত্রী প্রিন্সি ও আমার স্ত্রী মনিকাও যোগ দিয়েছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। গাইতে না পারলেও বৃত্তাকার নৃত্যে (লাও লামভং নৃত্য) অংশ নিতে হয়েছিল আমাদের সবাইকে। এ ধরনের নাচে বৃত্তাকার হয়ে এক সারিতে পুরুষেরা আর অন্য সারিতে নারীরা দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে মুখ রেখে হাত দুলিয়ে বাজনার তালে তালে বৃত্তাকারে চলমান পথে নাচতে থাকেন অনেক সময় ধরে।

অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথি থাকলে তাঁদের খুব সম্মান করা হয়। বিদেশিদের স্থানীয় নারীদের সঙ্গে নাচার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের পুরো সময়জুড়ে থাকে বিয়ার ও মদ পানের প্রতিযোগিতা। শেষ ভাগে এসে তা বৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ হারে। কে কত পরিমাণ বিয়ার পান করলেন, তার অনানুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেওয়া হয় মজা করার জন্য। তবে অধিক মদ্যপান করে মাতাল হয়ে আবোলতাবোল বকা বা মাতলামি করার তেমন উদাহরণ নেই বলা যায়।

লাওসের লোকজন সাধারণত স্টিকি রাইস (খাও নিয়াও) ও বিভিন্ন ধরনের রাইস নুডলস স্যুপ, যেমন রাইস নুডলস স্যুপ উইথ ভেজিটেবল অ্যান্ড মিট বা লাও ভাষায় যাকে বলে ‘ফোও’ খেতে ভালোবাসে। এ ছাড়া নানা ধরনের মিষ্টান্ন এদের প্রিয় খাবার। ইঁদুর গ্রিল করা, বন্য পোকামাকড়ের লার্ভা, যেকোনো ধরনের বন্য জীবজন্তুর মাংস এদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে।

একবার লাওসের উত্তরে পাকলাই জেলা থেকে প্রাদেশিক শহর ছায়াবুরির দিকে যাচ্ছিলাম। পথে এক জায়গায় পোকার লার্ভা বিক্রি হচ্ছে। ড্রাইভার থংছইকে বললাম, এগুলো কি তোমরা খাও?

ড্রাইভার জানাল, হ্যাঁ, এগুলো আমাদের খুবই পছন্দের খাবার। কিন্তু আমরা কিনতে পারি না, দাম অনেক বেশি।

জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এখন এগুলো নেবে?

ড্রাইভার বলল, বমি গান (টাকা নেই)।

লেখক
লেখক

পরে ৪৮ হাজার কিপ (লাওসের মুদ্রার নাম কিপ, সে সময় ১ মার্কিন ডলার সমান ৮ হাজার কিপ পাওয়া যেত) বা ৬ মার্কিন ডলারে ড্রাইভারকে আধা কেজি কিনে দিলাম। মনে হলো সে স্বর্গ হাতে পেল। আমারও খুশি লাগল ড্রাইভারের চোখেমুখে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখে।

ব্যাঙ, শামুক, তেলাপোকা, ঘুগরিপোকা, মাকড়সা, কাঁকড়া, পানিতে বসবাসকারী নানা ধরনের পোকামাকড়—কোনো কিছুই এদের খাবারতালিকা থেকে বাদ পড়ার সুযোগ পায়নি। আপনার পাশে বসে সুন্দর চেহারার একজন তরুণী যখন এই খাবারগুলো মজা করে খাবে, তখন আপনার কেমন লাগবে বলুন তো? এমন খাবার পেলে এরা নিঃসন্দেহে বলবে, ‘স্যাব লাই’ (দারুণ সুস্বাদু)। যদি পছন্দ হয়, আপনিও ওদের সঙ্গে সুর মিনিয়ে বলতে পারেন, ‘ম্যান স্যাব লাই’ (হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দারুণ সুস্বাদু)।

কয়েক বছর আগের কথা। আমার এক বাংলাদেশি বন্ধু লাওসের লুয়াংপ্রাবাং প্রদেশের গভীর জঙ্গলের পাশে উপজাতীয় এলাকায় রাস্তার কাজ শেষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলেন। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকের চেয়ে যাঁরা রাস্তা তৈরি করেছেন, তাঁদের মূল্য উপজাতীয়দের কাছে ছিল অনেক বেশি। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে উপজাতীয় প্রধান আমার বন্ধু ও তাঁর সহকর্মী ওই দেশীয় লোকজনকে নিরাপত্তার কারণে রাতে সেখানে থাকতে অনুরোধ জানালেন।

নির্জন গভীর জঙ্গলের পাহাড়ি পথে রাতে আসলেই যাওয়া সম্ভব ছিল না। থাকা–খাওয়া চমৎকার না হলেও আপ্যায়ন হৃদ্যতার কমতি ছিল না। বন্ধু ও তাঁর সহকর্মী সবার জন্য একই ঘরে মেঝেতে ঘুমানোর আয়োজন। বন্ধু ঘুমাতে যাবেন, এমন সময় দেখতে পেলেন সেখানে এক উপজাতীয় তরুণীর উপস্থিতি। বন্ধু অবাক হয়ে এবং অনেকটা ভীত হয়ে উপজাতীয় প্রধানকে ডেকে জানতে চাইলেন, এই তরুণী কে, এখানে কেন?

হাসতে হাসতে উপজাতীয় প্রধান বললেন, ভয়ের কিছু নেই। এ আমার কন্যা। সে রাতে তোমাদের ঘরে পাহারা দেবে। অতিথিকে আমরা একা থাকতে দিতে পারি না। এতে আমাদের অপমান হবে। তোমরা আমাদের সম্মানিত অতিথি, সুতরাং তোমাদের সেবা করা আমাদের কর্তব্য।

বন্ধু ভাবলেন, এ কোন বিপদে পড়া গেল। দেশীয় সহকর্মীকে ডেকে বললেন, এখন উপায় কী?

সহকর্মী বললেন, এটা কোনো সমস্যা হলো নাকি! সে পাহারা দেবে এ তো ভালো কথা, নিরাপদে ঘুমাতে পারবে। এত কিছুর পরও দুশ্চিন্তায় বন্ধু সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না।

ভোরবেলা তরুণী সবাইকে শোকডি (শুভ বিদায়) বলে চলে গেল। শেষ)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন