ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: মুগ্ধ হওয়ার দেশ লাওস

ভিক্ষুদের সামনে ভক্তরা। ছবি: লেখক
ভিক্ষুদের সামনে ভক্তরা। ছবি: লেখক

ইনডি তনহাব (স্বাগতম)। চাও সাবাইডি ব (কেমন আছেন)। নতুন অতিথির আগমনে এ ধরনের অভিবাদন জানানো ও কুশল জানতে চাওয়া লাওসের জনগণের শিষ্টাচারের একটি অংশ।

তবে এ দেশের মানুষের ভাব প্রকাশের অভিব্যক্তি নিঃসন্দেহে কিছুটা ভিন্ন ও হৃদয়গ্রাহী। প্রথম দর্শনেই যে কেউ স্বস্তি অনুভব করবেন সাধারণ মানুষের শান্তশিষ্ট স্বভাব ও বিনয়ী কথাবার্তায়। বিমানবন্দর, হোটেল, গেস্টহাউস, রেস্টুরেন্ট বা বাজার, যেখানেই যাবেন সংশ্লিষ্ট সবার সেবার মানে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।

কাজের সূত্রে আমি এ দেশে অনেক দিন থেকেছি। বিমান, ট্রেন ও বাস থামার আগেই বসার আসন থেকে উঠে ব্যাগ নিয়ে টানাহেঁচড়া, বাস বা ট্রেনের টিকিট লাইনে অথবা আসনের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, কারণে-অকারণে ঝগড়াঝাঁটি—এসব এ দেশে আমার নজরে পড়েনি।

বিভিন্ন দেশে নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পর যাঁরা এখানে এসে কাজ করছেন, তাঁরা এক বাক্যে এ দেশের জননিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, সমাজব্যবস্থা ও জনগণের সার্বিক আচরণের প্রশংসা না করে পারবেন না।

দেশটি সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করা যাক। লাওস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আশিয়ানভুক্ত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার আগে পৃথিবীতে অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল। বর্তমানে যে কয়টা সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে লাওস তার মধ্যে একটি।

ওয়াট থাটলুয়াং মন্দির। ছবি: লেখক
ওয়াট থাটলুয়াং মন্দির। ছবি: লেখক

লাওসের আয়তন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার। দেশের নাম ‘লাও পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক’। এদের ভাষায় ‘ছাথালানালাত পাকছাথি পাথাই পাকছা ছন লাও’। রাজধানী ভিয়েনতিয়েন। স্থানীয়রা বলেন ভিয়েনচান।

দেশটি দীর্ঘ সময় ফ্রান্সের অধীনে ছিল। ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির উত্তরে চীন, দক্ষিণে কম্বোডিয়া, পূর্বে ভিয়েতনাম এবং পশ্চিমে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার।

দেশটিতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু আছে। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান।

জনসংখ্যা ৭০ লাখ ১৯ হাজার ৭৩ জন (৩৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৮৬ জন নারী ও ৩৪ লাখ ৯১ হাজার ২৮৭ জন পুরুষ)। শিক্ষিতের গড় হার ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ।

সরকারি ভাষা ‘লাও’। এ ছাড়া ফরাসি, ইংরেজি ও অনেক উপজাতীয় ভাষা এখানে চালু আছে। তবে ইংরেজিতে

লাওসের নারী। ছবি: লেখক
লাওসের নারী। ছবি: লেখক

কথা বলতে ও লিখতে পারেন এ রকম জনসংখ্যা খুবই কম। তাই যাঁরা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য এ দেশে আসবেন, তাঁরা কিছুটা লাও ভাষা শিখে নিলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা ও বাজারঘাট খুব স্বচ্ছন্দে করা সম্ভব হবে।

রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি পোশাক, কাঠ থেকে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের আসবাব ও অন্য সামগ্রী, কফি, জলবিদ্যুৎ, অলংকারের জন্য বিভিন্ন মানের ও রঙের মূল্যবান পাথর, সোনা ইত্যাদি।

আয়ের আরেকটি ক্রমবর্ধমান বড় উৎস হলো পর্যটনশিল্প। পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ চলাফেরা, থাকা, খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সরকার যেমন সজাগ, সাধারণ মানুষও সহযোগিতার হাত বাড়ায় তাদের দেশের স্বার্থে।

সারা দেশ পাহাড়ে পরিপূর্ণ। কৃষিযোগ্য ভূমির পরিমাণ মাত্র ১৮ হাজার ৯৪৪ বর্গকিলোমিটার। বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৩৪ বর্গ কিলোমিটার। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়-পর্বত জালের মতো ছড়িয়ে আছে। উঁচু-নিচু সবুজ গাছপালা আর নানা ধরনের লতাপাতায় আবৃত পাহাড়গুলো পর্যটকদের দৃষ্টিকে প্রশান্তি দিতে কোনোই কার্পণ্য করে না।

প্রধান নদনদীর মধ্যে রয়েছে মেকং (লাও ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ম্যা নাম খং’)। মেকং নদী চীনের তিব্বতে মাউন্ট গুয়োজংমুচার লাসাগোংমা মালভূমি অঞ্চলে উৎপত্তি স্থল থেকে বেরিয়ে মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া হয়ে ভিয়েতনামের হোচিমিন বা সায়গন শহরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর অবধি মোট ৪ হাজার ৩৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ।

এর মধ্যে লাওসের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলপথ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার। এর শাখা নদীগুলো যেমন নামগুন, নামথুন, নামহিনবুন, সিবাংফাই, সিবাংহিয়াং, ছেকং ও সিডন।

লাওসের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ও জাতীয় অর্থনীতিতে নদীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। তবে সারা দেশ পাহাড় পর্বতের জালে আবদ্ধ হওয়ার কারণে এসব নদীর পানি দেশের অধিকাংশ এলাকাতে পৌঁছার কোনো সুযোগ নেই। ফলে উঁচু ভূমিতে পানীয় জলের প্রকট অভাব।

আমি দেশটির দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তা অতিক্রম করেছি গাড়িতে। পথের দুই ধারে কেবল সবুজ ছোট-বড় গাছপালায় আবৃত উঁচু-নিচু পাহাড় আর পাহাড়। আর অবাক হওয়ার বিষয়, এই পাহাড়ি বনভূমিগুলোতে বন্য পশুপাখির উপস্থিতি নেই বললেই হয়।

এর পেছনে দুটি কারণ আছে বলে অনুমান করা হয়। প্রথম কারণ, বন্য পশু-পাখির জন্য নিরাপদ জলাশয়ের অভাব। দ্বিতীয় কারণ এ দেশের লোকজন পিঁপড়া থেকে শুরু করে সকল ধরনের বন্য জীবজন্তু শিকার করে খেতে অভ্যস্ত।

৩০-৪০ কিলোমিটার পরপর মাঝে মাঝে ১০ থেকে ১৫ পরিবারের একটি ছোট গ্রাম গড়ে উঠেছে কোনো পাহাড়ি ঝরনা বা ছোট নদীকে কেন্দ্র করে। পানির অভাবে দারুণ কষ্টের জীবন তাদের।

এখানকার সমাজব্যবস্থায় অফিস সময়ের পর অফিসের বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন, ড্রাইভার, দারোয়ান সবার সামাজিক মূল্যবোধ সমান। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসে তাদের খাওয়া দাওয়া, পানাহার ও সময় উপভোগ করতে বাধা বা সংকোচ কোনোটাই নেই।

অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এরা ‘থান’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। নিজের ভাষা ছেড়ে স্যার শব্দ ব্যবহারে আগ্রহ নেই একেবারে। বেতনের অনেক ফারাক থাকলেও একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা অন্য কর্মকর্তা কাজ তদারকির জন্য কর্মস্থল থেকে দূরে গিয়ে রাত যাপন করলে দৈনিক যে ভাতা পান, তার সঙ্গে থাকা গাড়িচালক বা অন্য কর্মচারীরাও সমপরিমাণ ভাতা পান।

এর পেছনে যুক্তি হলো, মানুষ হিসেবে সবার থাকা-খাওয়ার জন্য সমান সুযোগ পাওয়া আবশ্যক। অনেকে হয়তো বলবেন লেখাপড়া করে একজন চিকিৎসক হতে যে কষ্ট, অল্প লেখাপড়া করে একজন ড্রাইভার হতে নিশ্চয়ই একই কষ্ট নয়। মেধার পার্থক্য তো আছেই। এ ছাড়া সবার থাকা-খাওয়ার মানদণ্ড এক নয়। তাদের কাছে এই ব্যবস্থা জুতসই মনে হবে না। কিন্তু এটাই এখানকার বাস্তবতা।

এ দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ অধিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সমাজে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনেক কদর। বাতাস ছাড়া যেমন গাছের পাতার স্পন্দন হয় না, তেমনি ভিক্ষুদের উপস্থিতি ছাড়া সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে পূর্ণতা আসে না।

এমনও দেখেছি, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর জনসভা মঞ্চে প্রবীণ ভিক্ষুদের আসন নির্ধারিত রাখা হয়। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করার আগে ভিক্ষুদের সামনে করজোড়ে উপবিষ্ট হয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।

প্রতিদিন সকালে প্রভাতি প্রার্থনার পর ভিক্ষুরা খাবারের পাত্র নিয়ে জনপদে বেরিয়ে পড়েন খাদ্য সংগ্রহের জন্য। কারণ তাঁদের উপাসনালয়ে খাদ্য পাকের কোনো বিধান নেই।

জনসাধারণ অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে ভিক্ষুদের বিভিন্ন খাবার দেন। সেই খাবারই তারা খান। শহর-বন্দর ও গ্রামগঞ্জে সর্বত্র বিরাট এলাকাজুড়ে একেকটা করে প্যাগোডা বা বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এই উপাসনালয়কে বলা হয় ‘ওয়াট’। কিছু কিছু মন্দির ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত।

এ রকম একটি ওয়াট বা মন্দির রয়েছে লাওসের রাজধানীতে, যার নাম ‘ওয়াট থাটলুয়াং’। কিছুদিন আগে একদিন ওই মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। এর বাইরের দৃশ্যমান পুরো অংশই সোনালি রঙে ঢাকা। কথিত আছে, প্রথম ১৫৫৬ সালে যখন এটি তৈরি করা হয় তখন সোনার পাতে বাহিরটা মোড়ানো ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় বহিরাগত দখলদার বাহিনী সোনার পাতগুলো সরিয়ে ফেলে।

আগের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর নভেম্বর মাসে ধর্মীয় সম্মেলন উপলক্ষে এটি নতুন করে সোনালি রঙে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই মাসে সপ্তাহব্যাপী বার্ষিক প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জমায়েত হন। ভক্তরা অকৃপণ হাতে সাধ্যমতো অর্থ দান করেন সমাগত ভিক্ষুদের ও মন্দির উন্নয়নের কাজে।

নারী জাগরণ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো চলছে নানা আঙ্গিকে আন্দোলন। চলছে এ বিষয়ে আইনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন। কিন্তু লাওসে কী অবস্থা? এরা বেগম রোকেয়ার লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বিষয়ে জানেন না। আসলে জানারও দরকার পড়েনি। কতকাল আগে থেকে এখানে নারীদের অঘোষিত রাজত্ব চলছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে যা সত্য তা হলো, শত-সহস্র বছর আগেই ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে এখানে। বিশেষত লাওসে।

এ দেশে পাত্রীকে বিয়ের পর পাত্রের বাড়িতে যেতে হয় না। বরং পাত্রকেই বিয়ের পর পাত্রীর গৃহে আজীবনের জন্য চলে যেতে হয়। তাই এ দেশকে নারীস্থান বললেও অতিরঞ্জিত কিছু বলা হবে না। দাপ্তরিকভাবে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক প্রশাসনে নারীদের ক্ষমতা ও ভূমিকা আলাদা করে কিছু লিপিবদ্ধ নেই বটে, তবে বাস্তবে হাটবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি।

এ প্রথা পুরুষ সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত। এখানকার সমাজ ব্যবস্থায় মাতৃতন্ত্রের সুবাস প্রবাহিত অনেক আগে থেকেই। পুরুষেরা যত হম্বিতম্বি করুন না কেন, নারীর আদেশ অন্য কথায় সংসারে স্ত্রীর আদেশ স্বামী ও পরিবারের অন্য সবার জন্য পালন করা অঘোষিত আইন বলা চলে। বেগম রোকেয়া নিজ দেশে সুলতানার স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখে যেতে না পারলেও এ দেশে পুরুষের ওপর নারীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে অনেক যুগ আগে থেকে।

এখানে সব সহায় সম্পত্তির আইনানুগ উত্তরাধিকারী নারী। মায়ের সম্পত্তির দাবিদার মেয়েরা, ছেলেরা নয়। স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর ভরণপোষণ হয় সুতরাং স্বামীর নামে আলাদা সম্পত্তি আবশ্যক নেই। যেসব স্বামী চাকরি করেন, মাস শেষে স্ত্রীর কাছে বেতনের টাকাটা কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দেওয়াটা জরুরি। বিয়ের পর স্বামী তাঁর স্ত্রীর বাড়িতে অর্থাৎ শাশুড়ির আশ্রয়ে বাকি জীবন থাকবেন, এটাই এখানকার সমাজ অনুমোদিত রীতি। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী বা অন্য যেকোনো পেশার পুরুষ হন না কেন, নিয়ম অভিন্ন।

ছেলেরা বিয়ের বয়সপ্রাপ্ত হলে মা-বাবার সংসারে থাকার অধিকার ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে এবং একসময় মনের অজান্তে ছেলেদের বাড়তি বোঝা মনে করা হয়। ছেলেদের নিজের বিয়ের ও সংসার চালানোর জন্য অর্থ উপার্জন করার পথ বের করে তবেই বিয়ের কথা ভাবতে হয়। এখানে নারীদের পরার সুন্দর পোশাকের নাম ‘ছেন’। একই রং ও ডিজাইনের জামা ও পায়জামা সঙ্গে ওড়না। তবে এখন আধুনিক হাওয়ায় অনেকে বিশেষত তরুণীরা এখন সংক্ষিপ্ত পোশাক পরতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

যৌতুক প্রথা এখানে সমাজস্বীকৃত ও অনেকটা খোলামেলা। তবে তার গতিপথ একটু ভিন্ন। ছেলেপক্ষকে পাত্রীকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে করতে হয়। পাত্র-পাত্রী একেবারে গরিব পরিবারের হলে হবু স্ত্রীকে সাধ্যমতো গয়নাগাটির সঙ্গে একটা বাইসাইকেল দেওয়া জরুরি। এর পরের ধাপে মোটরসাইকেল এবং ধনী পরিবারের বর হলে হবু স্ত্রীকে গয়নাগাটির সঙ্গে গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি যৌতুক দিতে হয়। সুতরাং পাত্রীর মা-বাবা এখানে কন্যাদায়গ্রস্ত নন। ছেলেরাই বরং দিশেহারা। যার কন্যাসন্তান যত বেশি, তিনি তত ভাগ্যবান। কারণ যৌতুকের পরিমাণটা এতে বাড়তেই থাকবে। এখানকার সাধারণ ঘরের মেয়েরা দারুণ কর্মঠ ও একটি সংসার ঘরে-বাইরে চালানোর জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বামীর উপার্জনের অর্থ দিয়ে নয় বরং নিজের চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আয় হতে চলবে সংসার।

গ্রামাঞ্চলে ঘরের বাইরের সব কাজ যেমন মাঠে কৃষিকাজ, নদীতে মাছ ধরা, বাজারে ব্যবসা পরিচালনা করা সবই নারীরা করে থাকেন। শহুরে পুরুষেরা চাকরি ও ব্যবসাপাতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও গ্রামাঞ্চলের পুরুষেরা বাচ্চাকাচ্চা পালন ও গৃহকর্মেই অধিক সময় ব্যস্ত থাকেন। এটাই এখানকার প্রতিবাদবিহীন সামাজিক রীতি।

হাতি উৎসব। ছবি: লেখক
হাতি উৎসব। ছবি: লেখক

কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সেটা ছোট বা বড় যা-ই হোক, পরিচালনা ও মালিকানার মুখ্য দাবিদার নারী। স্ত্রীর পাশে স্বামী, মায়ের পাশে ছেলে (ছেলের বিয়ের আগ পর্যন্ত), মায়ের সঙ্গে মেয়ে প্রায় সব ব্যবসা-বাণিজ্যেই জড়িত আছেন বা থাকেন। তবে মুখ্য মালিক হিসেবে নয়, সহযোগী হিসেবেই। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসার প্রধান আসনটি নারীর দখলেই থাকে। ব্যবসার হিসাব-নিকাশ ও অর্থ লেনদেন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় নারী কর্তৃক। এক কথায় ব্যাপারটা আমাদের দেশের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

লাওসকে ‘ল্যান ঝাং’ বা ল্যান্ড অব মিলিয়ন এলিফ্যান্ট (শত সহস্র হাতির দেশ) বলা হয়। কারণ এক সময় এখানে লাখ লাখ হাতির বসবাস ছিল। এখনো দেশের উত্তর অঞ্চলের কিছু কিছু প্রদেশ যেমন ছায়াবুরি, লুয়াংপ্রাবাং ও হুয়াফানের সংরক্ষিত এলাকায় বন্য হাতি আছে। প্রতিবছর দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ছাইয়াবুরি প্রদেশের হংছা জেলায় হাতি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। লাওস ছাড়াও থাইল্যান্ড, মিয়ানমার থেকে অনেক হাতি এবং উৎসাহী দর্শকের আগমন ঘটে এই মেলায়।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে লাওসে বন্য হাতির সংখ্যা প্রায় ৪০০টি এবং গৃহপালিত হাতির সংখ্যা ৪৫০টি। গৃহপালিত হাতিগুলো সাধারণত দুর্গম পাহাড়ি এলাকাতে ভারী কাঠের লগ টানার কাজে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়। সংরক্ষিত এলাকায় বন্য হাতি বিদেশি পর্যটকদের জন্য দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

হাতির দৌড়, লড়াই, হাতি দিয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল প্রদর্শন ও হাতি দিয়ে কীভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে ভারী কাঠের গুঁড়ি স্থানান্তর করা হয়, এসব মেলাতে দেখা যায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুরস্কৃত করা হয় সেরা হাতি ও তার মালিককে।

হাতি প্রদর্শনী মেলা ছাড়াও লাওসের অধিবাসীরা বছরে অনেকগুলো উৎসব পালন করে থাকেন। এ সব উৎসবের কিছু কিছু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিছু উপজাতীয়দের একক উৎসব। বাকি কিছু উৎসব সারা দেশে পালন করা হয়। (চলবে)