মাতৃভাষা অবহেলিত নয় আদৃত

মাতৃভাষা অবহেলিত নয় আদৃত
মাতৃভাষা অবহেলিত নয় আদৃত

ভাষার ‘মার্কেট ভ্যালু’ বা বাণিজ্যিক মূল্য নিয়ে বৈষয়িক মানুষ যারা, তারা মাথা ঘামাক। ভাষাকে ভালোবাসে যারা, তারা মাথা ঘামাবে নিজ ভাষার সৌন্দর্য এবং ওই ভাষার শক্তি ও ঐশ্বর্য নিয়ে।

যেমন শতবর্ষ আগে ‘যখন বঙ্গভাষা (বাংলাভাষা) রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মান লাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে কেবলমাত্র মাতৃভাষা’ (বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে বিশ্বকবির এই ভাষ্য উদ্ধৃত করেছেন) জেনেও মাথা ঘামিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভাষাকে ভালোবেসে তাকে ঐশ্বর্যময় করেছেন, বিশ্বসভায় পরিচিত করে সম্মাননা অর্জন করেছেন, বাংলা ভাষীদের গর্বিত করেছেন তিনি।

অতুল প্রসাদ তখন লিখলেন—

‘এই ভাষাতে বাজিয়ে বিনে
আনলো রবি জগৎ ছিনে’। (উৎস: মোদের গরব মোদের আশা)

আমরা বাংলা ভাষীরা আবেগে খ্যাপাটে ধরনের কিছুটা। আমরা ভাষার জন্য অনেক কিছু করতে পারি, এটি একটি প্রমাণিত সত্য। প্রাণও দিয়েছি তার সাক্ষ্য বহন করেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারির ২১ আমাদের চেতনায় প্রজ্বালিত করে মাতৃভাষার আলো ছড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রদীপ, ২১ ফেব্রুয়ারি জোগায় নিজ মাতৃভাষায় বিকশিত হওয়ার অন্তহীন অনুপ্রেরণা ও আশা।

বিদেশে যাঁরা থাকেন, সেই বাঙালিরা এই আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকে বাংলা স্কুল খোলেন, বাংলা সাহিত্য সভা করেন, বাংলা পত্রিকা চালান, বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করেন। এ ছাড়া এখন পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইটও আছে। তবে কাজটা তত সোজা নয়। স্কুলের জন্য ছাত্র চাই। সাহিত্যসভার জন্য সাহিত্যপিয়াসী মানুষ চাই। পত্রিকা পড়ার জন্য পাঠক চাই।

এত উদ্যম–উৎসাহের পর আরও একটি জিনিস চাই, তা হলো সমালোচনা সহ্য করার শক্তি। বাংলা ভাষা বা যেকোনো মাতৃভাষাকে বিদেশে বাস করে অনবরত চর্চা করে যাওয়া ও শেখানোর চেষ্টা করা সোজা বিষয় নয়। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও কানাডা সব জায়গায়ই সচেতন মা-বাবা চেষ্টা করেন ঘরে নিজ ভাষার চর্চা করতে। উল্লিখিত দেশগুলোর বাংলা স্কুলগুলোতেও চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের সব কর্ম খুব সফল বা খুব ব্যর্থ বলা যাবে না।

ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়তে শিখবে, এতটা আশা মা-বাবা বা বাংলা স্কুলের শিক্ষক করেন কি না, জানা নেই। বাংলায় পণ্ডিত না হোক, অক্ষরগুলো চিনবে ও বাংলা ভাষায় কোথাও কিছু লেখা থাকলে গড়গড়িয়ে পড়তে না পারলেও, অক্ষর দেখে বুঝতে পারবে এটি বাংলায় লেখা, এইটুকু আশা করা যায় অন্তত।

বিদেশে বাংলা স্কুলের অনুষ্ঠান দেখে কেউ কেউ হতাশ হয়ে বলেন, ‘ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা দেখে দেখে বাচ্চারা সব পড়ছে বা করছে দেখলাম। স্কুল কী শেখায় বুঝতে পারলাম না।’

আরেকজনকে বিরক্তি নিয়ে বলতে শুনলাম, ‘বাংলাতে পুরস্কার পাওয়া শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করে চিঠি লিখেছে, তা–ও ইংরেজিতে, কী আশ্চর্য!’

এসব পর্যবেক্ষণ বানানো নয়, ভান নয়, মিথ্যা নয়। বাচ্চারা কিছুটা শেখে। সব হয়তো ভিনদেশে বাস করে তত ভালো করে শেখানো সম্ভব হয় না।

বহু ভাষাবিদ ও ভাষাবিশেষজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ার প্রফেসর ইমেরিটাস মাইকেল ক্লাইন বলেছিলেন, একটার বেশি ভাষা বাচ্চাকে শেখালে তার (Cognitive ও Academic) বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ভালো হয়। আরেকজন ভাষাবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, বাচ্চাদের সামনে ইংরেজি (ইংরেজি ভাষার দেশে যাদের বাস) বইপত্রের পাশাপাশি নিজ ভাষার বই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখলে তার চোখেও পড়বে, কৌতূহলী হবে।

কৌতূহল জাগলে প্রশ্ন করবে, এতে সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণলব্ধ মতামত সত্যিই বলা যায়।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার টিভির চ্যানেল নাইনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রোগ্রামে একটি চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

তথ্যটি দ্বিভাষিক মানুষকে ভাবাবে। ভাষা বিষয়ে উৎসাহিত করবে। মেলবোর্নের বিখ্যাত স্কুল মেলবোর্ন বয়েজ হাইস্কুলে ভর্তি হতে সফল হয় যারা, তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ ছাত্রের ইংরেজি হচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা। সিডনির নামকরা সিডনি জেমস রু কলেজের ভর্তি হতে সফলদের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী হচ্ছেন বাইলিঙ্গুয়াল বা দ্বিভাষিক। ইংরেজি এদের দ্বিতীয় ভাষা। মাইকেল ক্লাইনের বক্তব্যের সত্যতা এখানেই কিছুটা ধরা যাচ্ছে।

নিজ ভাষা বাংলার প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য এক মা প্রতিনিয়ত তাঁর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা বই, পত্রিকা নিজে পড়েন, বাচ্চাদেরও পড়ে শোনান, পড়তে বলেন। তেমনই এক বই পড়তে গিয়ে কৌতূহলী ছেলে মাকে প্রায় বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। খাওয়ার টেবিলে পড়েছিল কয়েকটি বই। এটা মায়ের একটি সুচিন্তিত কৌশল বা পদ্ধতি। কায়দাটা কার্যকর হলো একসময়ে।

ওখান থেকে একটি বই হাতে নিয়ে স্কুল যাওয়া ছেলেটি বলল, ‘মা এই বইয়ের author আবু জাফর ওবাদুল্লাহ।’

লেখকের নাম পড়তে পেরে ছেলেটির আত্মবিশ্বাস একটু যেন বাড়ল।

তার মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ঠিকমতো হয়নি; নামটার শেষটুকু ওবায়দুল্লাহ হবে। তুমি ‘য়’ উচ্চারণ করোনি।’

‘ঠিক আছে ওই Alphabet–এর উচ্চারণটা কী হবে তা তুমি ইংলিশে লিখে রাখবে, এটা আজ তোমার হোমওয়ার্ক।’

মাকে হোমওয়ার্ক বুঝিয়ে দিয়ে ছেলে স্কুলে চলে গেল। মায়ের হলো সমস্যা। ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

ভাষাবিদ নন তিনি। শিক্ষকও নন। ছেলের কৌতূহল সমাধান না করলে বাংলা ভাষা শিখতে সে আগ্রহ হারাবে। ইংরেজি বাংলা ডিকশনারি নিয়ে বসে ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার সমস্যার সমাধান মনে হলো খুঁজে পেলেন।

ইংরেজি শব্দ Boy, Toy, Joy বাংলায় উচ্চারণগুলোও লেখা ছিল ডিকশনারিতে বয়, টয়, জয়। তখনই মা লিখে রাখলেন ‘য়’ (oy)। মায়ের ভালো লাগল যে ছেলের মনে এমন কৌতূহল বা প্রশ্ন জেগেছে বলেই মা নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে উপায় বের করতে পেরেছেন।