ব্রাজিলে মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বসংস্কৃতির মিলনমেলা

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া

মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ বছরের ইউনেসকো প্রতিপাদ্য ‘ল্যাংগুয়েজ উইদাউট বর্ডারস’-এর আলোকে ব্রাজিলের রাজধানীতে ব্রাসিলিয়ায় এ বছর আয়োজন করা হয়েছিল দুই দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠানমালার।

প্রথম দিনের (২০ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে এবার ১২টি দেশের ১৫টি সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় সাজানো হয়েছিল সন্ধ্যার অনুষ্ঠানমালা।

গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজনেও ইউনেসকো-ব্রাজিল ও রাজধানী ব্রাসিলিয়া সরকারের সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিভাগ দূতাবাসের এ উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

দেশটিতে একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপনে এ দুটি সংগঠনের অংশীদারত্ব এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। দেশটির ২১ কোটি জনগণ ও এ দেশে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক বিদেশির কাছে একুশের বার্তা পৌঁছে দিতে এই যৌথ উদ্যোগ আগামী দিনগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

২০ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান তাঁর স্বাগত বক্তব্যে ভাষাসংগ্রাম থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা তুলে ধরেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের একুশে কীভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো, সে গৌরবের দিনগুলোও তিনি তুলে ধরেন।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্মার্থ তথা পৃথিবীর সব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সব ভাষার মানুষের তাঁদের নিজ নিজ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার নিশ্চিতের জন্যও রাষ্ট্রদূত আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভাষা একটি জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বা জাতিগত পরিচয় বংশপরম্পরায় বয়ে নেওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন এবং পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবার ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা তাই জরুরি।

‘বাঙালির মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষায় শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় অভিষিক্ত। একদা একান্তভাবেই বাংলাদেশের এই দিবসটি আজ রাজনৈতিক সীমান্ত ছাড়িয়ে পালিত হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র। একুশের প্রেক্ষাপট, ইতিহাস বা পৃথিবীর সব ভাষার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের সংগ্রামে একুশের অবদান—এসবই বিশ্বসভায় তুলে ধরার দায়িত্ব তাই আজ সব বাঙালির’।

এভাবেই ব্রাজিলে এবার বৃহত্তর পরিসরে একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতা বর্ণনা করেন রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান। অনুষ্ঠানে বিপুল দর্শক উপস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রদূত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিব শতবর্ষে বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনগুলোতে অংশগ্রহণের জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া

ইউনেসকো ও ব্রাসিলিয়া সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্বের প্রতি আলোকপাত করে এ বিষয়ে কাজ করে যাওয়ার জন্য তাঁদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে দিনটিকে সবার মাঝে পরিচিত করার এ প্রয়াসের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁরা বলেন, ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসের এ উদ্যোগে তাঁরা ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করবেন।

ইউনেসকো-ব্রাজিলের পরিচালক, ব্রাসিলিয়া সরকারের গভর্নরের প্রতিনিধি, ব্রাজিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তা, ব্রাজিল সরকারের বিভিন্ন স্তরের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ শতাধিক কূটনীতিক, ব্রাজিলিয়ান, অন্য বিদেশিসহ বিপুলসংখ্যক দর্শক–শ্রোতা এ আয়োজনে উপস্থিত থেকে বাঙালির প্রিয় একুশেকে সত্যিকারভাবেই সেদিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপান্তর করেন। বিশ্বসংস্কৃতির এক মিলনমেলা যেন বসেছিল ব্রাসিলিয়ায় সেই সন্ধ্যায়।

বাংলাদেশের উপস্থাপনায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ বা ‘চলো বাংলাদেশ, চলো বিশ্ব উঠানে, চলো বাংলাদেশ, চলো বিজয়ের টানে’, স্প্যানিশ ফ্লামিংগো, ব্রাজিলের ইউনেসকো-স্বীকৃত ঐতিহ্য কাপোয়েইরার বা ফোহো অ্যান্ড সাম্বার মনমাতানো পরিবেশনা, জাপানের হিকারিদাইকো-তাইকো ড্রামের উচ্চনিনাদের পরিবেশনা, অ্যাঙ্গোলার আফ্রিকান ঐতিহ্যবাহী নাচ, আর্জেন্টিনার বিশ্বখ্যাত ট্যাংগো, গ্রিসের পরিবেশনায় হেলেনিক সংস্কৃতির একগুচ্ছ উপস্থাপন, কিউবার মনমাতানো আর রুদ্ধশ্বাস ব্যালে পরিবেশনা, ব্রাজিলের স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী আনা লেইলার পরিবেশনায় ‘শান্তির’ গানের মূর্ছনা, দর্শকমাতানো মিসরের লোকনৃত্য, জ্যামাইকার পরিবেশনায় ‘সিয়ার স্বপ্ন’, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পরিবেশনায় ঐতিহ্যবাহী আরব নৃত্য, সিরিয়ার কণ্ঠশিল্পী দিয়ালা ফায়াদের সুরেলা আরবি সংগীতের পরিবেশনা—এসবই উপভোগ করেন হলভর্তি দর্শক তিন ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠানে।

মুহুর্মুহু করতালিতে সিক্ত হন শিল্পীরা। দূতাবাসের এ আয়োজনের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশি, কূটনৈতিক কোরের সদস্য, ব্রাজিলিয়ান ও অন্য বিদেশিরা দূতাবাসকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া

দ্বিতীয় দিন একুশের সকালে রাষ্ট্রদূত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে দিনের কর্মসূচির সূচনা করেন। এরপর প্রবাসী বাংলাদেশি ও দূতাবাস পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে দূতাবাসে স্থাপিত শহীদ মিনারে তিনি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দূতাবাসে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণীসমূহ পড়ে শোনানো হয়।

এ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ আলোচকেরা বায়ান্নর শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে বলেন, বাঙালির ভাষা আন্দোলনই ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের সূত্রপাত। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনকের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতকে শক্তিশালী করার বিষয়েও তাঁরা প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

রাষ্ট্রদূত তাঁর সমাপনী বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করে বলেন, ‘ভাষাশহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় দীক্ষিত হয়ে আজ আমাদের কাজ তাঁদের স্বপ্নের সব রকমের বঞ্চনাহীন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’ বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় অংশগ্রহণ করে একটি শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, আজকের শিশুরা যাতে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে শিখতে ও চর্চা করতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রত্যেক মা–বাবার কর্তব্য। ভাষাশহীদদের প্রতি সেটাই হবে আমাদের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রদ্ধার্ঘ্য।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, বায়ান্নর ভাষাশহীদরা শুধু তাঁদের মাতৃভাষার তথা বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যই সেদিন আত্মাহুতি দেননি। তাঁদের আত্মদান ছিল পৃথিবীর সব নির্যাতিত ভাষার বা সব ভাষার মানুষের তাদের নিজ নিজ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য।

স্বাগত বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া
স্বাগত বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসিলিয়া

রাষ্ট্রদূত বলেন, পৃথিবীর কোনো ভাষাই অন্য ভাষার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না। প্রতিটা ভাষাই সেই ভাষাভাষী মানুষের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ভাষা নিয়ে এ পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টা অনুধাবন করতে পারলে পৃথিবীতে অনেক সংঘাত এড়ানো সম্ভব বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। দূতাবাসের এ আয়োজনের শেষ পর্যায়ে ভাষাশহীদদের জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়। বিজ্ঞপ্তি