অবার্নে রক্তে রাঙা একুশের রাত

অবার্নে একুশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা
অবার্নে একুশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা

সপ্তাহান্তের শেষ দিন। শুক্রবার। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। দেশে যখন সাঁঝের বেলা একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে, ঠিক তখন ছোট্ট অবার্নের বুকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে রক্তিম সূর্য। একটু একটু করে বেলা হয়। চিকচিকে সূর্যরশ্মি এসে পড়ে চোখে।

অদূরে শীতের রুক্ষতায় বিবর্ণ রূপে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ভেদ করে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয় জানালার কাচে। দূর আকাশের বুকে গাঢ় নীল সমুদ্র। বড় শান্ত বড় শীতল প্রকৃতি।

শুভ্র কর্মকারের হৃদয়সিক্ত গানের পরিবেশনার সময় পিনপতন নীরবতা
শুভ্র কর্মকারের হৃদয়সিক্ত গানের পরিবেশনার সময় পিনপতন নীরবতা

তবুও কেমন করে যেন মনের ভেতরে কী যেন এক সুর গুন গুনিয়ে বেজে চলেছে নিরন্তর। কী এমন এক সুর? যে সুরে লুকিয়ে আছে ছেলে হারানো কত শত মায়ের কত শত আকুতি। লুকিয়ে আছে কত শত অব্যক্ত ব্যথা। অব্যক্ত যন্ত্রণা।

অন্য দিনের মতো সেদিনও ডুবে গেলাম দিনের ব্যস্ততায়। কেমন করে যেন একটা সময় টের পেলাম, বেলাটা পড়েছে। আজ একটু আগে আগে ফিরতে হবে। সঙ্গের প্রিয় সতীর্থ হিরা খানিকবাদেই বলে উঠল, ভাই আজ বিকেলের একুশের আয়োজন কি মনে আছে?

প্রতিদিনের মতো সেদিনও দিবসের সব ব্যস্ততা আড়াল করে সন্ধ্যা নামে অবার্ন নামে ছোট্ট শহরের বুকে। আবছা আবছা অন্ধকার মিলিয়ে যেতে থাকে রাতের আঁধারে। হ্যালোজেনের আলো মিটিমিটি জ্বলে ওঠে। একটু একটু করে ভিড় জমে অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট সেন্টারে। বাঙালির ভিড়। সেই রক্তিম দিবসকে ফিরে দেখার ভিড়। অমর একুশকে অমর করার ভিড়।

ছড়া বলছে সর্বকনিষ্ঠ অংশগ্রহণকারী ছোট্ট পারিসা
ছড়া বলছে সর্বকনিষ্ঠ অংশগ্রহণকারী ছোট্ট পারিসা

অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট সেন্টারের হলরুমে শুরু হয় প্রাণের অনুষ্ঠান। একুশে পালন। তৈরি করা হয়েছে ককশিটের রক্তিম শহীদ মিনার। আয়োজক বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। প্রাপ্তির সঞ্চালনায় আর আমিনুলের কারিগরি সহায়তায় শুরু হয় মূল সাংস্কৃতিক পর্ব। শুরুতে ভাষা দিবসের মর্যাদায় কথা বলেন বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন স্যার। স্যারের আবেগসিক্ত কথায় যেন ভেসে ওঠে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের আত্মদানের মূল সুর। তারপর নানা পরিবেশনায় নিজেকে হারিয়েছি কতবার।

অমর একুশের নানা আয়োজনে কখনো ফিরে গেছি হৃদয়সিক্ত কবিতায়, কখনোবা হৃদয়নিংড়ানো দেশের গানে। অর্ক আর উম্মে হানি আবৃত্তি করে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই বিখ্যাত কবিতা—‘মাগো ওরা বলে।...কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা। আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি। খোকা তুই কবে আসবি? কবে ছুটি? চিঠিটা তার পকেটে ছিল-ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।’

রক্তে ভেজা কবিতার কথায় কথায় কখন যে হৃদয় আঙিনায় অশ্রু ক্ষরণ শুরু হয়েছিল, ঠিক বুঝতে পারিনি। একটা সময় ছোট্ট পারিসা, কৃষ, আর আরিবাদের আদুরে গলায় ছড়ার ছন্দে যেন ভর করে মায়ের ভাষার মধুর মাতৃত্ব। খানিক বাদে ড. শুভ্র কর্মকারের কণ্ঠে গানের কথায় কথায় যেন হারিয়ে যাই নিজ ভুবনে। হারিয়ে যাই সেই ফেলে আসা দেশের মাটির সোঁদাগন্ধে। হারিয়ে যাই সেই মাটির বুকে, যে মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন লক্ষ মুক্তিসেনা।

শহীদ মিনারের পাশে (বাঁ থেকে) তৌকি, সামি, লেখক, শামীম, সজীব ও আক্তারুজ্জামান
শহীদ মিনারের পাশে (বাঁ থেকে) তৌকি, সামি, লেখক, শামীম, সজীব ও আক্তারুজ্জামান

সিফাত মোনামি তার আবৃত্তির মধ্য দিয়ে যেন মনে করিয়ে দেন আমাদের সেই বীর–বীরাঙ্গনাদের বীরত্বের কথা, তাঁদের আত্মত্যাগের কথা। এমনি করে একের পর এক পরিবেশনা চলতে থাকে ঘণ্টা অবধি। আর তাতেই যেন নিজেকে হারাতে থাকি নানা ছন্দে নানা কাব্যে।

শতাধিক বাংলাদেশি গবেষক ছাত্রদের বসবাস এই ছোট্ট অবার্ন শহরে। এ বিবর্ণ দেশে এত চাপের পরেও কেমন করে যেন কিছু কিছু দিবসে আমাদের মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর সেই সিক্ত হৃদয়ের ব্যাকুল মানুষগুলোকে নানা দিবসে নানা আয়োজনে একত্রিত করেন কিছু কিছু নিবেদিতপ্রাণ। আজও এই বিবর্ণ দেশে কিছু কিছু মানুষ যেন বটবৃক্ষের মতো করে ছায়া দিয়ে চলেছেন। তাঁরা হলেন অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন, তাজকিজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামাল ভাই ও ড. কণা আপু, সহকারী অধ্যাপক ড. আতিক ভাই এবং ডা. মতিন, ড. সালাম ও প্রকৌশলী কাজমী ভাই। এই মহতী মানুষগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

মাতৃকোলে শিশুদের একুশে পালন
মাতৃকোলে শিশুদের একুশে পালন

বড়দের গণ্ডির বাইরে কিছু কিছু গবেষক ছাত্র আছেন, যাঁদের সময় আর শ্রম ছাড়া এমন মহৎ দিবসগুলো হয়তোবা উদ্‌যাপন করা সম্ভব হতো না। নিবেদিতপ্রাণ সেই মানুষগুলো পর্দার আড়ালেই কাজ করেন। আজও করেছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা।

রাত গভীর হয়। ফিরতে থাকি মিটিমিটি হ্যালোজেনের আলো ভেদ করে। কনকনে হিমেল হাওয়া। দূর আকাশে গভীর রাতের তারার হাতছানি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সেই তারার পানে। সেই গভীর রাতের তারার মাঝে যেন লুকিয়ে আছেন আমাদের সালাম, আমাদের জব্বার, আমাদের রফিক। এমনি করে হয়তো লুকিয়ে আছেন আরও কত অজানা নামের কত শহীদ। কেমন করে যেন হৃদয়ের গহিনে অনুরণিত হতে থাকে, ‘না, না, না, আমরা তোমাদের ভুলব না, ভুলব না।’

রাতের নিস্তব্ধতা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। বড় শান্ত বড় স্নিগ্ধ প্রকৃতি। তবু কেমন করে যেন সেই হৃদয়নিংড়ানো সুর এখনো গুনগুনিয়ে বেজে চলেছে হৃদমাঝারে।

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ, দুপুর বেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়-বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্য তাপে জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।’
---
মো. মনির হোসেন: পিএইচডি গবেষক, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।