প্রবাসে ফাগুন দিনের গান

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’—এই গানের কথা আর সূর আমাদের প্রবাসীদের ভীষণভাবে আন্দোলিত করে। মন ছুটে যেতে চায় বাংলাদেশে। এই মাসে আমাদের প্রবাসীদের মন কখনো বিষণ্নতা, কখনো গর্ব, কখনো অস্থিরতায় ভর করে।

আসলেও তাই। আমরা ভুলতে পারি না। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই মনে পড়ে প্রাণের বাংলা ভাষা। প্রিয় বর্ণমালার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, সেই সব শহীদদের, সূর্য না ওঠা ভোরে সাদা-কালো পোশাকে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কণ্ঠে সমবেত গান। মন ভীষণ উদ্বেলিত হয়, বইমেলার নূতন বইয়ের গন্ধের জন্য। এই মাসে এ রকম কত সব স্মৃতিই না এসে ভিড় করে প্রবাসী বাঙালির হৃদয়ে।
কানাডার সাস্কাতুনে ফেব্রুয়ারি মাস মানেই কনকনে শীত। কখনো বা আকাশ ভেঙে ঝরে তুষার রাশি, সঙ্গে হিমেল হাওয়া। এখানে ওখানে জমে থাকা শুভ্র তুষারে ছেয়ে আছে শহরের চারদিক। কিন্তু বাঙালির মন কেমন আনমনা হয়ে ছুটে যায়, আগুন ঝরা দিনে, কৃষ্ণ চূড়ায় ছেয়ে থাকা শহীদ মিনারের দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ স্তম্ভে। বাংলা ভাষায় কথা বলার অতৃপ্তি বাঙালির যেন এই মাসে আরও প্রবল হয়ে ওঠে। সে আকুলতাকে গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন অব সাস্কাতুন (বিসিএস) আয়োজন করেছিল বেশ কিছু সিরিজ অনুষ্ঠানের। এটি ছিল চার পর্বে বিভক্ত। তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে ছিল শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, প্রদেশের রাজধানী রেজিনায় প্রাদেশিক সংসদে বাংলাদেশি লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন, ছোট্ট শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আগে বাড়িতে বসে প্র্যাকটিস করেছিল বাচ্চারা। সেই আঁকা ছবিতে ভরে গেল বাবা-মার ফেসবুক পেজ। সবাই বিভিন্ন মন্তব্য করে উৎসাহিত করছিল বাবা-মাকে। নানান রঙের ছবিতে ফেসবুক যেন এক বিশাল ক্যানভাস। ফেসবুকও যেন বাঙালি চেতনার ধারক হয়ে উঠল।
সেদিনও ঠান্ডায় সবকিছু জবুথবু। বাংলা গ্রোসারি দেশি সুপারস্টোরের ওপরতলাটা বাচ্চাদের কলকাকলীতে মুখরিত হলো। তারপরও আমাদের শিশুরা মহাউৎসাহে ছবি আঁকা আর হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিল। বাবা-মায়ের হাত ধরে রংবেরঙের জ্যাকেট পরে হাসি হাসি মুখে সব বাচ্চারা বসে গেল দলবেঁধে। এ দেশে বড় হওয়া নতুন প্রজন্ম প্রবল উৎসাহ আর আনন্দ নিয়েই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। মনের রঙের সঙ্গে পেনসিলের রং মিলিয়ে কেউ আঁকল শহীদ মিনার, কেউ আঁকল জাতীয় পতাকা, কেউ বা লাল আকাশ। হাসি-খুশি শিশুদের কাউকেই হতাশ হতে হয়নি, কারণ সব বাচ্চাদেরই দেওয়া হয়েছিল সান্ত্বনা পুরস্কার।
পরের পর্বটি ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, ফুলেল শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করেছে বাংলাদেশ সাস্কাতুন কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন। শহীদ মিনার বাঙালির চেতনার মিনার। এ মিনার বাঙালির ত্যাগ, কষ্ট ও আনন্দ-বেদনার মিনার, আমাদের অহংকারের মিনার। এর প্রস্তুতি পর্বও অত সহজ ছিল না। আগের দিন রাতে ফেসবুক খুলেই দেখি লাইভে আছেন বিসিএসের সভাপতি কামনাশীষ দেব। তার সঙ্গে আছেন শাখাওয়াৎ হোসেন টগর, সাজ্জাদ আজাদ ও আরও অনেক প্রিয় বাঙালি মুখ। সিটি হল চত্বরে অন্ধকার নিয়ন লাইটের আলোয় হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করছেন তারা। হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দে, কামনাশীষের ভাঙা গলায় একুশের গান সমস্ত সাস্কাতুনবাসীকে যেন নিয়ে গেল আলপনা আঁকা ঢাকা শহরের পিচঢালা রাজপথে।

পুরস্কার বিতরণী
পুরস্কার বিতরণী

পরদিন সকালে সাস্কাতুনের প্রবাসীরা প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে বিসিএসের নেতা কামনাশীষের নেতৃত্বে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সঙ্গে পুষ্পস্তবক প্রদান করেন অস্থায়ী শহীদ মিনারের বেদিতে। সেদিন ছিল মাইনাস থার্টিফোর। ডাউন টাউনের সিটি হলের সামনে বিসিএসের নেতারা অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিটি মেয়র এলেন। মাথায় টুপি, গায়ে ভারী জ্যাকেট, হাতে মোজা পরে ততক্ষণে চলে এলেন প্রায় পঞ্চাশজন বাংলাদেশি। ঠান্ডায় সবার শরীর ঠকঠক কাঁপছে। বরফের মতো জমে যাচ্ছিল সবার হাত-পা। শুধু উষ্ণ ছিল বাঙালি হৃদয়। নিজের দেশ, ভাষা সংস্কৃতি বলে কথা। কনকনে ঠান্ডায়, মেঘ-রোদ্দুর আকাশে সিটি হলের চত্বরে তখন বাংলাদেশি পতাকা আবারও মাথা উঁচু করে পতপত করে উড়ছিল।
একই দিনে প্রাক্তন সভাপতি জাকির হোসেনের নেতৃত্বে রাজধানী রেজিনাতে গিয়ে প্রাদেশিক পার্লামেন্টে আমাদের লাল-সবুজ পতাকাকে উত্তোলন করে এবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বাংলাদেশ কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন অব সাস্কাতুন। শহীদ মিনারে আমরা বাঙালির চেতনার ঠিকানা খুঁজে পাই, আনন্দ-বেদনা খুঁজে পাই। বাঙালির সেই স্মৃতির মিনার পাকিস্তানি দুঃশাসন ভেঙে দিয়েছিল ১৯৫২ সালে। কিন্তু মানুষের চেতনাকে অতটা সহজে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না; গুঁড়িয়ে দেওয়া যে যায় না, পাকিস্তানি দুঃশাসন তা প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৭১ পর্যন্ত। বাঙালির চেতনার মিনার ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, এমনকি প্রবাসেও। প্রচণ্ড ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে শহীদবেদিতে ফুল আর লাল-সবুজ পতাকার আকাশ ছুতে যাওয়ার চেষ্টা যেন এক অদম্য অঙ্গীকার। সেটিরই প্রমাণ রেখেছে সাস্কাতুনের প্রবাসী বাঙালিরা।

অস্থায়ী শহীদ মিনারে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
অস্থায়ী শহীদ মিনারে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

এরপর ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমরা যারা প্রবাসী হই সব সময় উৎকণ্ঠায় থাকি নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি যেন আবার না হারিয়ে ফেলি। বাবা-মায়েরা এ নিয়ে সচেষ্ট থাকেন। আমাদের সন্তানেরা বেশির ভাগ সময় ইংরেজি পরিবেশে বড় হওয়ার জন্য ইংরেজিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের অন্য একটি ভাষা শেখানো, সংস্কৃতিকে রপ্ত করানোর জন্য আমার মতো অনেক বাবা-মাকে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। অনেকেই, শনিবারের ছুটির আমেজ নষ্ট করে বাচ্চাদের বাংলা স্কুলে নিয়ে যান। যাতে বাংলা ভাষা যেন কোনোভাবেই হারিয়ে না যায়। আর স্কুলে কিংবা সরকারিভাবে অন্য ভাষায় কথা বলাকে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। সে কারণে সরকার বিভিন্ন ফান্ডও দিয়ে থাকে। কমিউনিটির অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাচ্চাদের সেখানে হয় বাংলা গান, নাচ, কবিতা ও নাটক। তবে বাবা-মাদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ থাকে বিদেশি ভাষা, সংস্কৃতি আর পরিবেশের মাঝে এসব শেখানো। বিশেষ করে স্কুলের বন্ধুবান্ধব ও সংস্কৃতি তাদের বাঙালি সত্তাকে ধারণ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা তখন ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা চালিয়ে যাই নিজের ভাষাগত চেতনার বীজ তাদের ভেতর বপন করতে।
এ বিষয়ে নিজের একটি ছোট্ট গল্প না বলেই পারছি না। আমার কন্যা রোদেলা পড়াশোনার দোহাই দিয়ে বাঙালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে না বেশ কয়েক বছর হলো। আমাদের বন্ধু জেবুন্নেসা চপলা এ নিয়ে বেশ দুঃখ করছিল। আমরা দুজন যুক্তি করে রোদেলাকে চপলার বাড়ি পাঠালাম। এভাবে দু-তিন দিন যাওয়া-আসার পর রোদেলা চপলার ভক্ত হয়ে গেল। সে তার সঙ্গে বিভিন্ন কথা বলে ও খাইয়ে তাকে পটিয়ে ফেলল। কোনো একফাঁকে তাকে একুশের অনুষ্ঠানের একটি নাচে অংশ নিতে বলল চপলা। রোদেলা চপলাকে বলল নাচটি কোরিওগ্রাফি করে শিখিয়ে দেবে। এরপর রোদেলা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বাদ দিয়ে, বিশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে চপলার বাসায় হাজির হতো সপ্তাহে দুই দিন। চপলার কন্যা প্রার্থনা-প্রকৃতিকে রিহার্সাল করিয়ে, একটি চমৎকার নাচ কোরিওগ্রাফি করল সে। শুধু তাই নয় সাদা-কালো সালোয়ার কামিজ পরে অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো। আর কালো পাড় সাদা শাড়িতে ছোট্ট মেয়ে দুটি ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার দামাল ছেলে’ গানটির সঙ্গে চমৎকার নৃত্য পরিবেশন করল। তখন দর্শকসারিতে বসা আমার কাছে বারবার মনে হচ্ছিল, যতই প্রবাসে থাকি ইচ্ছা থাকলে নিজের ভাষার চেতনা প্রবাসী নূতন প্রজন্মকেও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। সত্যি বলতে কী ইংরেজির দাপটে যেখানে কানাডীয় আদিবাসীদের ভাষা বিলুপ্তির পথে, সেখানে আমরা বাঙালিরা এখনো পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাচ্চাদের নিয়ে দেশের গান গাই, নাচি, এটা কোনো অংশে কম নয়। শেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে। সে কারণে বাঙালিদের সঙ্গে অন্য ভাষাভাষী শিল্পীরা অংশ নিয়ে চমৎকার মনোমুগ্ধকর এক অনুষ্ঠান উপহার দিল। অন্য ভাষা-ভাষী কানাডীয়দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশি ছোট্ট বাচ্চাগুলো আমাদের দেশের ভাষার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে যে উজ্জ্বল করেছে, এটা না বললেই নয়।
সাস্কাতুনে আছে চমৎকার সব গান ও আবৃত্তি শিল্পী। বিসিএসের উদ্যোগে তাদের নিয়ে চমৎকার এক গীতি-আলেখ্যও অনুষ্ঠিত হলো। সেই অনুষ্ঠানের জন্য মাসব্যাপী রিহার্সাল, চা-চক্র, আড্ডাবাজিও কম আনন্দদায়ক ছিল না। দর্শক সারিতে দেশি-বিদেশি সকল দর্শকের মুখেই ছিল প্রশংসা, চমৎকার এই অনুষ্ঠানটির জন্য।
এই হিমেল হাওয়ায় কুঁকড়ে যাওয়া ঝলমলে রোদ মাখা শহরে, নাই থাক ফাগুনের রং। তবে নিজের ভাষাকে নিয়ে গর্ব করার মতো হাজার চারেক বাংলাভাষী বাঙালি আছে। এভাবেই চরম ব্যস্ততার মাঝেও আমরা নিজের ভাষাকে, সংস্কৃতিকে ঐতিহ্যকে ধরে রাখছি। সকল বাঙালি জাতির আত্মদান ও ত্যাগ স্বীকার করেই বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে মহান মাতৃভাষা দিবস। এ কারণে আজ মহান শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালিদের পাশাপাশি অন্যরাও পালন করছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত বাংলা ভাষার ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন অব সাস্কাতুনের উদ্যোগ ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে এটাই আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের প্রত্যাশা।

ভিকারুন নিসা: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।