রক্তে ভেজা জামার টুকরো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে মহানগর গোধূলী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন ভাষাসৈনিক মুহাম্মদ মুসা। কলেজের এক অনুষ্ঠানে তাঁকে একদিন দেখেছি। তবে কথা বলার সুযোগ হয়নি।

এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিতেই মুহাম্মদ মুসা তাঁর পাশে বসতে বললেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে পড়ছি শুনেই তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। আশীর্বাদ যেন আর শেষই হয় না। পরক্ষণেই খেয়াল করে দেখি, কী এক জ্যোতি যেন ভেসে উঠেছে তাঁর চোখে।

সবিনয় অনুরোধ করে বলি, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কথা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।

মুহাম্মদ মুসা বলেন, ‘আমাদের এ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনস্টেশনটি বুকে ধারণ করে আছে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের অমলিন গৌরব।’

অধীর আগ্রহে আমি মুহাম্মদ মুসার চোখের দিকে চেয়ে থাকি।

বলিষ্ঠ এক আত্মবিশ্বাসে মুহাম্মদ মুসা বলেন, ‘সেদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। অলি আহাদ ভাই ঢাকায় আছেন। তিনি আমাদের জন্য বার্তা পাঠাবেন। এই ভরসা নিয়ে মাঝরাতে আমরা অনেক ছাত্রছাত্রী অবস্থান নিয়েছি এই স্টেশনে। রাত একটায় চট্টগ্রাম মেইল এসে থামল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রকে দিয়ে অলি আহাদ ভাই আমাদের জন্য এক রক্তাক্ত বার্তা পাঠিয়েছেন—শহীদ বরকতের গায়ের জামার রক্তে ভেজা এক টুকরো কাপড়।

‘ততক্ষণে এই স্টেশন ছাত্রজনতায় কানায় কানায় পূর্ণ। টগবগিয়ে উঠল সবার গায়ের রক্ত। বরকতের রক্তভেজা জামার টুকরো হাতে নিয়ে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কে একজন চিৎকার দিয়ে বলল, “চুপ করো। এটা কান্নার সময় নয়। এটা প্রতিশোধের। প্রতিরোধের সময়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতেই হবে।”

‘কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টেশন থেকে সরে এসে গোপন বৈঠকে শিমরাইলকান্দি শ্মশানঘাটে আমরা কয়েকজন সদস্য মিলিত হলাম। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে পরদিন সকাল ১০টায় খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিপুল ছাত্রজনতা এসে মিলিত হলো কলেজ মাঠে। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে গগনবিদারী স্লোগান দিতে আমরা অগ্রসর হলাম লোকনাথ দিঘি ময়দানে।

‘যাওয়ার পথে আমাদের ফটিক ভাই সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে এক দৌড়ে কোর্ট ভবনে উঠে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলেন। বাঙালি জাতীয় চেতনায় শরীর শিহরিত হয়ে আবারও টগবগ করে উঠল আমাদের রক্ত। আকাশ কেঁপে উঠল আমাদের স্লোগানে—“রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, শহীদ স্মৃতি অমর হোক, নুরুল আমিনের কল্লা চাই”।

‘শহীদ বরকতের রক্তাক্ত জামার টুকরো দেখিয়ে লোকনাথ দিঘি ময়দানে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মতিউর রহমান ভাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব প্রতিষ্ঠান আর দোকানপাটে ওড়ানো হলো কালো পতাকা। সেদিনই আসন্ন স্বাধীনতার ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম এ বাঙালিকে আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

এ পর্যন্ত বলেই মুহাম্মদ মুসা থেমে গেলেন। এক অসীম মুগ্ধতায় আমি যেন পাথর হয়ে গেছি। বললাম, ভাই, যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এত এত সংগ্রাম করে আমাদের একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিলেন, তার প্রতিদানে আমরা তো আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।

স্নিগ্ধ শান্তির হাসিতে মুহাম্মদ মুসা বললেন, ‘যখন দেখি আমাদের সংগ্রামে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে পরবর্তী প্রজন্ম তোমরা হাসি–আনন্দে বড় হচ্ছ, লেখাপড়া করছ, মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছ, তখন খুশিতে বুকটা ভরে ওঠে। আপনি আমাকে চেনেন, তাই আগ্রহভরে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে দুটো কথা শুনতে চাইলেন। অনেকেই তো আমাকে চেনেই না। তাতে কীই-বা আসে যায়।’

ততক্ষণে মহানগর গোধূলী ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়েছে।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>